সে প্রায় ১,৪০০ কোটি বছর আগের কথা। এক অকল্পনীয় বিস্ফোরণের পরেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হল। এই বিস্ফোরণের প্রচলিত নাম বিগ ব্যাং। আমরা যখন ষাটের দশকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে গেলাম, তখনও বিগ ব্যাং আবিষ্কার হব হব করছে। ফ্রেড হয়েল, জয়ন্ত নারলিকর, ডেনিস সিয়ামার মতো বাঘা বাঘা অধ্যাপক তখন কেমব্রিজে রয়েছেন। এঁরা সকলেই তখন ব্রহ্মাণ্ডের ‘স্টেডি স্টেট থিয়োরি’ নিয়ে মশগুল। ব্রহ্মাণ্ড তরতরিয়ে প্রসারিত হচ্ছে, অনেকটা বেলুনে হাওয়া ভরলে যেমনটা হয়। ফাঁকা জায়গা সৃষ্টি হচ্ছে, এবং সেখানেই নতুন করে হাইড্রোজেন থেকে তৈরি হচ্ছে নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ইত্যাদি। সুতরাং, ব্রহ্মাণ্ডের নেই কোনও শুরু, নেই কোনও শেষ। সৃষ্টি ও ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সে রয়েছে ‘স্টেডি স্টেট’-এ।
স্টেডি স্টেট থিয়োরি নিয়ে তখন সবাই খুশি। এই মতবাদে বৈজ্ঞানিক যুক্তির সঙ্গে রয়েছে এক দার্শনিক সৌন্দর্য। কিন্তু এই মতবাদই এক দিন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। ১৯৬০ সালে নিউ জার্সির বেল ল্যাবরেটরি বসাল মহাজাগতিক বিকিরণ মাপার এক সূক্ষ্ম অ্যান্টেনা। আর্নো অ্যালান পেনজিয়াস ও রবার্ট উড্র উইলসন অ্যান্টেনায় ধরা পড়া তথ্যে লক্ষ করলেন এক অদ্ভুত ব্যাপার— আকাশের যে কোনও দিক থেকেই এক ক্ষীণ বিকিরণ আসছে। যেন গোটা ব্রহ্মাণ্ডই নিবিষ্ট মনে বিকিরণ ছড়াচ্ছে। কিন্তু ওই বিকিরণের তাপমান খুবই কম। পেনজিয়াস ও উইলসনের প্রথমে মনে হয়েছিল হয়তো অ্যান্টেনায় কোনও ত্রুটি রয়েছে, বা পায়রার বর্জ্যের কারণেই অ্যান্টেনায় ঠিক তথ্য ধরা পড়ছে না।
পেনজিয়াস ও উইলসন কিছু দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন যে, তাঁরা আসলে এক ঐতিহাসিক আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে এক বিরাট অকল্পনীয় বিস্ফোরণে, এবং তাঁদের অ্যান্টেনায় যে বিকিরণ ধরা পড়েছিল, তা আসলে ব্রহ্মাণ্ডের আদিম বিকিরণ। এ হল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদিম মুহূর্তের সুর, মহাজাগতিক বিকিরণের ভৈরবী। এই আদিম বিকিরণ আজও ধরা দিচ্ছে বিভিন্ন গবেষণায়। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাসের বিচিত্র গল্প, সৃষ্টি ও ধ্বংসের অজস্র রহস্য। আবিষ্কৃত হল বিগ ব্যাং।
এর পরেই প্রশ্ন ওঠে, বিগ ব্যাং হল কেন? বিগ ব্যাং-এর আগেই বা কী ছিল? ২০২০ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী রজার পেনরোজ় এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো পেয়েছেন। ওঁর মতে, আমাদের আজকের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অনেক অনন্ত যুগের মধ্যে একটি। এই এক-একটি অনন্ত যুগকে বলা হয় ‘ইয়ন’। বর্তমান ব্রহ্মাণ্ডের ইয়নও এক দিন শেষ হবে। আবারও নতুন করে শুরু হবে এক ব্রহ্মাণ্ড, আরও এক নতুন ইয়ন। আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের যুগ শুরু হয়েছিল ১,৪০০ কোটি বছর আগে। এই অনন্ত যুগ বাস্তবে অনন্ত নয়। ব্রহ্মাণ্ডের জীবনেরও শুরু আছে, শেষ আছে। অনেকটা মানুষের জীবনের মতো। তবে সময়ের পরিধি একেবারেই ভিন্ন। মানুষের জীবন ১০০ বছরের মতো। ব্রহ্মাণ্ডের জীবন তিন-পাঁচ হাজার কোটি বছর।
ফিরে যাওয়া যাক রজার পেনরোজ়ের চিন্তাধারায়। আমাদের বর্তমান ব্রহ্মাণ্ডের যুগের আগে আরও একটি ব্রহ্মাণ্ড ছিল। সেই ব্রহ্মাণ্ড আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের মতোই প্রসারিত হচ্ছিল। সময়ের সঙ্গে প্রসারিত হতে হতে সেই ব্রহ্মাণ্ড একটি নিজস্ব শ্মশানে পরিণত হল। ধীরে ধীরে সমস্ত তারা নিবে গেল। তাদের পারমাণবিক জ্বালানি শেষ হল। তখন কোনও কিছুই নেই আকাশে। সব শেষ। ব্ল্যাক হোলগুলোর তাপমানও তখন ব্রহ্মাণ্ডের তাপমানের চেয়ে বেশি। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী তখন কোটি কোটি ব্ল্যাক হোল ফেটে পড়তে শুরু করল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সব ক’টা ব্ল্যাক হোল ফেটে উৎপন্ন হল প্রচুর পরিমাণে শক্তি। এই শক্তিই আরও এক নতুন ইয়ন বা যুগ সৃষ্টির শক্তি জোগালো। এক ইয়ন থেকে আর এক ইয়নে যাওয়ার মাঝেই ঘটল বিগ ব্যাং। ফের নতুন করে সৃষ্টি হল ব্রহ্মাণ্ডের। অঙ্ক কষে এই ঘটনারই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন রজার পেনরোজ়। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী আগের যে ইয়ন, সেখানে দুই বিশালাকার ব্ল্যাক হোলের সংঘর্ষ ঘটেছিল, যার ছাপ ও ছবি ফুটে উঠবে এখনকার ইয়নে। এ ছাড়াও এক অনন্ত যুগ শেষ হয়ে যে আর এক অনন্ত যুগ শুরু হয়েছে, তার অস্তিত্ব ধরা পড়বে আজকের মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন মহাজাগতিক ইঙ্গিতে।
আগের যুগের ধ্বংসস্তূপ থেকেই নতুন যুগের সৃষ্টি— এই হল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মূল কথা। আমরা ভাগ্যবান যে, সৃষ্টি-ধ্বংসের এই খেলার রহস্য যে সময়টা উন্মোচিত হচ্ছে তার সাক্ষী থাকতে পারছি আমরা। রজার পেনরোজ় একটি আন্তর্জাতিক আলোচনাসভায় যোগ দিতে ২০২২-এর জানুয়ারিতে কলকাতা আসছেন। আশা করা যায়, ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্যের আরও নতুন দিক সম্পর্কে আমাদের শহর জানতে পারবে তাঁর মুখ থেকেই।
ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার, কলকাতা