সাঁওতাল পরগনার এক প্রাচীন দুর্গের উপরে দাঁড়িয়ে ব্যোমকেশ। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
এক গোয়েন্দার শৈশব
গোয়েন্দাদের কোনও শৈশব হয় না। তাদের চেনা যায় যৌবনে। তারা ঈশ্বরপ্রতিম। তারা অমর। কিন্তু ঈশ্বরেরও তো শৈশব থাকে। যিশুখ্রিষ্ট, কৃষ্ণ, হনুমান বা অন্যান্যদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই একটা ‘স্পার্ক’ দেখা গিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মা সরস্বতীর ছোটবেলাটা ‘মোস্ট বোরিং’ আমি নিশ্চিত (ইমোটিকনের হাসি)। তা হলে গোয়েন্দাদের ছোটবেলা নেই কেন? ব্যাটম্যান, সুপারম্যান তাদেরও আছে, অথচ...।
আমি এক প্রখ্যাত গোয়েন্দার শৈশব খুঁজে পেয়েছি। সেটাই বলি।
সাঁওতাল পরগনার এক প্রাচীন দুর্গের উপরে দাঁড়িয়ে ব্যোমকেশ। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী। শেঠ জানকীরামের এই দুর্গের রহস্য কী ভাবে ‘সলভ্ড’ হবে সবাই জানেন। কিন্তু সে দিন কি ওখানে দাঁড়িয়ে ব্যোমকেশের কিছু মনে পড়েছিল?
একটা দুর্গ, তোনা দুর্গ। ‘পাহাড়ি ইঁদুর’ শিবাজি মহারাজের দুর্গ। সেই দুর্গ ছেড়ে একটা ছোট্ট ছেলে পাগড়ি, এক গাছা দড়ি আর একটা ছাগল নিয়ে চলেছে বিপজ্জনক একটা ‘মিশনে’। তার পর সে যা করবে, তা অভাবনীয়। গোটা মরাঠা সাম্রাজ্যকে লিয়াকত খাঁ-র সাত হাজার সৈন্যের থেকে বাঁচাবে তার বুদ্ধি ও সাহসের বলে। সে সদাশিব। যার জন্য ছোট্ট গ্রাম ডোঙ্গরপুরে অপেক্ষা করে থাকে কুঙ্কু, যার ভাল নাম সেবন্তী।
কেউ যদি ভাবেন, আমি বলতে চাইছি সদাশিব আসলে ব্যোমকেশের গতজন্ম, তা হলে বলব, নাহ্। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তেমন কিছু বলেননি। তিনি শুধু দু’টি চরিত্র নির্মাণ করেছেন। আর এক অতি উৎসাহী পাঠক সেটাকে তার নিজস্ব নির্মাণ দিয়েছে। তার কাছে সদাশিব হয়ে উঠেছে ব্যোমকেশের ছোটবেলা। ছোটবেলার আমার সেই ‘হিরো’ সদাশিবের কী হয়েছিল, আমি জানতে পারিনি। কী হয়েছিল সেবন্তীর? বড় হয়ে তারা কী করেছিল? তাই যখন বড় হলাম, তাদের খুঁজে পেলাম ব্যোমকেশ আর সত্যবতীতে।
তবে সদাশিব ব্যোমকেশ বক্সীর ছোটবেলা না তার ছোটবেলার স্বপ্ন, সেটা ব্যোমকেশই ভাল বলতে পারবে। বড় হয়ে এই শহরের লিয়াকত খাঁ-দের খুঁজে বার করে কুপোকাত করতে তাকেও যে সেই বুদ্ধি ও সাহসের উপরই ভরসা করতে হয়েছে। যেমনটা রেখেছিল সদাশিব।
সব তো খোকার জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ার তাগিদ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
এক গোয়েন্দার যৌবন
ব্যোমকেশ বক্সীর চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিল তার সমসাময়িক আর এক গোয়েন্দা। কিরীটি রায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে বৃদ্ধ হল। ব্যোমকেশ বক্সী রইল যুবক। বাঙালি ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে শার্ট-প্যান্ট থেকে জিন্স-টি শার্ট ধরল। হাতে এল স্মার্টফোন। কানে ব্লু-টুথ ইয়ারফোন। কিন্তু ব্যোমকেশ আজও তার ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এই শহরের স্মৃতিতে হেঁটে চলেছে অহরহ। বাড়ি ফিরে সত্যবতীর কাছে চা চেয়ে দু’কথা শুনে নিচ্ছে। কেন শুনে নিচ্ছে? মেয়েটা যে ওই গ্রামে অপেক্ষা করে থাকত একা একা। কী চিন্তাই না করত! ঠিক আছে তো সদাশিব? তার কিছু অনিষ্ট হল না তো? তাই এখনও ব্যোমকেশ এগিয়ে যায় মান ভাঙাতে। তাই প্রতিটি বাঙালি পাঠক আজও তাঁর স্ত্রী-র মান ভাঙান। কারণ, তাঁদের জন্য এঁরা অপেক্ষা করেছেন দুরুদুরু বক্ষে। আসলে আমরা প্রত্যেকেই সদাশিব ছিলাম ছোটবেলায়। আর আমরা ব্যোমকেশ এই যৌবনে।
ভাই গোয়েন্দা গল্পের নায়ক কোথায়? এ তো দেখছি বিবাহিত জীবনের কচড়া। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে আবার গোয়েন্দার ছেলেও এসে যায়। খোকা। গোয়েন্দা সংসার সামলাবে না ক্রাইম? এক দিকে লিয়াকত খাঁ-র সেনা, অন্য দিকে খোকার জন্য বেবিফুডের ব্যবস্থা। বাঙালি তো তাই। তা সে সাহেব তাড়ানোই হোক বা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। সব তো খোকার জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ার তাগিদ। খোকার জন্য যে পৃথিবীটা রেখে যেতে চেয়েছে ব্যোমকেশ, যেখানে সেই ছোট্ট সদাশিবকে রাতের অন্ধকারে একা একা অজানা প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে লিয়াকত খাঁ-র শিবিরে যেতে হবে না। সে কুঙ্কুর সঙ্গে খেলে বেড়াতে পারবে গ্রামের পাঠশালার পাশের মাঠে।
ব্যোমকেশের খোকা কত বড় হল? সে কি নতুন দিনের গোয়েন্দা হল?
বইয়ের দোকানগুলো যে ভাবে এই শহর থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে একে একে, আর ব্যোমকেশ এসে যাচ্ছে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজে, সেখানে অমরত্ব কি ক্লান্তিকর নয়? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
এক গোয়েন্দার বার্ধক্য
তবুও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে...।
অনেকেই রে-রে করে উঠলে বলব, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটা ‘যদিও’। রবীন্দ্রনাথের যা অবস্থা আমার (আমাদের) হাতে পড়ে, ব্যোমকেশ বক্সীর অবস্থাও তথৈবচ। চর্বিতচর্বণ কি শুধুই অমরত্বের লক্ষণ?
তাই, তবুও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে...।
সুকুমার সেনের মতে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ গোয়েন্দা গল্প থেকে উত্তীর্ণ হয়ে উৎকৃষ্ট সাহিত্য হয়ে উঠেছে। যা তার আগে বা পরে আর কোনও চরিত্র হয়েছে বলে মনে হয় না। বাংলা সাহিত্যে তাই ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ’-এর আধিক্য হলেও ব্যোমকেশ রয়ে গিয়েছেন স্বমহিমায়।
তা হলে সন্ধ্যা কেন মন্দ মন্দরে আসছে? বহুপঠন উত্তম সাহিত্যের গুণ। বার বার পড়েও মাথার কাছের বইয়ের স্তূপে যা থেকে যায়। যে কোনও অবসরে উঠে আসে হাতে। কিন্তু বাংলা বইয়ের দোকানগুলো যে ভাবে এই শহর থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে একে একে, আর ব্যোমকেশ এসে যাচ্ছে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজে, সেখানে অমরত্ব কি ক্লান্তিকর নয়? বৃদ্ধ ব্যোমকেশ বক্সী কি বলছেন না, আমায় এ বার একটু ছুটি দাও।
‘সত্যবতী, আজকাল বড়ো ক্লান্ত লাগে...।’
এখানেই আবার সেই বাঙালির ক্লান্তি। নতুন সৃষ্টিতে তার ক্লান্তি এসেছে। কারণ, তার সদাশিবরা হারিয়ে যাচ্ছে। তাই নতুন ব্যোমকেশরাও। তবু খ্যাতির বিড়ম্বনা সত্ত্বেও ব্যোমকেশ আপাতত বাঙালির শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা হয়ে আছে। যদিও সে নিজে চাইছে নতুন কেউ এসে তার জায়গা নিক। কিন্তু বাংলা সাহিত্য কি পারবে তার বার্ধক্যের এই স্বপ্নপূরণ করতে? এমন ধারা চিন্তার গোয়েন্দা আর কোথায় পাব? কেন ব্যোমকেশকে শ্রেষ্ঠ বলব না বলতে পারেন? সে তো রক্তমাংসের একটা মানুষ, স্ত্রী-পুত্র-সংসার জর্জরিত, ভালবাসায় পূর্ণ, অবসাদে ভারাক্রান্ত, আবার মাছে-ভাতে বাঙালি, ধ্রুপদী সাহিত্যপ্রিয় বাঙালি। এমন পূর্ণ বাঙালি গোয়েন্দা আর কোথায়?
(লেখক চলচ্চিত্র পরিচালক। মতামত ব্যক্তিগত)