বর্ণাশ্রমের শাসন অটুট
100 days work

কর্মসংস্থান যোজনায় বরাদ্দ কমে কেন, মূল প্রশ্ন সেটা নয়

যে দল মনুবাদী ভাবনায় রাষ্ট্রের সব পরিসরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সেই দল দেশ শাসন করবে কেন?

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:৫৬
Share:

একশো দিনের কাজের প্রকল্পে সটান পঁচিশ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কমিয়ে দিলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। গত বাজেটে বরাদ্দ করেছিলেন ৭২,০০০ কোটি টাকা, তার পর ডিসেম্বর মাসে আরও ২৫,০০০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। এক বছরে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে দশ শতাংশের বেশি। গত দু’বছরে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ হাত পেতেছেন কর্মসংস্থান যোজনার কাছে— অতিমারি-পীড়িত বাজার যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এই প্রকল্পের খুদকুঁড়োয় হাঁড়ি চড়েছে বহু মানুষের ঘরে। সবটুকুর সাক্ষী থাকার পরও অর্থমন্ত্রী এনআরইজিএ-র বরাদ্দ বেঁধে রাখলেন ঠিক গত বছরের বাজেট বরাদ্দের স্তরেই। ভারতে ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্য নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে উদ্বেগের সুর চড়তে থাকার পরও, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা তলানিতে এসে ঠেকার পরও।

Advertisement

কর্মসংস্থান যোজনার প্রতি নির্মলার ব্যক্তিগত বিরাগ আছে, এমনটা ভাবার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। অনেকেরই মনে পড়বে, প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, তিনি কর্মসংস্থান যোজনাকে বাঁচিয়ে রাখবেন শুধুমাত্র কংগ্রেসের পর্বতপ্রমাণ ভুলের স্মারক হিসাবেই। শুধুই কংগ্রেস-বিদ্বেষ, না কি ‘ট্রিকল ডাউন’ অর্থনীতি নামক ধারণাটির প্রতি আনুগত্যও, যে ধারণা বলে— কারও জন্যই আলাদা করে কিছু করার প্রয়োজন নেই, শুধু আর্থিক বৃদ্ধির ব্যবস্থা করলেই চলবে, তার থেকেই সমৃদ্ধি চুইয়ে নামবে গরিবের ঘরে? ধনতন্ত্রের প্রতি নরেন্দ্র মোদী কতখানি বিশ্বস্ত, আপাতত সেই প্রশ্নে ঢুকব না— বিশ্বস্ত থাকার কোনও কারণ নেই, বস্তুত উপায়ও নেই, কারণ নাগপুরে ধনতন্ত্রের চর্চা হয় না; কিন্তু, দু’এক জন পুঁজিপতিকে দেশের সব সম্পদ পাইয়ে দেওয়ার যে সাঙাততন্ত্র তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার স্বার্থরক্ষায় ট্রিকল ডাউনের নামসঙ্কীর্তন বিলক্ষণ কার্যকর।

কিন্তু, কর্মসংস্থান যোজনার বিরুদ্ধে বিজেপির এই জেহাদ শুধুমাত্র সাঙাততন্ত্রের স্বার্থরক্ষার্থেই, এ কথা বললে খণ্ডদর্শন হবে। এই বিরাগের শিকড় আরও গভীরে— নাগপুরের বিশ্বাস-কাঠামোর একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। বর্ণাশ্রমে। গরিব মাত্রেই নিম্নবর্ণের মানুষ, এমন বললে ‘ইকনমিকালি উইকার সেকশন’-এর ধ্বজাধারীরা হয়তো রাগ করে দু’মুঠো ভাত বেশি খাবেন, কিন্তু ভারতের গ্রাম-গ্রামান্তর সাক্ষী দেবে, দিনমজুরির টাকাটুকুর জন্য যাঁরা জব কার্ড করান, পঞ্চায়েত অফিসে কাজের জন্য গিয়ে দাঁড়ান, তাঁদের প্রায় সবাই নিম্নবর্ণের মানুষ। মনুবাদী সমাজে তাঁদের ‘বসিয়ে খাওয়ানো’র বিধান নেই। তাঁদের জন্য কাজ নির্দিষ্ট— তাঁরা উচ্চবর্ণের জন্য কায়িক শ্রম করবেন; বর্ণহিন্দুরা যে কাজ করতে ঘৃণা করেন, তাঁরা সেই কাজ করবেন, এবং, প্রতিদানে তাঁদের কায়ক্লেশে বেঁচে থাকার সংস্থান হবে। সেই বেঁচে থাকার গায়ে প্রত্যহ লাগবে অপমানের ধুলোবালি, অত্যাচারের দাগ। এবং, এই ব্যবস্থাই ধরে রাখবে হিন্দু ভারতীয় সমাজকে।

Advertisement

বর্ণাশ্রমের প্রতি অখণ্ড আস্থা নরেন্দ্র মোদীর নিজস্ব অর্জন নয়। নাগপুরের সর্বোত্তম তাত্ত্বিক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর তাঁর বাঞ্চ অব থটস-এ লিখেছিলেন, “বর্ণব্যবস্থা সমাজের অগ্রগতির ক্ষতি করেছে, অথবা ঐক্য নষ্ট করেছে, এমন কোনও উদাহরণ কোথাও নেই। সত্যি বলতে, এই বর্ণাশ্রম সমাজের বন্ধন দৃঢ় করার ক্ষেত্রে মস্ত ভূমিকা পালন করেছে।” সমাজকে তাঁরা যেখান থেকে দেখেন, যে দৃষ্টিতে দেখেন, তাতে এই কথাটাকে মিথ্যে বলার কোনও উপায় নেই। উচ্চবর্ণের সমাজে নিম্নবর্ণের মানুষরা শুধু উচ্চবর্ণের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই থাকবেন, এবং সেই কাজটা সম্পন্ন হলেই সমাজের সংহতিও বজায় থাকে— এ তো সহজ যুক্তি।

কিন্তু, কর্মসংস্থান যোজনা যে ‘বসিয়ে খাওয়ানো’র ব্যবস্থা নয়, তা নিয়ে তো তর্ক থাকতে পারে না। এই প্রকল্পে মানুষ কায়িক শ্রম করবেন, তার বিনিময়ে মজুরি পাবেন— সেই কায়িক শ্রম, যুগযুগান্ত ধরে নিম্নবর্ণের মানুষই যা করে এসেছেন। তা হলে নাগপুরের মনুবাদী মন এই যোজনাকে মানতে পারে না কেন? পারে না, তার কারণ কর্মসংস্থান যোজনা সেই শ্রমের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছে। উচ্চবর্ণের দ্বারা নিযুক্ত হয়ে নয়, অথবা (মূলত উচ্চবর্ণ-নিয়ন্ত্রিত) কোনও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন অনুসারে নয়, কর্মসংস্থান যোজনায় শ্রম এই নিম্নবর্ণের শ্রমিকের চাহিদা তথা প্রয়োজনের অনুসারী। তাঁর মজুরির প্রয়োজন হলে, তিনি কাজের চাহিদা জানালেই রাষ্ট্র তাঁকে কাজ দিতে বাধ্য— উচ্চবর্ণের, অথবা পুঁজিপতির, সেই শ্রমের প্রয়োজন থাকুক আর না-ই থাকুক। মূল গোলমালটা এখানেই— কর্মসংস্থান যোজনায় শ্রমিকের নিযুক্তি এবং উপার্জনের ক্ষমতা তাঁর স্বায়ত্ত, উচ্চবর্ণের প্রয়োজন, ইচ্ছা অথবা কৃপার উপর নির্ভরশীল নয়। এমন অধিকারের ধারণাকে মানতে মনুবাদীদের সমস্যা হবে বইকি।

সচেতন ভাবে বর্ণাশ্রমের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেই নরেন্দ্র মোদীরা কর্মসংস্থান যোজনার বিরোধিতা করেন, এটা বললে সম্ভবত তাঁদের মনন ও দার্শনিক সচেতনতাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। বর্ণাশ্রম বস্তুটা আসলে একটা দেখার চোখ তৈরি করে দেয়— কোনটা ‘আমাদের’ জায়গা, আর কোনটা ‘ওদের’, কার্যত জন্মসূত্রে শিখে নেওয়া যায়। এবং, কোন জন ‘আমরা’, আর কোন জন ‘ওরা’, সেটা বুঝে নেওয়ার উপরই নির্ভর করে পারস্পরিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। ‘উচ্চবর্ণ’ মন যখন শ্রমিককে দেখে, সে দেখা যে আসলে ‘ওদের’ দেখছে, ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে তা নিয়ে সংশয় থাকার কথা নয়। স্পষ্ট করে বলে রাখা ভাল যে, নিম্নবর্ণ আর শ্রমিককে এক করে ফেলছি না, শ্রেণির প্রশ্নকে শুধুমাত্র জাতপাতের প্রশ্ন হিসাবেও দেখছি না; কিন্তু, ভারতের পরিপ্রেক্ষিত যে সেই প্রশ্ন দুটোকে বারে বারেই এক সূত্রে জড়িয়ে দেয়, সে কথা তো অনস্বীকার্য। কাজেই, এনআরইজিএ-র বিরুদ্ধে এই গৈরিক জেহাদের কত অংশ নিম্নবর্ণের প্রতি, আর ক’আনা শ্রমিকের প্রতি, সেই হিসাব করা কঠিন। অপ্রয়োজনীয়ও বটে।

নিম্নবর্ণ অথবা শ্রমিকের গুরুত্ব ঠিক ততখানিই, যতখানি উচ্চবর্ণের অথবা শিল্পবাণিজ্যের পরিচালকের প্রয়োজন। স্বাধীন দেশে, সংরক্ষণ ব্যবস্থার মধ্যাহ্নেও এই কথাটি বহুলাংশে সত্য ছিল এনআরইজিএ তৈরি হওয়ার আগে অবধি। এমনটা দাবি করার প্রশ্নই নেই যে, এই যোজনা তৈরি হতেই সম্পূর্ণ পাল্টে গেল সামাজিক সমীকরণ। এক ঘায়ে সমাজের অচলায়তন ভাঙতে পারে, কোনও আইনের তেমন সাধ্য কী? কিন্তু, সামাজিক সিঁড়ির উপরের ধাপে থাকা মানুষের প্রয়োজনেই শ্রমের একমাত্র গুরুত্ব— এই অবস্থানটির বিরুদ্ধে প্রথম এবং একমাত্র সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জ একশো দিনের কাজ প্রকল্পই। এ বার প্রশ্ন হল, এই চ্যালেঞ্জটির মোকাবিলায় এমন অর্ধেক শক্তি প্রয়োগ করেন কেন নরেন্দ্র মোদীরা? এক ধাক্কায় বাতিল করে দিলেই তো হয়। এনআরইজিএ-কে তাঁরা বাঁচিয়ে রাখেন কেন? শুধুই প্রবল জনরোষের ভয়ে? দেশের গ্রামাঞ্চলে বিপুল বিক্ষোভ তৈরি হবে, সেই আশঙ্কায়?

নির্বাচনী গণতন্ত্রে শাসকদের তেমন আশঙ্কা নেই, তা হতে পারে না। কিন্তু, সেটাই সম্ভবত একমাত্র কারণ নয়। ব্যক্তি শ্রমিক বাঁচুক কি মরুক, তাতে তাঁদের কিছু না-ই যেতে-আসতে পারে, কিন্তু সমষ্টিগত ভাবে শ্রমিক না থাকলে, নিম্নবর্ণ না থাকলে ভারী মুশকিল। কারণ, উৎপাদন চালিয়ে যেতে শ্রমশক্তিটুকু প্রয়োজন। সমস্যা হল, শ্রমশক্তি চাইলে গোটা শ্রমিককেই বাঁচিয়ে রাখতে হয়। বাঁচিয়ে রাখতে হয় তাঁদেরও, যাঁরা এই মুহূর্তে প্রত্যক্ষ ভাবে শ্রমিক নন, কিন্তু শ্রমিকের প্রবাহ বজায় রাখেন। যত চাই, তত শ্রমিক পাওয়া যাবে, এই ব্যবস্থা আছে বলেই তো মজুরির হার বাড়াতে হয় না তেমন। নরেন্দ্র মোদীরা জানেন, ধুঁকতে থাকা এনআরইজিএ এই মানুষগুলোকে ধুঁকতে ধুঁকতে হলেও বেঁচে থাকতে দেবে। এমন ভাবে, যাতে প্রয়োজন পড়লেই তাঁদের শ্রমশক্তিটুকু আহরণ করে নেওয়া যায়।

নির্মলা সীতারামন তাঁর বাজেটে এনআরইজিএ-র বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছেন বলে অনেকেই ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষোভের পবিত্র আগুনে নাগপুরের মনুবাদী মন পুড়ে খাঁটি সোনা হবে, তেমন আশা অবশ্য না করাই ভাল। বিজেপি এ ভাবেই কর্মসংস্থান যোজনাকে দেখবে— এই দেখার চোখ তাদের ডিএনএ-র অন্তর্গত। ভাবার বিষয় হল, এনআরইজিএ-র বরাদ্দ কমানো হল কেন, আমরা এই প্রশ্নেই আটকে থাকব, না কি কয়েক ধাপ এগিয়ে প্রশ্ন করব, যে দল মনুবাদী ভাবনায় রাষ্ট্রের সব পরিসরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সেই দল দেশ শাসন করবে কেন?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement