জোটের অঙ্ক ভোটের হিসাব
WB Municipal Election

কিসে জোরদার হয় বিরোধী রাজনৈতিক ফ্রন্ট, কিসে হয় না

বেশির ভাগ জোটই শেষ পর্যন্ত গসাগু ও দড়ি টানাটানির খেলা। বহুদলীয় গণতন্ত্রের শক্তি ও দুর্বলতা দুই-ই এর মধ্যে সম্পৃক্ত।

Advertisement

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৪:৩২
Share:

নির্ধারক: ভোটবুথের সামনে সারিবদ্ধ প্রতীক্ষা, গাজ়িয়াবাদ, উত্তরপ্রদেশের ভোট, প্রথম দফা, ১০ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই।

সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু টিফিনের সময় শান্তশিষ্ট ভাবে এক কোণে বসে আপন মনে দুটো জিসিএম করে ফেলল। সহপাঠী রামপদর জন্মদিনে মিহিদানা খাওয়ার সময় দাশরথি হঠাৎ ‘গসাগু’ কষতে গেল কেন, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি ছেলেবেলায়। গসাগু-র প্রয়োজন অবশ্য নিত্যদিন। অদ্ভুত সব বন্ধুত্ব করতে। সম্পর্ক জুড়তেও।

Advertisement

ভারতবর্ষে জোট-রাজনীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে সেই সত্তরের দশক থেকেই। ‘ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচি’ই জোটের ক্ষেত্রে গসাগু। প্রায় প্রতি লোকসভা নির্বাচনের আগেই আমরা ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’-এর কথা শুনি। কোনও একটা ভোটের দামামা বাজলেই দেশসুদ্ধ সবাই ‘বিরোধী ঐক্য’ হল কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামায়! ঢাল-তরোয়াল’সহ এই তথাকথিত ঐক্যের কাঠামোটাকে দাঁড় করাতে না পারলে বিরোধীদেরও অস্বস্তি প্রকাশ পায়, শাসক দলও বিরোধীদের ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না। যেন ভোটের বাজারে বিরোধীরা এককাট্টা হয়ে শাসকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, এটাই দস্তুর। এ সময় গসাগু-টুকু হল প্রধানত শাসকের বিরোধিতা। ভোটাররা যদিও কেবল এর জন্যই উজাড় করে ভোট দেন বলে মনে হয় না, যদি না কোনও কারণে শাসকের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের সলতেটা প্রস্তুত থাকে।

বাস্তবে বেশির ভাগ ভোটারই কিন্তু কোনও ‘বিশেষ’ দলকে ভোট দেন ‘বিশেষ’ কিছুর জন্যই, যা অন্য দলগুলির কর্মসূচিতে নেই। বহুদলীয় গণতন্ত্রে নানা মতবাদে বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রধানত ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বার্থ দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। এদের এক ছাতার তলে আসা কখনওই সহজ নয়। আবার বহুদলীয় গণতন্ত্রে ভোটযুদ্ধটা প্রধানত দুই মেরুর লড়াই হতে হবে, এমনও তো কোনও কথা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোটের আগে এদের একজোট হওয়াটা হয়তো তাই রাজনৈতিক সুবিধার জন্যই। তাতেও অবশ্য অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু, এই ‘সুবিধা’ পাওয়াটাও কী নিশ্চিত?

Advertisement

আসলে কোনও রাজনৈতিক দলকে কোনও নির্বাচনে যত জন ভোট দেন, তার মধ্যে নিবেদিত-প্রাণ ভোটার খুব ছোট্ট একটা অংশ। বাকি বিরাট সংখ্যক ভোটারের সমর্থন একেবারে ঝুরঝুরে, বালির বাঁধের মতো। এঁরা ভাসমান বা ‘ফ্লোটিং’ ভোটার। একটা হালকা দমকা হাওয়াই তাঁদের সমর্থনকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে যেখানে সেখানে। আজকের বামফ্রন্টকে দেখলেই তা স্পষ্ট বোঝা যাবে। রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো বেশির ভাগ সময়ই সেটা মনে রাখে না। যা-ই হোক, বিরোধী ঐক্যের নাম করে চরিত্রগত ভাবে পরস্পর-বিরোধী কিছু দলের এই ঝুরঝুরে ভোটকে এক বাক্সে জড়ো করা এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা, নিঃসন্দেহে।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে অবশ্য বিরোধী ঐক্যের ম্যাজিক কাজ করে সময় সময়। মোরারজি দেশাই, ভি পি সিংহ কিংবা অটলবিহারী বাজপেয়ী এর সাক্ষ্য দিতে পারতেন অবশ্যই। আমার অবশ্য ধারণা, সময়-বিশেষে এই ম্যাজিকের ক্ষেত্রটা প্রস্তুত হয়েই থাকে। শাসনের অনিবার্য ফলে শাসক দলই তীব্র অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সির সলতেটা পাকিয়ে রাখে। দরকার থাকে শুধু একটুখানি আগুনের ফুলকি। উপযুক্ত বিরোধী ঐক্য তখন এই কাজটা করে সহজেই। কারণ, জনগণের একটা বড় অংশ প্রস্তুত হয়ে আছে শাসক-বিরোধী ভোট দিতে।

কিন্তু ওই সলতেটা যদি পাকানো না থাকে? চাপিয়ে দেওয়া তথাকথিত বিরোধী ঐক্য কী তবে পাশ করতে পারে নির্বাচনের লিটমাস টেস্ট? আসন্ন উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে অখিলেশের সমাজবাদী দলের সঙ্গে জোট হয়নি মায়াবতী আর ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসের। তাতে কি ক্ষমতাসীন বিজেপির সুবিধা হল, না কি অসুবিধা? আবার জয়ন্ত চৌধরির নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রীয় লোকদলের সঙ্গে সমাজবাদী পার্টির জোট কতটা কঠিন সমস্যায় ফেলতে পারে বিজেপি-কে, তাও এ মুহূর্তে বোঝা হয়তো অসম্ভবই। যদিও বিরোধী ঐক্যের প্রয়াস চলতেই থাকে। ২০২২-এর লখনউ পেরিয়ে ২০২৪-এর দিল্লির লক্ষ্যে। কিন্তু কী বলছে ২০১৭-র অভিজ্ঞতা?

বিভিন্ন ওপিনয়ন পোল আর আগের বিধানসভা আর লোকসভা ভোটের তথ্য রাশিবিজ্ঞানের কিছু সহজ মডেলের সাহায্যে নাড়াচাড়া করে আমার কিন্তু স্পষ্ট ধারণা হয়েছে, ২০১৭-তে এসপি আর কংগ্রেসের জোটের ফলে ক্ষতিই হয়েছে জোটের। উল্টে বিজেপির আসন সামান্য হলেও বেড়েছে এই জোটের ফলে। ঠিক তেমনই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তথ্য বিশ্লেষণ করে আমি নিশ্চিত, ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল আর কংগ্রেসের জোটের ফলে তৃণমূলের আসন সামান্য কমেছে। কী জানি, সে কারণেই হয়তো ২০১৬ কিংবা ২০২১-এ তৃণমূল আর জোটের পথে হাঁটেনি। ও দিকে ২০১৬-তে বাম-কংগ্রেসের জোটের ফলে বোধ হয় লাভই হয়েছে তৃণমূলের। আর ২০২১-এ বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ’এর রামধনু জোটের নির্মম অভিঘাত বুঝে উঠতেই বামেদের হয়তো কেটে যাবে আরও অনেকখানি সময়।

সাধারণ ভাবে জোট করবার উদ্দেশ্য থাকে জোটবদ্ধ দলগুলোর আসন-সংখ্যা বাড়ানো। আশা থাকে, জোটের দলগুলোর ভোট মোটামুটি একই বাক্সে পড়বে— প্রার্থী জোটের মধ্যের যে দলেরই হোক না কেন। বাস্তবে অবশ্য ভোটের অঙ্কের ব্যাখ্যা পাটিগণিতীয় নয়। জোটের ভোট পুরোটা এক বাক্সে পড়তে পারে, খানিক কমও পড়তে পারে, আবার জোটের জোয়ারে ভোট ফুলে-ফেঁপেও উঠতে পারে।

একটা ছোট্ট উদাহরণ নেওয়া যাক। কোনও আসনে ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’, ‘ঘ’-— চার দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে, আলাদা ভাবে লড়লে যাদের ভোট শতাংশ হত যথাক্রমে ৪০, ৩০, ২০ এবং ১০। কোনও জোট না হলে ‘ক’-দলের বিপুল জয় নিশ্চিত। ধরা যাক, নির্বাচনে ‘খ’ আর ‘গ’-দলের জোট হল। তাদের ভোট সরাসরি যোগ হলে জিতবে ‘খ+গ’ জোট। কিন্তু অনেক ভোটার এই জোটকে স্বীকার নাও করতে পারেন। ফলে এদের সম্মিলিত ভোট শতাংশ খানিক কমে গিয়ে ‘ক’-দল জিতেও যেতে পারে। আবার ‘খ’, ‘গ’ বা ‘ঘ’-দলের কিছু ভোটার ‘ক’-দলকে কৌশলী ভোট দিয়েও জিতিয়ে দিতে পারেন বিপুল ভোটে। উল্টো দিকে ‘ব্যান্ডওয়াগন প্রভাব’-এ ভর করে ‘ক’ আর ‘ঘ’ দলের ভোটের ভাগ পেয়ে আশাতীত বড় ব্যবধানেও জিতে যেতে পারে ‘খ+গ’। তাই কোনও জোট নির্বাচনে ভোট এবং আসন সংখ্যাকে কী ভাবে প্রভাবিত করবে তার ব্যাখ্যা সহজ নয়।

ইংল্যান্ডের মতো দেশে কৌশলী ভোটের রমরমা। জোট না হলেও বাম-ঘেঁষা সংবাদপত্রগুলি রীতিমতো চার্ট করে ভোটারদের বুঝিয়ে দেয় কোন আসনে লিবারাল ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের ভোট দেওয়া উচিত লেবার পার্টিকে, কোথায় তার উল্টোটা। দক্ষিণপন্থী সংবাদপত্রগুলিও একই ধরনের কাজ করে। এ সবের মাধ্যমে ভোটারদের এক পরোক্ষ জোটের পথ দেখানো হয়, কিন্তু সেই সঙ্গে খানিক আস্থাও জ্ঞাপন করা হয় ভোটারদের বিচক্ষণতার উপর। পরিবর্তে জোট বেঁধে আসনটিতে জোটপ্রার্থী দাঁড় করালে সেই অবকাশটুকু থাকে না।

তাই আমাদের দেশের বিরোধী ঐক্য কি কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রয়োজনে, না কি তার মধ্যে জনহিতের অঙ্কুর নিহিত রয়েছে, জনগণ তার হিসাব কষবেই। সম্প্রতি এক লেখায় যোগেন্দ্র যাদব জোর দিয়েছেন বিরোধিতার ধারণাকে প্রসারিত করায়। বলেছেন, বিরোধিতার লক্ষ্য শুধু একটি বিপক্ষ তৈরি করা নয়, বরং একটি প্রতিপক্ষ তৈরি করা, যা আশা জাগায়, সম্ভাব্য বিকল্প উপস্থাপিত করে। এই পরিণতি-বোধ বোধ হয় অনুপস্থিত রংবেরঙের বেশির ভাগ জোটেই। যদিও, বেশির ভাগ জোটই শেষ পর্যন্ত গসাগু ও দড়ি টানাটানির খেলা। বহুদলীয় গণতন্ত্রের শক্তি ও দুর্বলতা দুই-ই এর মধ্যে সম্পৃক্ত।

আর এই গসাগু-র পরিণতি তো একেবারেই অজানা। এর ফলে ফুটতেই পারে ভোট-বসন্তের ফুল। আবার কখনও খানিক পরেই মিহিদানার হাঁড়িতে চিনে পটকা ফোটে। ঘটতে থাকে লঙ্কাকাণ্ড।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement