যুদ্ধ? ফিরহাদ হাকিমকে গ্রেফতার করতে হাজির বিপুল কেন্দ্রীয় বাহিনী। ১৭ মে, সোমবার।
ঘটল যা, তা খুব অভাবিত ছিল কি? আমার মতে, ছিল না। বাঘের আগে যেমন ফেউ ছোটে, গানের আগে বাজে আবহ, তেমনই এই রকম কোনও একটি পরিস্থিতি তৈরি করার সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল বিজেপি ভোটে হারার দিন থেকেই। ঠিক কবে, কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে, কী প্রক্রিয়ায় এই ধরনের কোনও পদক্ষেপ করা হবে, সেটা অবশ্য আগাম বোঝা যায়নি। তবে বাজনদারেরা সুর সেধে যাচ্ছিলেন। তাতেই বড় কিছু একটা ঘটার আঁচ মিলছিল। আপাতত ‘নারদ’-এ প্রথম ঝঙ্কার তোলা হল। এমন আরও হলেও বিস্ময়ের কিছু নেই।
কিন্তু এ কোথায় চলেছি আমরা! যত দেখছি, ততই স্তম্ভিত হতে হচ্ছে। লজ্জা, ঘৃণা বলে আর বোধ হয় কিছু রইল না। রাজনীতি আরও কত নীচে নামবে? কোভিডের এই কঠিন দুর্দিনেও কাদা খুঁচিয়ে তুলতে ব্যস্ত কিছু লোকের চক্ষুলজ্জারহিত কাজকর্মে এ বার সেই প্রশ্ন উঠছে। জানতে ইচ্ছে করছে, পরাজয় থেকে শিক্ষা নেওয়ার অধ্যায়টি কি তাঁদের সিলেবাসের বাইরে? এটাও কিন্তু শিক্ষার অঙ্গ।
সবাই বোঝেন, জনতার রায়ে বিজেপির স্বপ্নসৌধ খানখান হওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই তারা খিড়কি দিয়ে সিংহাসনে পৌঁছনোর বিকল্প ছক কষতে নেমেছে। তাতে এখনই হাতেগরম সবটা পাওয়া না-গেলেও সদ্য নির্বাচিত সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা এই কৌশলের অন্যতম অঙ্গ। যার মূল নির্মাণ চলছে দিল্লিতে। এখানে শুধু প্রয়োগ।
ভোট-পরবর্তী এই সব ছকের রাজনীতিতে রাজ্যপাল নামক পদাধিকারীকে আগুয়ান ভূমিকায় দেখে অবশ্য আজ আর তেমন অবাক লাগে না। কারণ গত দু’বছরে তাঁকে বোধ হয় ‘চিনে’ ফেলা গিয়েছে। ‘নিরপেক্ষ’ জামা পরা রাজ্যপাল পদটির গায়ে কী ভাবে ক্লেদ পুরু হচ্ছে, তা-ও বহুচর্চিত।
মুখ্যমন্ত্রী পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথের দিন থেকে ধাপে ধাপে গোটা পরিস্থিতি কী ভাবে পাকিয়ে তোলা হল, তা-ও আজ অজানা নয়। শপথের আগের রাতেই আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তোলা হয়েছিল। শপথের অনুষ্ঠানে একই বিষয়ে রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী মতান্তর বিরল নজির তৈরি করে। পর দিনই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিনিধি দল পাঠানো দিয়ে ‘আসল’ কার্যক্রম শুরু। তার পর কোভিড-পরিস্থিতির মধ্যে ‘সন্ত্রাস’ দেখতে রাজ্যপালের জেলা-সফর।
সবই যেন সুতোয় গাঁথা। আর সবচেয়ে দৃষ্টিকটু হল, দু’দফার ওই জেলা সফরে রাজ্যপালের বিজেপি-নির্ভরতা। যিনি রাজ্যের ‘পালক’, তাঁর বিচারে হত-আহত-আক্রান্ত শুধুই বিজেপির লোক। বাকি কারও গায়ে একটি আঁচড়ও নাকি লাগেনি! এর পরেও কি আর কিছু বলার বাকি থাকে?
কিন্তু ব্যক্তি জগদীপ ধনখড় এ ক্ষেত্রে আলোচনার প্রসঙ্গ নন। বরং যেটা বলার, তা হল, রাজ্যপাল নামধারীরা ক্রমশই কেমন যেন ‘বেচারা’ হয়ে উঠছেন। পদের গরিমা তাঁদের ত্যাগ করেছে আগেই। যত দিন যাচ্ছে, ততই অবনমন ঘটতে ঘটতে রাজ্যপালেরা অনেকে তাঁদের কার্যকলাপের দরুন সর্বদা এক জন সাধারণ রাজনীতির কারবারির মতো নিন্দা-মন্দ, কটুবাক্যের শিকার হয়ে পড়ছেন। এই রাজ্যের রাজ্যপাল সেখানেও সামনের সারিতে! মান-মর্যাদা সব জলাঞ্জলি।
দিনের শেষে এ সব তাঁদের কত জনকে পীড়িত করে, বা আদৌ তা করে কি না, জানা নেই। তবে ‘গদি’ রাখার স্বার্থে তাঁদের নিয়োগকর্তা প্রভুদের ইচ্ছাপূরণের দায় মেটাতে গিয়ে রাজ্যপালদের অবস্থা বড়ই করুণ। তথাপি পদ বড় মোহের বস্তু! তাই তাঁরাও যেন ‘ব্যবহৃত’ হতে সদাপ্রস্তুত!
সে ভাবেই বঙ্গের রাজ্যপাল এখনকার খেলাতে বিজেপির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজি! কারণ তিনি পদের সুবাদে যেমন ‘নিরপেক্ষ’ এবং ‘সংবিধান অনুসারী’ বলে স্বীকৃত, তেমনই রাজ্যপাল পদটির কিছু অধিকারও রয়েছে। যার জোরে তাঁকে দিয়ে প্রয়োজনমতো ‘কাজ করিয়ে নেওয়া’ সহজ। তাই রাজ্যপালকে সামনে রাখা কেন্দ্রের শাসক বিজেপির পক্ষে সব দিক থেকেই সুবিধাজনক।
মমতা যে দিন শপথ নেন, সে দিন রাজভবনে একটি ঘটনার কথা বলি। শপথের পরে মুখ্যমন্ত্রী বেরিয়ে গিয়েছেন। থ্রোন-রুম সংলগ্ন বসার ঘরে রাজ্যপালের সঙ্গে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়ের মতো কয়েক জন হালকা চালে গল্প করছিলেন। আমিও ছিলাম সেখানে। নেতাদের কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের ‘ব্যর্থতা’ ও ‘রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব’ নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছিলেন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। ওঁরাও পাল্টা যুক্তিতে রাজ্যপালকে বলছিলেন, ‘আপনি শুধুই বিজেপির কথা শোনেন এবং সেগুলিই শোনাচ্ছেন।’ রাজ্যপাল তা মানবেন কেন!
এই সময় পাশে বসে থাকা আমার দিকে ডাবের জলের গেলাস এগিয়ে দিতে দিতে ধনখড় বললেন, “একটা কথা জেনে রেখো, কেউ কিন্তু রেহাই পায় না। আজ নয় কাল…।”
হয়তো কাকতালীয়। কিন্তু হঠাৎ জেগে ওঠা নারদ-মামলায় বেছে বেছে রাজ্যের দুই মন্ত্রী ও এক বিধায়কের জেলযাত্রা দেখে কথাগুলি কেমন যেন কানে বাজছে। তখন সত্যিই এ ভাবে মনে হয়নি।
আগেই বলেছি, রাজ্যপাল পদের নিরপেক্ষতার বিষয়ে আলোচনা অর্থহীন। অতীতেও রাজ্যপালেরা আলাদা কোনও ‘চরিত্র’ ছিলেন, তা নয়। তবে চোখের দেখায় রাজভবনের সঙ্গে পার্টি অফিসের একটি ভেদরেখা বজায় থাকত। রাজ্যপালেরা খোলাখুলি দিল্লির ‘বস’দের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে নিজেদের উন্মুক্ত করতেন না। আরও একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, রাজ্যপালদের সঙ্গে সরকারের চরম বিবাদ-সংঘাতে শেষ পর্যন্ত রাজ্যপালদেরই সরে যেতে বা ‘সরিয়ে নিতে’ দেখা গিয়েছে। অন্তত এই রাজ্যের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে একাধিক বার।
যুক্তফ্রন্ট আমলে নির্বাচিত সরকারকে ‘ফেলে’ দেওয়ার কাজে নেমেছিলেন রাজ্যপাল ধর্মবীর। শেষরক্ষা হয়নি। প্রবল বিক্ষোভের মুখে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়। বামফ্রন্ট জমানায় জ্যোতি বসুদের দেওয়া বিশেষণে ‘বাংলা দমন’ পান্ডে বলে অভিহিত রাজ্যপাল ভৈরবদত্ত পান্ডেকেও অল্প সময়ে রাজ্য ছাড়তে হয়েছিল। বছরখানেকের মধ্যে চলে যেতে হয় অনন্তপ্রসাদ শর্মাকে।
এগুলি কয়েকটি উদাহরণমাত্র। আগে হয়েছে বলেই আজ হবে, তেমন কোনও সরলীকরণ ঠিক নয়। বরং ধরে নেওয়া উচিত, দিন বদলায়! আর সেই বদলের যে চেহারা এখন সবার চোখের সামনে ‘রাস্তা জুড়ে উন্নয়ন’-এর মতো দাঁড়িয়ে, তাতেও অনেক কিছু পরিষ্কার।
তবে এত কিছুর পরেও সেই প্রশ্নটি থাকেই। চতুরঙ্গ বাহিনী সাজিয়ে বাংলা দখলে আসা বিজেপির এমন হাল হল কেন? এখন যা যা কিছু ঘটছে বা ক্রমে ‘ঘটানো’ হতে পারে, তার নেপথ্যে তো একটিই যন্ত্রণা— ভোটে হার। জিতলে তো এ সবের দরকারই হত না। দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দ থেকে কলকাতার রাজভবন পর্যন্ত আনন্দের সুনামিতে হাবুডুবু অবস্থা হত। হল কই!
হারের কারণ খুঁজতে গিয়ে বাংলার আরএসএস দেখেছে, নেতৃত্ব এবং জনপ্রিয়তার নিরিখে মমতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার যোগ্য কেউ বিজেপিতে ছিলেন না। তারা ‘মুখ’ তুলে ধরতে ব্যর্থ। ‘বহিরাগত’ তত্ত্বকে কার্যত সিলমোহর দিয়ে সঙ্ঘের মুখপত্র আরও লিখেছে, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা বাংলায় ‘বাঙালিয়ানা’র সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি। ভোটের আগে তৃণমূল ভাঙিয়ে দল ভারী করার রাজনীতিকেও ‘ব্যাড এক্সপেরিমেন্ট’ বলে মনে করেছেন আরএসএসের বিশ্লেষকেরা।
মোদী-শাহেরা বলতেই পারেন, সঙ্ঘের পর্যবেক্ষণ ভুল। তর্ক চলুক। কিন্তু পরাজয়ের পরমুহূর্ত থেকে জয়ীকে পিছন থেকে ছুরি মারার রাজনীতি সাধারণ মানুষ কতটা গ্রহণ করবে?
নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া ব্যবস্থায় ভোট অবাধ হয়নি, এ কথা বলা এ বার মুশকিল। সেই রায়কে ঘুরপথে বানচাল করার চেষ্টাও তাই জনমতের চরম অপমান।
বিপরীত বুদ্ধি বিনাশ ডেকে আনে।