এই গানের সুরে বাঁধা আছে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সঙ্গীতবোধ
National Anthem

‘ভারতভাগ্যবিধাতা’র গান

রবীন্দ্রনাথের লেখা হলেও এ গান ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ নয়। মনে হয়, যিনি অসম্ভব জটিল সব সুর রচনা করছেন, তিনিই কি এই সর্বজনের পক্ষে সহজেই গেয়ে ওঠা একটা গান রচনা করলেন! কেনই বা করলেন?

Advertisement

দেবজ্যোতি মিশ্র

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:৪৮
Share:

ইতিহাসকে কি সময়ের স্বরলিপি বলা যায়? সেই ইতিহাস যদি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে হয়, তা হলে এই পাঠ হওয়া উচিত আরও নিবিড়। শুধুমাত্র একটি সঙ্গীত নয়, তার হয়ে-ওঠাও সে ক্ষেত্রে সমান ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ।

Advertisement

কী এমন বৈশিষ্ট্য আছে একটি সঙ্গীতে, যা তাকে উত্তীর্ণ করে জাতীয় সঙ্গীতে, যা স্পর্শ করে সর্বজনীন জাতীয় আবেগ? ‘জনগণমন’-র সুরের চলনে এই যে বারে বারে শুদ্ধ গান্ধার হয়ে মধ্যমে আগমন— সা রে গা গা গা গা গা গা গা -া গা গা রে গা মা -া— ঝমঝমিয়ে বেজে ওঠা জটিল কোনও সুর নয়, এ গান আলাহিয়া বিলাওয়ল আশ্রিত, তবুও যেন সমস্ত দেশ বাদ্যযন্ত্র ও রাগিণী হয়ে বেজে ওঠে, তার নিজস্ব আত্মার সহজ সুরে। এই সুর আমাদের মনে করায় ‘আগুনের পরশমণি’ গানে বারে বারে শুদ্ধ গান্ধারের প্রয়োগ। এ এক অমোঘ রাবীন্দ্রিক সুর সঞ্চার। গান দু’টি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে। প্রথমটি ১৯১১, এবং দ্বিতীয়টি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবহে ১৯১৪ সালে। দু’টি গানের প্রথম পঙ্‌ক্তিতেই পর পর দশ বার বেজে ওঠে শুদ্ধ গান্ধার— সারি সারি শুদ্ধ গান্ধার এসে মিলিত হয় মধ্যমের মোহনায়। গান্ধার এগিয়ে চলার স্বর, আর মধ্যম আমাদের স্থিতি দেয়। দেশ সেই স্থিতির সন্ধান, সেই চিরচেনা ঘর।

রবীন্দ্রনাথের লেখা হলেও এ গান ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ নয়। মনে হয়, যিনি অসম্ভব জটিল সব সুর রচনা করছেন, তিনিই কি এই সর্বজনের পক্ষে সহজেই গেয়ে ওঠা একটা গান রচনা করলেন! কেনই বা করলেন? ভারতভাগ্যবিধাতার কথা তো আরও জটিল সুরে, আরও অনেক ড্রামাটিক সুরেও বসতে পারত। বিশেষত ১৯১১-য় যখন এ গান রচিত হচ্ছিল, তখন তো জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না! থাকলে হয়তো দাবি করা যেত, কবি এ গান জাতীয় সঙ্গীত যে সারল্য দাবি করে, সেই অনুযায়ীই লিখেছেন। আসলে রবীন্দ্রনাথ নয়, এই গানই তৈরি করে তার নিজস্ব সুর। যেখানে ক্রমেই সুরকার, গীতিকার, এমনকি গায়কেরও অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আস্তে আস্তে আমরা গানের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে থাকি। আর দেখি, গানেরই দু’পাশে আদিগন্ত বিস্তৃত ঐশ্বর্য। সরস্বতী বয়ে চলেছে। দু’কূল ছাপিয়ে উঠেছে সোনার ফসল। তার পাশে পাশে পর্ণকুটির, ঋষিরা সামগান গাইছেন। তৈরি হচ্ছে— কোনও ধর্ম নয়— নিজেকে চেনার পথ। সময় এগিয়ে চলে গানেরই মধ্যে, দেখি বুদ্ধের সরল ক্ষমা এসে শুদ্ধ করছে জাতপাতের বিচারে ক্লিন্ন ভাবনার পথ। বুদ্ধের কণ্ঠে শুনতে পাচ্ছি এক বিরাট আহ্বান। খণ্ড খণ্ড ভারতবর্ষ তৈরি হচ্ছে একটি ভূখণ্ডে। তার পর, অন্ধকার...

Advertisement

রবীন্দ্রনাথ মানুষের মন বোঝেন তাদের মতো করে। তিনি তাই ভালই জানেন যে, এ গান সব ভারতবাসীর জন্য। শুধুই কি ভারত? এই গানের মধ্যে বড় হয়ে উঠছে পাশ্চাত্যের হারমোনির বীজ। তৎসম শব্দের গায়ে যেন জেগে উঠছেন ফ্রাঞ্জ শুবার্ট কিংবা ইয়োহান সেবাস্টিয়ান বাখ। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এক অপূর্ব মিলনের মধ্যে দিয়ে ‘জনগণমন’-র হারমোনিক প্রোগ্রেশন এগিয়ে চলে। ঠাকুরবাড়ির পাশ্চাত্য সঙ্গীত শোনার অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ দেশীয় সুরে সঞ্চার করছেন অর্কেস্ট্রার অমোঘ সম্ভাবনা। অল্প বয়সেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে কিংবদন্তি জার্মান কম্পোজ়ার বাখের সৃষ্টির সঙ্গে। বিশেষ করে ‘ব্র‍্যান্ডেনবার্গ কনচের্টো’ রবীন্দ্রনাথের মনে সাংঘাতিক আলোড়ন তৈরি করেছিল। বাখের রচনায় যেমন একটি মেজর নোটের হাত ধরে হেঁটে যায় সারি সারি মাইনর নোটের দল, তেমনই যেন রবীন্দ্রনাথের এই দু’টি গানে শুদ্ধ গান্ধারের পাশে এসে স্থির হচ্ছে অনেক স্বরের আলোছায়া। গান্ধার যদি মুখচ্ছবি হয়, তবে তার চার পাশ দিয়ে ফুটে বেরোনো ম্যাজিক লণ্ঠনের আলোয় তৈরি হয় সে মুখের মায়াবী ছায়ারা। দু’টি গানই যখন মধ্যমের ঘরে গিয়ে বসছে, যেন সকল রসের ধারা গিয়ে মিশছে মহাকালের মাঝে।

দেশ-সময়-সমাজের ঊর্ধ্বে সেই ঐকতান। আজ যখন আর্মি ব্যান্ডে এই গান বাজে, অথবা কোনও মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের নানা স্বরের কণ্ঠ তাকে গেয়ে ওঠে, তার পিছনে আলো হয়ে থাকেন বাখ— সদ্য জেগে-ওঠা জার্মান জাতীয়তাবাদ থেকে বাঙালি কবির একান্ত প্রেরণার ধন। সে-গান তখন আর নিছক নীরস নোটেশনের দাসত্ব করে না। সে স্বরলিপির খাতা উড়িয়ে দিয়ে অভ্রভেদী রথের সওয়ার। এই উল্লাসের উত্তরণকে ধরতে পেরেছিলেন আর এক ভারতীয় সুরপুরুষ সলিল চৌধুরী। এই প্রসঙ্গে বলি, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কর্মশালায় তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘জনগণমন’-র বিশ্বমানের অর্কেস্ট্রেশনের গতিপথ। পাঠক, এক বার ইউটিউব-এ শুনে নিতে পারেন সেই আলোচনা।

জনগণমন গানের অর্কেস্ট্রেশনের মধ্যে মিউজ়িক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্টের বিস্তার যেন এক শিল্পের মহাজগৎ। প্রতিটি সুরের বাঁধন, প্রতিটি কর্ড প্রোগ্রেশনের সম্ভাবনা, যেন এক অবিরাম অনুসন্ধান। বেঠোফেনের নাইন্‌থ সিম্ফনির ‘ওড টু জয়’ মুভমেন্ট যেমন বিশ্বসঙ্গীতের এক অবিস্মরণীয় উদাহরণ, তেমনই ‘জনগণমন’-র স্ট্রিংস আর ট্রাম্পেটের মেলবন্ধন যেন তার ভারতীয় প্রতিধ্বনি। গানের মূল সুরের শরীরের ভিতরে যেন এক জাদু লুকিয়ে আছে। সেই জাদু এমন ভাবে সুরসঙ্গতি তৈরির পথ খুলে দেয় যে, এক-এক জন অ্যারেঞ্জার সেই সুরের আলোকে নিজের মতো করে নতুন রং যোগ করতে পারেন। শুদ্ধ আর কড়ি-কোমলের স্বরের মিলনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় এক বিশাল সঙ্গীতগুচ্ছ, যা গানের মূল সুরকে আলোকিত করে তোলে। গানের তালে গ্রুপ ভায়োলিনের কোমলতা, চেলোর গভীরতা, ট্রাম্পেট আর ট্রম্বনের বীররস ভারতের ঐতিহ্য আর বহুত্ববাদকে প্রতিফলিত করে। এ যেন একটি গান নয়, একটি অভিজ্ঞতা, যা শোনার জন্য নয়, অনুভব করার জন্য।

১৯১১ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম গীত হয়েছিল এই গান, ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’। ছাপা হয়েছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়, ব্রহ্মসঙ্গীত হিসাবে। তার সাত বছর পরে, বিশিষ্ট আইরিশ কবি ও বেসান্ত থিয়োসফিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ জেমস এইচ কাজ়িনস-এর আমন্ত্রণে কবি গেলেন অন্ধ্রপ্রদেশের মদনপল্লিতে। সেখানেই এক ছাত্র সম্মেলনে কবি নিজ কণ্ঠে বাংলায় গাইলেন এই গান। ভাষার ব্যবধান কমাতে পারল না মুগ্ধতার স্রোতকে। কাজ়িনস-পত্নী মার্গারেট ছিলেন পাশ্চাত্য সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ। তাঁর বুঝতে দেরি হল না এই গানের পাশ্চাত্য গ্রহণযোগ্যতার সম্ভাবনা। তাঁরই অনুরোধে কবি এই গানের ইংরেজি অনুবাদ করলেন: ‘দ্য মর্নিং সং অব ইন্ডিয়া’। স্বরলিপি করলেন মার্গারেট নিজে। এর আগে গানটির কোনও স্বরলিপি তৈরি হয়েছিল কি না, আমাদের জানা নেই। মার্গারেটই প্রথম এই গানের সুরকে পাশ্চাত্য পদ্ধতির নোটেশনে সাজালেন এবং অর্কেস্ট্রার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন সেই সুর। মূলত এই স্বরলিপিই আজও অনুসৃত হয়।

১৯৩০ সাল থেকেই রাজনৈতিক মহলে দাবি উঠেছে একটি জাতীয় সঙ্গীতের। ১৯৩৭ সালে সুভাষচন্দ্র বসু ‘জনগণমন’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত করার প্রস্তাব করেন। ১৯৪২ সালে ২৯ মে তাঁর উদ্যোগে জার্মানির হামবুর্গ থেকে রেডিয়ো ওয়েভে ‘জনগণমন’ ছড়িয়ে যায় গোটা বিশ্বে। ১৯৪৩ সালের ৫ জুলাই, যে দিন আজ়াদ হিন্দ ফৌজ গঠনের কথা ঘোষিত হয়, সে দিনই প্রথম বারের জন্য জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয় জনগণমন।

১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হল। কিন্তু, তখনও সরকারি ভাবে আমাদের কোনও জাতীয় সঙ্গীত নেই। যদিও, রাষ্ট্রপুঞ্জে ‘জনগণমন’-র সুর ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের সুর হিসেবে স্বীকৃতি পেল। নেহরুও মুগ্ধ ছিলেন এই গানে। তিনি বলেছিলেন, “এই গান ও তার সুর শুধু আমাদের না, মুগ্ধ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশিষ্ট প্রতিনিধিদেরও। এমনকি অন্যান্য দেশের সঙ্গীতকাররাও মুগ্ধকণ্ঠে জানাচ্ছেন, এই সঙ্গীত দারুণ ভাবে অর্কেস্ট্রেবল। নিঃসন্দেহে এই গানই দেশের আবেগের শ্রেষ্ঠ প্রতীক।”

অবশেষে এল ২৪ জানুয়ারি ১৯৫০, যে দিন ‘জনগণমন’ ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে পায় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। ভারতের আত্মার অংশ এই গান আমাদের জাতীয়তাবাদের সুরমূর্ছনা। ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’র আশীর্বাদ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement