২০১৭ সালের মার্চে বিবিসি-র ‘দি অ্যান্ড্রু মার শো’-তে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রসচিব অ্যাম্বার রুড এনক্রিপশন প্রযুক্তিতে গোপনীয়তার মোড়কে পোরা মেসেজিং পরিষেবার উপর খড়্গহস্ত হয়ে ওঠেন। রুড বলেন, সন্ত্রাসীদের লুকোনোর মতো, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার মতো গোপন পরিসর একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁর বক্তব্যে ঝড় ওঠে। পরে এক প্রবন্ধে রুড লেখেন, নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে বিষয়গুলির ফলে অপরাধীরা তাঁদের বার্তা পড়তে পারে না, তা নিয়ে ‘রিয়াল পিপল’-এর মাথাব্যথা নেই।
কয়েক বছর ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে এই ‘টেক জায়ান্ট’ বা প্রযুক্তি দৈত্যদের লড়াই দানা বেঁধেছে। সম্প্রতি ‘প্রাইভেসি পলিসি’ নিয়ে চাপান-উতোরের মধ্যেই গোপনীয়তা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন তথ্যপ্রযুক্তি নির্দেশিকার বিরুদ্ধে দিল্লি হাই কোর্টে গিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ। নতুন নিয়মে সরকার চাইলে প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে কোনও বার্তা বা মেসেজের উৎস, অর্থাৎ প্রথম সংবাহকের পরিচয় জানাতে হবে। এখনও পর্যন্ত অনেক সংস্থা নতুন নিয়ম মেনে নিলেও টুইটারের সঙ্গে ভারত সরকারের সংঘাত অব্যাহত। প্রশ্ন হল, আইনি লড়াই কি ঠিক করবে ভারতে সংস্থাগুলির নিরাপত্তা সংক্রান্ত কার্যপদ্ধতির ভবিষ্যৎ? একে পৃথিবীজোড়া বৃহত্তর সংঘাতের অংশ হিসেবেই দেখা দরকার।
এ মুহূর্তে গুগল, টুইটার আর ফেসবুক-কে চাপ দিয়ে চলেছে রাশিয়া, সে দেশের ইন্টারনেট সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ চালানোর জন্য। রাশিয়ার আদালতে বড় জরিমানা করা হয়েছে সংস্থাকে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতে, ভারতের সঙ্গে ব্রিটেন বা আমেরিকায়, এমনকি ট্রাম্পের আমেরিকার সঙ্গে বাইডেনের আমেরিকায় এই লড়াইয়ে রূপরেখার কিছু পার্থক্য থাকলেও মূল লড়াইটা একই। ব্রিটেনে ও তার বাইরেও ‘রিয়াল পিপল’ মন্তব্যের বিস্তর সমালোচনা হয়। বিতর্কটাও জিইয়ে থাকে। ২০১৯-এর জুলাইয়ে আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জ়িল্যান্ডের জোট ‘ফাইভ আইস’ জানায়, এনক্রিপ্ট করা উপাদান আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির হাতে দিতে হবে প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রসচিব প্রীতি পটেল থেকে তৎকালীন আমেরিকান অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার, সকলেই বলেন গোপনীয়তা এবং এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনের নামে এমন কিছু করা যাবে না যা অপরাধীদের সাহায্য করে।
আজকের দুনিয়ায় প্রযুক্তি সংস্থার প্রভূত প্রভাব। তাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও তাই অপ্রত্যাশিত নয়। এবং তার ফলেই পরিবর্তনের ঝড় উঠতে চলেছে সিলিকন ভ্যালির তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির ব্যবসায়িক মডেলে। আজকাল তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা নিয়ে সব আলোচনাই দু’টি উৎসবিন্দুকে ঘিরে আবর্তিত হয়। একটি অরওয়েলের কাল্পনিক ‘ওশেনিয়া’ ও তার ‘বিগ ব্রাদার’-এর নজরদারির গল্প। অন্যটি হল, সুরক্ষা ও গোপনীয়তার বন্ধ দরজার ও-পারে কত দাঙ্গা, গণপিটুনি, বিপ্লব, অভ্যুত্থান সংঘটিত হতে পারে তার বর্ণনা। হংকং-এর আন্দোলনকারীরা গোপনীয়তা বজায় রেখে ব্যবহার করেছিলেন মেসেজিং অ্যাপ ‘টেলিগ্রাম’, সেই সূত্রেই তার জনপ্রিয়তা। গোপনীয়তার আগল ভাঙলে যে কী হতে পারে, তার উদাহরণও বিস্তর। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ইতিবৃত্ত আমেরিকা ও ব্রিটেনের সঙ্গে অবশিষ্ট বিশ্বকেও তাড়িয়ে ফিরবে বহু বছর। বিশ্ব জুড়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে জনমত গড়তে সোশ্যাল মিডিয়া ও তার শাখাপ্রশাখায় ছড়ানো গুজব নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। গোপনীয়তার আলো-আঁধারিতেই ভেসে বেড়ায় তহরির স্কোয়ার, আরব বসন্ত, যা ফেসবুক বার্তাতেই ছড়িয়েছিল। গোপনীয়তার চেহারা পাল্টায় দেশ-কাল-সমাজভেদে। তাই উপযুক্ত লক্ষ্মণরেখা নির্ধারণ করতে দেশে দেশে সরকার, আইনসভা, আদালতকে অনেকটা সময় দিতেই হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাবে বিন্যাসও। সিলিকন ভ্যালির বড় সংস্থাগুলোকেও আলাপ-আলোচনা বা আইনি লড়াইয়ে নিজেদের সীমাবদ্ধতা বুঝে নিতে হবে।
সংস্থাগুলির ব্যবসায়িক মডেলে বদল আসতে চলেছে অনিবার্য ভাবেই। মাসকয়েক আগে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ফেসবুকের যে লড়াই হল, এ গ্রহের দখলদারিতে প্রযুক্তি দৈত্যদের উপর তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। অস্ট্রেলিয়ার সংবাদ সংস্থা অভিযোগ জানিয়েছিল, তাদের খবরের লিঙ্ক ব্যবহার করে ব্যবসার সমূহ ক্ষতি করছে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি। সরকার আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হয়, যাতে প্রযুক্তি সংস্থাগুলি খবর ব্যবহার করলেই উপযুক্ত অর্থমূল্য দিতে হয়। প্রাথমিক ভাবে প্রতিবাদ করেও এই আইন মেনে নেয় গুগল, বিপুল অঙ্কের চুক্তি সেরে ফেলে প্রধান অস্ট্রেলীয় সংবাদ সংস্থাগুলির সঙ্গে। ও দিকে, অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার খবর নিষিদ্ধ করে দেয় ফেসবুক। প্রবল চটে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেন, সংস্থা দুনিয়া পাল্টে দিতেই পারে, কিন্তু তার মানে এটা নয় যে তারাই দুনিয়া চালাচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়া-ফেসবুক সংঘাত সংস্থাগুলির সঙ্গে সমাজের সম্পর্কের পরিবর্তন-বিন্দু। ব্যবসায়িক মডেলটি পুনর্নির্ধারিত হতে পারে এর পর। ফেসবুক হয়তো ভেবেছিল, অস্ট্রেলিয়া তাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। তা ছাড়া ফেসবুকের চার শতাংশেরও কম অংশে থাকে খবর, এবং পৃথিবীব্যাপী ২২৬ কোটি ব্যবহারকারীর মাত্র ১.৭ কোটি অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা। তাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো বা ফিলিপিন্সের মতো যে সব দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা আমেরিকার পরেই সর্বাধিক, ভবিষ্যতে তেমন কোথাও এমন কিছু ঘটলে খেলা অন্য রকম হবে। অস্ট্রেলিয়া ও ফেসবুক-ও অবশ্য কয়েক দিনের মধ্যেই সমস্যা মিটিয়ে নিয়েছে আলোচনার টেবিলে।
কিন্তু এটা সমাপ্তি নয়, বৃহত্তর যুদ্ধের শুরুমাত্র। মাইক্রোসফট ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে এমন আইন আনার অনুরোধ জানিয়েছে। ব্রিটেন, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও অস্ট্রেলীয় আইন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছে।
সব মিলিয়ে বাঁধভাঙা পরিবর্তনের স্রোত প্রযুক্তি সংস্থার গতিপ্রকৃতি বদলে দিতে চলেছে। গত দু’দশকে তারা মানুষের জীবনযাত্রায় বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আবার, পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা এবং অনুশাসন তাদের ব্যবসার ছাঁচও বদলাচ্ছে সমানে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা