পেশিবল: ভেঙে দেওয়া হচ্ছে বেআইনি বাড়িঘর, দোকান, জহাঙ্গিরপুরী, দিল্লি, ২০ এপ্রিল। ছবি পিটিআই।
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এক আমেরিকান সামরিক অফিসার লিখেছিলেন যে, যুদ্ধে ব্যবহৃত এরোপ্লেন বা ট্যাঙ্কের মধ্যে এক রকমের ‘রোম্যান্টিক আবেদন’ থাকলেও বুলডোজ়ারের কার্যকারিতা অসীম। সব কিছু গুঁড়িয়ে সেনাবাহিনীর এগিয়ে চলা নির্ভর করে এই যন্ত্রের উপর। অন্য কোনও দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষ এই মুহূর্তে যুদ্ধরত নয়। কিন্তু দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বুলডোজ়ার আর নিছক একটি যন্ত্র মাত্র নয়। সংখ্যালঘু উৎপীড়নে সরকারি ব্যবস্থাপনার রূপক হিসেবে এটি আত্মপ্রকাশ করেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর জহাঙ্গিরপুরীতে যে ভাবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ উপেক্ষা করে বুলডোজ়ার ব্যবহার করে বেছে বেছে মুসলমান পরিবারের বাড়ি, দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটি প্রশাসনিক ব্যর্থতার কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। দেশ জুড়ে নানা বিজেপি-শাসিত রাজ্যে এই প্রকরণ ব্যবহৃত হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। মধ্যপ্রদেশের খরগোন ও শ্যোপুরে একই ভাবে বুলডোজ়ার চালিয়ে পুলিশি সহায়তায় প্রশাসন গুঁড়িয়ে দিয়েছে বাড়ি, দোকান। ভোপাল শহরে তো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পরিচালিত একটি কলেজ এবং স্কুলও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কর্নাটকের উদুপি শহরে হিজাব প্রতিবাদে যোগ দেওয়া মুসলিম পরিবারের রেস্টুরেন্ট গুঁড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন। উত্তরপ্রদেশে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আরও আগে এবং নির্বাচনে তার সুফলও পেয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি। দলের সমর্থকেরা বুলডোজ়ারে চেপে সদর্পে বিজয়োৎসব পালন করেছে। যোগী আদিত্যনাথ ‘বুলডোজ়ার বাবা’ নামে তাঁর ভক্তকুলের মধ্যে পরিচিতি পেলে, পিছিয়ে নেই মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও। তিনি অধুনা ‘বুলডোজ়ার মামা’ নামে উল্লিখিত হন। সব মিলিয়ে ভারী কাজে ব্যবহৃত ধীরগতির একটি যন্ত্র এখন দেশের মুসলিম মানুষদের ভীতি এবং নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দুত্ববাদী শক্তির প্রতিভূ হয়ে এই যন্ত্র যেন মুসলমানদের প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, এই ভূমি তাদের নয়, এখানে তাদের বসবাস, জীবন-জীবিকা নির্বাহ— সবই চলছে সংখ্যাগুরুর অনুগ্রহে। মোদীর ভারতবর্ষে এ অবশ্য খুব বিস্ময়কর কোনও খবর নয়। মোদী’জ় ইন্ডিয়া: হিন্দু ন্যাশনালিজ়ম অ্যান্ড দ্য রাইজ় অব এথনিক ডেমোক্র্যাসি গ্রন্থে তথ্য ও তত্ত্বের মাধ্যমে ক্রিস্তফ জাফ্রেলো যা বলেছেন, আমাদের সাদা চোখে গোরক্ষকদের তাণ্ডব, খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিতর্ক, ধর্মীয় মিছিল ও মঞ্চে উচ্চারিত তীব্র মুসলিমবিদ্বেষী বয়ান, একের পর এক গণহত্যা, প্রশাসনিক নীরবতা ও পক্ষপাত— এই সব দেখে আমরাও একই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছতে পারি। খাতায়কলমে এ দেশ এখনও ধর্মনিরপেক্ষ হলেও বাস্তবে এটি এখন হিন্দু রাষ্ট্র।
নরেন্দ্র মোদীর এই ভারতবর্ষে বুলডোজ়ার যেমন এক দিকে সংখ্যালঘু মানুষদের মধ্যে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা সঞ্চার করতে ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্য দিকে এর মাধ্যমে দোর্দণ্ডপ্রতাপ পৌরুষদৃপ্ত শাসকের একটি ছবিও জনমানসে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন এক শাসক, যিনি অনায়াসে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যাঁর শাসন সব রকম চ্যালেঞ্জকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে, বুলডোজ়ারের মতোই। লক্ষণীয় যে, ভারতীয় জনতা পার্টির বেশির ভাগ উচ্চপদস্থ নেতাই পৌরুষদীপ্ত শাসকের এই ধাঁচে নিজেদের গড়ে তুলেছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এক সন্ধ্যার মধ্যে নোট বাতিল ঘোষণা করেন। একই রকম নাটকীয় ভাবে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেন। এবং নিত্যদিন আক্রমণাত্মক বক্তৃতাতে মূল্যবৃদ্ধি বা বেকারত্বের মতো সমস্যাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অনায়াসে “ঠোক দো”-র মত লব্জ ব্যবহার করেন। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুপ্রবেশকারীদের ছারপোকার সঙ্গে তুলনা করে তাদের বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলার হুমকি দেন। দেশের শাসক যখন এই ভূমিকা নিয়েছেন, পিছিয়ে নেই দেশের জনতাও। সঙ্গে যোগ দিয়েছে গণমাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশ। সবাই একযোগে শাসকের এই কঠোর কঠিন অবতারের প্রশংসায় মগ্ন। যোগী আদিত্যনাথের ভক্তের দল নিজেদের শরীরে বুলডোজ়ারের ট্যাটু বা উল্কি এঁকেছে; ‘বুলডোজ়ার বাবা’-কে নিয়ে তারা তৈরি করেছে অসংখ্য গান এবং ভিডিয়ো যা আন্তর্জালের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা উত্তর ভারতে। ‘বুলডোজ়ার মামা’ অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রচার তুঙ্গে। তাঁকে নিয়ে পোস্টার পড়েছে সে রাজ্যে— “বোনেদের, মেয়েদের সম্মানহানি করার সাহস যার হবে তার বাড়িতেই পৌঁছবে বুলডোজ়ার। মেয়েদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাকেই হাতুড়ির মতো আঘাত করবে মামার বুলডোজ়ার।” উত্তর ভারতের জবানিতে ‘বাহুবলী’ শব্দটি সাধারণত অপরাধীদের প্রসঙ্গেই ব্যবহৃত হয়। আজ শাসক যেন গর্বের সঙ্গেই সেই অনুষঙ্গের খানিকটা নিজ অঙ্গে চাপিয়ে নিয়েছেন। বাহুবলীর পেশি আস্ফালন এবং শাসকের পৌরুষ প্রদর্শন এক হয়ে যাচ্ছে আজকের ভারতে। সাধারণ মানুষও উপভোগ করছেন শাসকের এই রূপ, তা সে যতই দেশের সংবিধানে বিরোধী বা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থী হোক না কেন। যোগ্য সঙ্গত করছে সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ। ভারতীয় গণতন্ত্রের এক অবিশ্বাস্য মুহূর্ত রচিত হয় জহাঙ্গিরপুরীতে যখন বুলডোজ়ারে চালকের পাশে চড়ে বসেন সর্বভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের অত্যুৎসাহী মহিলা সাংবাদিক। তাঁর উদ্দেশ্য: বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার এই ‘গর্বের মুহূর্তে’ চালকের মনের ভাব জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া; হিংসা ও ধ্বংসের এই প্রক্রিয়াকে মহিমান্বিত করা। দাঙ্গাধস্ত অসহায় মানুষের উপর শাসকের এই আঘাত যে পৌরুষ উদ্যাপন করে, তা কি সত্যিই ভারতবর্ষের স্বভাব এবং স্বধর্মে কুঠারাঘাত নয়?
আশিস নন্দী তাঁর দি ইন্টিমেট এনিমি গ্রন্থে দেখিয়েছেন কী ভাবে পরাধীন ভারতবাসী পশ্চিমি আধুনিকতার প্রভাবে নিজেদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবনচর্যা, এমনকি স্বাধীনতা সংগ্রামেও পৌরুষের আরাধনায় মেতেছিল। এই দর্শনে পুরুষত্ব ছিল সর্বোচ্চ। নারীত্ব তার ‘স্বাভাবিক’ কমনীয়তা নিয়ে আকর্ষণীয় কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত। ক্লীবত্ব, কিংবা পুরুষের মধ্যে নারীত্ব— ছিল তীব্র ভাবে ঘৃণার্হ। আগ্রাসী পৌরুষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ছিল হিংসার প্রশ্নটিও। হিংসায় বলীয়ান ব্রিটিশ শাসককে হিংসার ভাষাতেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। শক্তিশালী শাসকের আগ্রাসী পৌরুষকে আত্মস্থ করার এই প্রচেষ্টা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের স্বভাব এবং স্বধর্ম থেকে চরম বিচ্যুতি। চার অধ্যায় উপন্যাসে অতীন বুঝতে পারে যে, পৌরুষলালিত হিংসার পথ বেছে নিয়ে সে তার স্বভাবকে হত্যা করেছে যা ‘সব হত্যার চেয়ে পাপ’। ‘দেশের আত্মাকে মেরে দেশের প্রাণ বাঁচিয়ে তোলা যায়’ কি না, সে প্রশ্নও বারে বারেই রবীন্দ্রনাথ করেছেন তাঁর বহু লেখায়। গান্ধীর জীবন ও দর্শন এই আগ্রাসী পৌরুষের বিপ্রতীপে অবস্থান করে। লক্ষণীয়, আজকের ভারতবর্ষে মহাত্মা গান্ধীর ঘাতকই সাড়ম্বরে পূজিত হচ্ছেন।
ফলে, পড়ে থাকে অতিকায় বুলডোজ়ার, শাসকের ক্ষমতা প্রদর্শন ও উদ্যাপন, হিংসার নৈমিত্তিকতা এবং গুঁড়িয়ে যাওয়া দুর্বলের অশ্রুবিন্দু। এখন কেউ যদি প্রশ্ন করে ‘এত রক্ত কেন’, তা শোনার জন্য নেই কোনও সংবেদনশীল শাসক, যিনি বলতে পারেন, “হিংসার নিকটে বলিদান দেওয়া শাস্ত্রের বিধি নহে, হিংসাকে বলি দেওয়াই শাস্ত্রের বিধি।”