রাজ্যস্তরে জোট স্পষ্ট না হলে মুশকিল মমতার, কংগ্রেসেরও
opposition alliance

যোগ-ভাগের অঙ্ক

পটনার পরে বেঙ্গালুরুতে বিরোধীদের বৈঠক ধারে-ভারে খানিক এগিয়েছে। যোগদানকারী দলের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রীদের মধ্যে ব্যবহারিক সৌজন্যও নজরে এসেছে।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৩ ০৮:১৫
Share:

একত্র: বেঙ্গালুরুতে বৈঠকে উপস্থিত রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সনিয়া গান্ধী-সহ বিরোধী জোটের নেতারা। ১৮ জুলাই ২০২৩। পিটিআই Sourced by the ABP

ভাবের ঘরে চুরি করলে চলবে না। সোজা কথা এ বার সোজা ভাবে বলতে হবে এবং মানুষকে সোজা ভাষায় তা বোঝাতেও হবে। যত ক্ষণ সেটা না হচ্ছে, তত ক্ষণ অন্তত এই রাজ্যে, বিরোধী জোট গঠনের ধোঁয়াশা পরিষ্কার হওয়া সম্ভব নয়। তৃণমূল, কংগ্রেস ও সিপিএম তিন দলের জন্যই এটা প্রযোজ্য।

Advertisement

পটনার পরে বেঙ্গালুরুতে বিরোধীদের বৈঠক ধারে-ভারে খানিক এগিয়েছে। যোগদানকারী দলের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রীদের মধ্যে ব্যবহারিক সৌজন্যও নজরে এসেছে। আর সবচেয়ে বড় বিষয়টি হল, জোটের নাম (যা সংক্ষিপ্ত করলে ইন্ডিয়া) ঠিক করার ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগ্রণী ভূমিকার পাশে থেকে বিষয়টি গুছিয়ে দিয়েছেন রাহুল গান্ধী। তৃণমূল নেত্রীকে পাশে বসিয়েছেন সনিয়া গান্ধীও।

রাজনৈতিক ভাবে কংগ্রেস ও তৃণমূল নেতৃত্বের ‘কাছে আসা’র সেই ছবি নিয়ে আলোচনাই এখন সবচেয়ে বেশি। এর অন্যতম কারণ হল, বাংলার রাজনীতিতে শাসক তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের অহিনকুল সম্পর্ক। সকলেই জানেন, জাতীয় ক্ষেত্রে বেঙ্গালুরুর আলোচনার টেবিলে রাহুল-সনিয়ার মাঝখানে মমতাকে দেখা গেলেও রাজ্যস্তরে কংগ্রেস এখনও পর্যন্ত তৃণমূল-বিরোধিতার পথ ছাড়তে রাজি নয়। ঠিক যেমন, এই রাজ্যে কংগ্রেস ও সিপিএম জোট বাঁধলেও কেরলের কংগ্রেস সেখানে শাসক সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়তে চায়।

Advertisement

কিন্তু রাজনীতি তো শরৎচন্দ্রের উপন্যাস নয়! এখানে টগর বোষ্টমীর সঙ্গে নন্দ মিস্ত্রির সম্পর্কের রসায়ন তাই খাটে না। রাজনীতির সংসারে কোনও টগর যদি বলে, মিস্ত্রির সঙ্গে ‘ঘর’ করলেও সে তাকে হাঁড়ি ‘ছুঁতে’ দেবে না, তবে সেই কথার যুক্তি, বাস্তবতা, নির্ভরযোগ্যতা, ভবিষ্যৎ সব কিছুই প্রশ্নের মুখে পড়তে বাধ্য। এ ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেই রকম হতে পারে।

যদিও কারও কারও যুক্তি হল, ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই’ বলে একটি কথাও তো রাজনীতির অভিধানে চালু আছে! কিন্তু হিসাব যেখানে হারজিতের, সেখানে ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটিই তো অর্থহীন। তাই জোট করতে গেলে ভাবের ঘরে চুরির ভাবনা ছেড়ে পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্যতার নিরিখে সবটা দেখাই বুদ্ধির কাজ।

তবে এগুলি তাত্ত্বিক দিক। প্রয়োগের স্তরে কত দূর কী হতে পারে, এই রাজ্যের রাজনৈতিক আবহে সেটিই হচ্ছে মূল প্রশ্ন। যেটুকু বুঝি, জোট-সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল আসন ভাগাভাগি। মুখে যতই বলুক, কোনও দলই ‘নিঃস্বার্থ’ সেবা করে দেশ ‘উদ্ধার’ করার মতো মহানুভব নয়। হওয়ার কথাও নয়! ‘জমি’ কব্জায় রাখতে মাংস-পোলাওয়ের বখরা সবার প্রয়োজন। যেখানেই যার কিছু না কিছু অস্তিত্ব আছে, সেখানে সে যে ভাবে পারে, সেটা আঁকড়ে রাখতে (পারলে বাড়াতে) চাইবেই। ক্ষমতা দখলের জন্য যাবতীয় দুর্নীতি, খুন-জখম, জাল-জালিয়াতির পিছনেও এটাই সার কথা।

তবে কে না জানে, জোর যার মুলুক তার। ‘ক্ষমতা’ দিয়ে ক্ষমতা দখলে রাখতে ক্ষমতাধরেরা কেউ কোথাও কম যায় না। তফাত শুধু প্রয়োগ কৌশলের। দুর্ভাগ্য, বাংলায় দীর্ঘ দিন ধরে ‘ক্ষমতা’ নির্ধারিত হয়ে আসছে হিংসায়, প্রাণের মূল্যে। দলনির্বিশেষে রাজনৈতিক বিরোধিতার প্রকাশ ঘটছে রক্তস্নানের উন্মত্ততায়।

ভোটের বাক্সে ‘জনমত’ ঘিরে বিতর্কও এখানে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বেশি। তথাপি বাস্তব হল, বাংলার বিরোধী শিবির বিজেপি এবং বাম-কংগ্রেস জোটের মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়ার পরেও একাধিক বার ত্রিমুখী লড়াইতে শাসক তৃণমূল কাগজে-কলমে একাধিপত্যের প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছে।

জোটের ক্ষেত্রে তৃণমূল নেত্রীর এত দিনের ঘোষিত অবস্থানও সবার জানা। হয়তো একা জেতার জোর দেখাতে পেরেছেন বলেই তিনি বলে থাকেন, যেখানে যে দল শক্তিশালী সেখানে সেই দল প্রার্থী দেবে। যার সহজ অর্থ, বাংলায় শুধু তৃণমূল। দু’টি জোট-বৈঠকের পরেও সেই অবস্থান থেকে তিনি সরে এসেছেন, তেমন আভাস এখনও মেলেনি। যদিও কংগ্রেস সম্পর্কে তাঁর মনোভাবে বেশ কিছু বদল পর্যবেক্ষকদের নজরে পড়ছে। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চেও তিনি কংগ্রেসকে কোনও ভাবেই নিশানা করেননি। সাম্প্রতিক কালে এমনটি দেখা যায়নি।

জোট গড়ার অন্যতম উদ্যোগী হিসাবে মমতার এই ভূমিকাকে লোকসভা নির্বাচনের বৃহত্তর প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করার অবকাশ আছে। বিশেষ করে তাঁর নিজের রাজ্যে। কারণ ক্ষয়িষ্ণু হয়েও জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস যে বিরোধী শিবিরের সবচেয়ে বড় দল, তাতে সন্দেহ নেই। আজও দেশের সর্বত্র তার উপস্থিতি। তা সে যেমন আকারেই হোক।

অনেক কিছু এখনও অনিশ্চিতের গর্ভে। তবু যুক্তি বলে, ‘ইন্ডিয়া’ যদি ভোটের ভারতে জোরালো হাওয়া তুলতে পারে, তা হলে সব রাজ্য মিলিয়ে তার ‘সুফল’ অন্যদের চেয়ে কংগ্রেসেরই বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা। সে ক্ষেত্রে আবার তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে বিজেপির ‘হিন্দুত্ব’ রাজনীতির মোকাবিলায় দেশে সংখ্যালঘু ভোটের গতিপ্রকৃতি। অর্থাৎ সেই ভোটের সামগ্রিক প্রবণতা তখন কোন দিকে বেশি হয়, তার উপরও অনেক রাজ্যেরই হিসাব নির্ভর করবে।

এ কথা ঠিক যে, বাংলায় সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগ এখনও মমতার সঙ্গে। এটা তাঁর অন্যতম ‘ভোট-ভরসা’ বলা চলে। তা সত্ত্বেও জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ স্থাপনের সুবাদে তারা রাজ্যে তাঁর বিরোধিতা করবে না, এমন একটি ‘নিশ্চিন্ত’ পরিস্থিতি মমতা চাইতেই পারেন। বস্তুত ইতিমধ্যেই একাধিক বার তিনি নরমে-গরমে বুঝিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ভাবে কোনও বোঝাপড়া হলে সর্বস্তরেই তাকে মান্যতা দেওয়া উচিত। মমতা এটাও বোঝেন, বিজেপির বিরুদ্ধে এককাট্টা হওয়ার ডাক দিয়ে কংগ্রেসকে যদি তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ার জায়গা থেকে সরিয়ে আনা যায়, তা হলে সিপিএমের-ও আর কিছু করার থাকবে না।

এখন প্রশ্ন হল, আদৌ তেমন কোনও অবস্থা তৈরি হলে তা কি নিঃশর্ত হতে পারে? সম্ভাবনা কম। বরং কংগ্রেস তখন কিছু আসন চাইতে পারে। মমতা তাতে আদৌ রাজি হবেন কি না, বা হলেও তা কত দূর পর্যন্ত, সে সব এখনই বলা খুব শক্ত। নতুন করে টানাপড়েন হওয়াও বিচিত্র নয়। যার সমাধান অনেকটাই নির্ভর করবে মূল লক্ষ্যে লড়াইয়ের জন্য বাংলায় মমতা এবং দিল্লিতে রাহুল-সনিয়ার পারস্পরিক সদিচ্ছা এবং রাজ্যের কংগ্রেস প্রকৃতপক্ষে তা কতটা ‘মান্য’ করবে তার উপর।

তৃণমূল কার্যত বাংলা-ভিত্তিক দল। অন্যান্য রাজ্যে চেষ্টা করেও তারা এখনও দাগ কাটতে পারেনি। অন্য রাজ্যে তার ‘চাহিদা’র ক্ষেত্রও তাই তুলনায় সীমিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলায় ক্ষীণতনু হলেও কংগ্রেসকে ঠিক সেই গোত্রে ফেলা যাবে না। তাই যদি তেমন পরিস্থিতি আসে, তা হলে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব বর্তাবে মূলত মমতার উপর।

অন্য দিকে, রাজ্য কংগ্রেস যদি তার তৃণমূল-বিরোধিতা বজায় রাখে? সে ক্ষেত্রে অবশ্যই চাপ বাড়বে কংগ্রেসের উপরতলায়। কারণ জোটের অঙ্কে তৃণমূলের সমর্থন ধরে রাখা তাদের কাছেও কম প্রয়োজনীয় হবে না। উপরন্তু রাজ্যে প্রচারে এসেই বা তখন কী বলবেন রাহুল-সনিয়া? শ্যাম রাখবেন, না কুল? তাতেও কংগ্রেসে এক অদ্ভুত ‘ধর্মসঙ্কট’ দেখা দিতে পারে।

এই সব অনাগত পরিস্থিতি বিবেচনায় না-রাখা বা শুধু ভাবের ঘরে চুরি করে মুখ ফিরিয়ে থাকা কারও পক্ষেই রাজনৈতিক বিচক্ষণতা হতে পারে না। বরং উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব জোটের ‘ধূসর’ জায়গাগুলি ঠিকঠাক করে নিতে উদ্যোগী হওয়া। যাতে মানুষও বোঝে, নেতারা সত্যিই কী চান।

বামফ্রন্টের ছোট এক শরিক-নেতা প্রয়াত মন্ত্রী রাম চট্টোপাধ্যায় বলতেন, বাড়ির উঠোনে কালসাপ বেরোলে দশ ভাইকে নিজেদের বিবাদ ভুলে এক সঙ্গে লাঠি নিয়ে আগে সাপ মারতে হয়। কারণ সাপ-ই তখন সবচেয়ে বড় বিপদ।

সেই সময় তাঁর ওই কথার নিশানায় থাকত কংগ্রেস। আজ রাজনৈতিক বাস্তবতা বদলেছে। কিন্তু বক্তব্যের ‘মাহাত্ম্য’ বদলায়নি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement