নবপ্রতিমা: সুপ্রিম কোর্টে ন্যায়ের দেবীর নতুন রূপ। অক্টোবর, ২০২৪। ছবি: পিটিআই।
সম্প্রতি ভারতীয় আইনব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত করার একটা সংহত প্রয়াস চোখে পড়ছে। ব্রিটিশ অপরাধ সংক্রান্ত আইনগুলোর মধ্যে যে উনিশ শতকীয় অবশেষ ছিল, নতুন ক্রিমিনাল কোড এনে কী ভাবে তার বদল ঘটানো হচ্ছে, আমরা দেখছি। অনেক বিশেষজ্ঞ হয়তো এই যুক্তি দেবেন যে, নতুন আইনগুলি আর কিছুই নয়, যে আইনশাস্ত্র চালু আছে, তারই ঘষামাজা করা অন্য রূপ। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা চলে না, ইন্ডিয়ান পিনাল কোড-কে ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’ নামকরণ করে দুটো উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার যে বৃহত্তর রাজনৈতিক বয়ানের সমর্থক ও প্রচারক, এই ভাষাগত ‘রিব্র্যান্ডিং’ যে তারই অনুসারী— এটা স্পষ্ট। অবশ্য এর চেয়ে সূক্ষ্ম এবং দৃষ্টান্তমূলক একটা পরিবর্তনও ঘটে গেছে, যেটা আমাদের নজর করা দরকার। ‘পিনাল’ কোড-এর বদলে নতুন ‘সংহিতা’র আগমন ঘটেছে বহিরঙ্গে ‘ন্যায়’-এর ধারণাটি নিশ্চিত করতে। অন্য ভাবে বললে— আইনের উদ্দেশ্য যা, তাকে কঠিন কঠোর ও দমনমূলক না দেখিয়ে বরং তাকে সংস্কারমূলক, ন্যায়পরায়ণতা-কেন্দ্রিক করে তোলার একটা সচেতন প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। নামকরণের এই পরিবর্তন আইনব্যবস্থায় ঠিক কতটা প্রতিফলিত হবে তা অবশ্য অন্য পর্যালোচনা দাবি করে।
‘ন্যায়’-এর ধারণা এলে পাশাপাশি বলতে হয় ‘নীতি’-র কথাও। সুপ্রিম কোর্টের বিদায়ী প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় সম্প্রতি শীর্ষ আদালতে বিচারপতিদের গ্রন্থাগারে ‘ন্যায়বিচারের দেবী’র নতুন মূর্তি উদ্বোধন করলেন, সেখানেও এই দুইয়ের প্রসঙ্গ ছায়া ফেলল। ঐতিহ্যগত ভাবে যে দেবীর দু’চোখ বাঁধা, হাতে তরবারি, নতুন মূর্তির সেখানে দু’চোখ খোলা, হাতে তরবারির পরিবর্তে ভারতের সংবিধান— প্রধান বিচারপতির মতে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থা যে সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারের প্রতি দায়বদ্ধ ও সমদর্শী, তা বোঝাতে। আবার ন্যায়বিচার দানের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও একটা পরিবর্তন আনা হচ্ছে, শাস্তি দেওয়ার বদলে বোঝানো হচ্ছে সংস্কার করার কথা। ন্যায়ের দেবীর হাতে তরবারির বদলে সংবিধান তুলে দেওয়ার এই পরিবর্তন তাই সমর্থন না করে উপায় নেই, এমনকি ঐতিহ্যের প্রশ্নটি মাথায় রেখেও।
ন্যায়ের দেবীর প্রাচীন যে চিত্র, তা এসেছে গ্রিক ও রোমান সভ্যতা থেকে। ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়ের বাসিন্দা, গ্রিক কবি হেসিয়োডের লেখায় পাওয়া যায় থেমিসের কথা। গিয়া ও ইউরেনাসের বারো জন টাইটান-সন্ততির অন্যতম হলেন থেমিস— ন্যায়বিচার, জ্ঞান ও সুমন্ত্রণার দেবী তিনি। তাঁরই দু’হাতে শোভা পায় তুলাদণ্ড ও তরবারি। প্রথম রোমান সম্রাট অগাস্টাস (২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-১৪ খ্রিস্টাব্দ) ন্যায়ের দেবীর আরাধনা চালু করেন, সেই দেবীর নাম ছিল জাস্টিসিয়া (বা ইয়ুস্টিসিয়া)— থেমিসের মতোই তাঁরও কিন্তু চোখ বাঁধা ছিল না। চোখ বাঁধা থাকার ধারণাটি চালু হয় রেনেসাঁসের সময়, পঞ্চদশ শতকে: জার্মান রেনেসাঁস-শিল্পী আলব্রেখট ডুরারের করা, ‘দ্য ফুল ব্লাইন্ডফোল্ডিং জাস্টিস’ নামের একটি উডকাটে দেখানো হয়, ‘ফুল’ বা বিদূষক গোছের চরিত্রটি ন্যায়ের দেবীর মতো দেখতে এক নারীর চোখ বেঁধে দিচ্ছে— যাঁর এক হাতে তুলাদণ্ড, অন্য হাতে তরবারি। স্পষ্টতই চোখ বাঁধার অর্থ এখানে নৈর্ব্যক্তিকতা নয়, বরং তা এক প্রকার উপহাস: আইনব্যবস্থায় দুর্নীতি দেখেও বিচারব্যবস্থা অন্ধ হয়ে আছে, এই ব্যঙ্গ। ‘এনলাইটনমেন্ট’ বা আলোকপ্রাপ্তির যুগে, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে ন্যায়ের দেবীর চোখের আবরণকে ব্যাখ্যা করা শুরু হল পক্ষপাতহীনতার আলোয়। সম্পদ, ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা-নির্বিশেষে ন্যায়বিচার যে সকলের প্রতি নিষ্পক্ষ, সেই অর্থটি সেই থেকে প্রচার পেতে শুরু করে। ন্যায়ের দেবীর মূর্তিতত্ত্ব ও রূপকল্প থেমে থাকেনি, এ ভাবেই যুগে যুগে পাল্টেছে।
সংবিধান-উত্তর কালে বিচার সংক্রান্ত সমস্যা নিষ্পত্তির সামগ্রিক সুরটি খেয়াল করলে, এক জমানা থেকে অন্য জমানায় বিচারব্যবস্থার এমনই নানা রূপ-রূপান্তর চোখে পড়বে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক জুড়ে অধিকাংশ সময়েই সমস্যা নিষ্পত্তির সময় বিচারব্যবস্থা আইনের প্রতিটি অক্ষরের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ থাকত। এই মানসিকতার একটা বড় উদাহরণ ‘এ কে গোপালন বনাম স্টেট অব ম্যাড্রাস’ মামলা, সেখানে সুপ্রিম কোর্টের সিংহভাগ বিচারপতিই এই ধারণা পোষণ করেছিলেন যে, সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদে নাগরিকের জীবন বা ব্যক্তিস্বাধীনতার যে অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা আছে, ‘আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোনও প্রক্রিয়া’ তা থেকে কোনও মানুষকে বঞ্চিত করলেও সেই প্রক্রিয়াটির ন্যায্য, নীতিসঙ্গত ও যৌক্তিক হয়ে ওঠার বাধ্যবাধকতা নেই। আইনের আক্ষরিক পাঠ অনুসরণ করলে এই সীমাবদ্ধতা মেনেই কাজ করতে হয়— এই দিকটি দেখিয়ে মাননীয় বিচারপতিরা কোনও অতিরিক্ত উপাদান আমদানি করতে সম্মত হননি, কারণ তাঁদের মতে তা হয়ে দাঁড়াত সংবিধান-বহির্ভূত প্রক্ষেপ।
কিন্তু এই একই সুপ্রিম কোর্টে সত্তরের দশকে আমূল পরিবর্তন এল, বিশেষ করে ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থার পরে। ‘মেনকা গান্ধী বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ এবং তার পরবর্তী কয়েকটি মামলায়— যেগুলির রায় প্রধানত দিয়েছিলেন বিচারপতি পি এন ভগবতী— আদালত গোপালন মামলার পর্যবেক্ষণের উল্টো পথে হাঁটল। অন্তর্ভুক্ত করল ‘আমেরিকান ডিউ প্রসেস’ তত্ত্বকে— এ কথাই জোর দিয়ে বলতে যে, সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদে বলা অধিকারগুলি থেকে কোনও নাগরিককে বঞ্চিত করার কাজে ব্যবহার হলে আইন ও তার প্রক্রিয়া উভয়কেই স্বাধীন ভাবে উত্তীর্ণ হতে হবে ন্যায্যতা, সততা ও যৌক্তিকতার পরীক্ষায়। এই সময়েই সুপ্রিম কোর্ট বিচারপ্রক্রিয়ায় সম অধিকার নিশ্চিত করার কাজেও আগের সব বাধা ঝেড়ে তৎপর হয়ে ওঠে। শুধু ক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষই বিচার পেতে আদালতে যেতে পারবে, এই ‘লোকাস স্ট্যান্ডাই’ তত্ত্বের ভার হালকা করে তৈরি করে জনস্বার্থ মামলার (পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন) মতো হাতিয়ারকে। একই ভাবে, ১৯৭৩ সাল থেকে সংবিধান সংশোধনীর বৈধতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থা নিয়মিত ভাবে তারই আর এক অভূতপূর্ব সৃষ্টি ‘বেসিক স্ট্রাকচার’ তত্ত্বের প্রয়োগ করে আসছে, যদিও ৩৬৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের তাত্ত্বিক ক্ষমতাটি ন্যস্ত সংসদের হাতেই।
আত্মসমীক্ষণ ও একই সঙ্গে সক্রিয় অংশগ্রহণ— এই দু’দিকেই জোর দেওয়ার প্রবণতা বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে গত তিন দশকে, যদিও বিস্তর বিতর্কও সঙ্গী হয়েছে এই পথে। ১৪২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টকে যে ‘পূর্ণ ন্যায়বিচার’-এর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার প্রয়োগ করতে গিয়ে শীর্ষ আদালত প্রায় এক ‘এগজ়িকিউটিভ কোর্ট’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে— যে কাজ ও দায়িত্বগুলো আসলে সরকার তথা প্রশাসনের করার কথা, সেগুলো পালন করতে হচ্ছে শীর্ষ আদালতকেই। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সাংবিধানিক আদালতগুলির কাজ কেবল আইনের ব্যাখ্যাদানেই সীমাবদ্ধ নয়, আইনকে প্রয়োজনে বারংবার পাল্টানোর কাজটিও তাদের হাতে নিতে হচ্ছে প্রায়ই। অতিমাত্রায় রাজনৈতিক এমন প্রশ্নগুলি নিয়ে সিদ্ধান্তের পরিসরে অতীতে তারা সচেতন ভাবে ঢুকতে চাইত না, কিন্তু এখন আর তা হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে এমনও দেখা যাচ্ছে যে শুধু সংবিধান ও আইনের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হচ্ছে না; প্রতিবন্ধকতা দূর করতে দরকার পড়ছে দৈবী প্রেরণারও— সম্প্রতি যেমনটা জানা গেল।
ন্যায়বিচারের দেবীর চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া, তরবারির বদলে সংবিধান হাতে ধরিয়ে দেওয়া— এ সব বড় কথা নয়। ন্যায়ের তুলাদণ্ডে ঠিক যেমনটি দরকার তেমনই যেন ভারসাম্য থাকে, তা নিশ্চিত করাটাই আসল কথা। প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে যেন ন্যায্যতা, নিরপেক্ষতা ও বিচারের নীতি নিশ্চিত করা হয়— সেটাই জরুরি।