অনেকেই বলেন, বিগত কয়েক দশকে পশ্চিমবঙ্গ তার সমস্ত অতীত গৌরব হারিয়েছে, একটা ‘ফেল্ড স্টেট’ বা ব্যর্থ ‘রাষ্ট্র’-তে পরিণত হয়েছে— একমাত্র বিজেপি ক্ষমতায় এলেই পরিস্থিতি শুধরোবে। কতটা ‘ব্যর্থ’ পশ্চিমবঙ্গ? ২০২১ সালে সাংহাই র্যাঙ্কিং অনুযায়ী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতে প্রথম স্থান অধিকার বা ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১২ থেকে বেড়ে ৪৬ হওয়ায় অনেকে খুব উচ্ছ্বসিত বটে, তবে সেটা সরকারের সাফল্য মাপার আদর্শ মাপকাঠি নয়। উপায় হল তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগে চোখ রাখা। যদিও পশ্চিমবঙ্গের জিডিপি ভারতে ষষ্ঠ (১৪.৭০ লক্ষ কোটি টাকা), কিন্তু জন-ঘনত্বের নিরিখে ও মাথাপিছু জিডিপি অনুযায়ী এ রাজ্যকে দরিদ্রই বলা চলে। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এ রাজ্যে বাজেটের শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়েছে ১২ থেকে ১৭ শতাংশ। একই সময়ে মোট শিক্ষা বাজেটের ৫০ শতাংশ ব্যয় হয়েছে মাধ্যমিক শিক্ষায়। শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেওয়ার খাতে— যেমন ইউনিফর্ম, পাঠ্যপুস্তক বা মিড-ডে মিলেও— ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ব্যয় সর্বাধিক। কন্যাশ্রী প্রকল্পকে রাষ্ট্রপুঞ্জ ২০১৭ সালে দুনিয়ার ৫৫২টি সামাজিক প্রকল্পের মধ্যে ‘শ্রেষ্ঠ’ শিরোপা দিয়েছিল।
তবে এ রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে বহু খামতিও রয়েছে। ২০১৮ সালের প্রতীচী ট্রাস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলায় স্কুলগুলিতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত ২৩:১। ২০ শতাংশ স্কুলে শিক্ষকের ‘তীব্র ঘাটতি’ রয়েছে। এক জন মাত্র শিক্ষক রয়েছেন, এমন স্কুলের সংখ্যা বেড়েছে চার শতাংশ। স্কুল-শিক্ষক নিয়োগের অব্যবস্থাও সর্বজনবিদিত।
চোখ রাখা যাক স্বাস্থ্যে। নির্বাচনী প্রচারের সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কর্মসূচি নিয়ে বিরোধী পক্ষ খুবই রঙ্গরসিকতা করেছিল। কত মানুষ এতে উপকৃত হলেন, তা বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, খড়্গপুরের মতো মহকুমা হাসপাতাল, কয়েক বছর আগেও যা ছিল আবর্জনায় ভরা, আজ তা অপেক্ষাকৃত অনেক পরিচ্ছন্ন। ডাক্তারের সংখ্যাও অপ্রতুল নয়। যদিও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের প্রতিবেদন অনুসারে বাংলায় প্রতি এক লক্ষে সরকারি চিকিৎসক ন’জন, এবং তা অবশ্যই যথেষ্ট নয়। অন্য দিকে, নবজাতকের মৃত্যুর হার বাংলায় সবচেয়ে কম। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মূল সূচকগুলি কেরলের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তবুও সমস্ত অবক্ষয়কে গুনতিতে রেখেও বলা প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গকে ‘ফেল্ড স্টেট’ তকমা দেওয়ার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই।
এর বিপরীতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গত দশ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের পারফরম্যান্স কিন্তু হতাশাব্যঞ্জক। শিক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যয় ২০১৪ থেকে ২০২১-এ কমে দাঁড়িয়েছে জিডিপির ০.৬ থেকে ০.৪৫ শতাংশে। ফলস্বরূপ কেন্দ্র-রাজ্য মিলিত ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে ৩.১৯ থেকে ২.৮৮ শতাংশে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে শিক্ষা বাজেটে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে ১০০০ কোটি টাকা। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে কেন্দ্রীয় ব্যয় জিডিপির মাত্র ০.৬ শতাংশের কাছাকাছি, আমেরিকা ও চিনের ক্ষেত্রে যা যথাক্রমে ২.৮ এবং ২.১ শতাংশ। ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আইআইটি ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বাজেট অনুদান বন্ধ করে দিয়ে একটি উচ্চশিক্ষা তহবিল সংস্থা তৈরি করেছে, যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রতিযোগিতামূলক হারে ঋণ দেবে। আশঙ্কা, অপরিশোধিত ঋণ এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেবে।
একই ভাবে ভারতে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় কেবলমাত্র ১৬০০ টাকার একটু বেশি। স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে ভারতের স্থান ২০০টি দেশের মধ্যে ১৪৪। শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য খরচের জন্য প্রায় চার কোটি লোক দারিদ্র সীমার নীচে চলে যায়। পরিকাঠামোর অভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রায় ভেঙে পড়েছে গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা। বায়োস্ট্যাটিস্টিশিয়ান ভ্রমর মুখোপাধ্যায়-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ যখন দ্বিতীয় তরঙ্গের সম্ভাবনা ও টিকাকরণ সম্পর্কে বারে বারে সতর্ক করেছিলেন, তখনও সরকার কান দেয়নি। ফল যা হওয়ার তাই, দেশ জুড়ে টিকার হাহাকার। এই ব্যাপারে সরকারের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে দেশের অন্যতম অভিজ্ঞ ভাইরোলজিস্ট শাহিদ জামিল কোভিড-১৯ সংক্রান্ত পরামর্শদাতা কমিটি থেকে পদত্যাগও করেছেন। গত বেশ কয়েক বছর ধরে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের এই অবনতির জন্য যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনার অভাব দায়ী, একই ভাবে দায়ী বিজ্ঞান প্রশাসকেরা। সরকার ও শাসক দলের বিজ্ঞান-বিরোধী ভাবনার নিরন্তর প্রচারের বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি এ দেশের বিজ্ঞান প্রশাসকরা।
২০২১-এর নির্বাচনের ফলাফলকে বাঙালির উদার, যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক মননের কাছে অবৈজ্ঞানিক পশ্চাৎমুখী শক্তির পরাজয় বলেই মনে হয়। আমেরিকার নির্বাচনের সময় বিজ্ঞান পত্রিকা নেচার তাদের সম্পাদকীয়তে খোলাখুলি লিখেছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজ্ঞান, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংস করেছেন, জাতীয়তাবাদ, এবং জ়েনোফোবিয়াকে উৎসাহ দিয়েছেন এবং করোনা মহামারিকে আটকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। একই পথে হেঁটেছে ল্যানসেট পত্রিকা। এই মাসের প্রথম সপ্তাহেই তাদের সম্পাদকীয়তে ভারতের বর্তমান অবস্থার জন্য সরাসরি দায়ী করা হয়েছে মোদী সরকারকে। বিহার ও উত্তরপ্রদেশের গঙ্গায় ভেসে আসছে করোনায় মৃত অজস্র শবদেহ। প্রখ্যাত হিন্দি লেখক সূর্যকান্ত ত্রিপাঠি (নিরালা) ১৯১৮ সালের ভয়াবহ স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির বর্ণনায় তার আত্মজীবনী কুল্লি ভাত-এ লিখেছিলেন: “গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে যত দূর চোখ যায়, শুধু ভেসে আছে মানুষের লাশ। খবর এল মারা গিয়েছেন আমার স্ত্রী মনোহরা দেবী... হারিয়েছিলাম পরিবারের অনেককে… মৃতদেহ সৎকারের কাঠও ছিল না কোথাও।” ১০০ বছর বাদেও ইতিহাসের কী পরিহাস। করোনা শান্ত হলে ভারতের বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সমস্ত নাগরিকের জীবন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকারের জন্যও লং মার্চের সময় এসেছে।
ভূতত্ত্ব ও ভূপদার্থ বিভাগ, আইআইটি খড়্গপুর