পুজোর সময় মা দুর্গার একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। অসুর বধ করে দেবী কৈলাসের দিকে পা বাড়াচ্ছেন, কানে এল বাচ্চার কান্না। ফিরে দেখেন, মহিষাসুরের ছোট্ট ছেলে! সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলছে, তুমি দুষ্টু দেবী, আমার বাবাকে মেরে ফেললে, এখন আমার কী হবে? দেবী বললেন, দেখো, তোমার বাবা তো অনেক অপরাধ করেছিলেন, তাই এমনটা তাঁর লিখনে ছিল। কিন্তু তুমি তো ভাল ছেলে, তোমার কোনও ভয় নেই। তুমি আমার কাছে থাকবে, আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে স্কুলে যাবে, তার পর বড় হলে পুজোর সময় কার্তিকের পাশে তরোয়াল হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে। তোমার নাম হবে ‘বীর’।
গল্পটা আমার নয়; হলে বর্তে যেতাম। এটা শুনেছি এক গল্প-দিদিমণির কাছে, যিনি স্কুলে আশ্রমে হাসপাতালে বাচ্চাদের গল্প শোনান আর তাদের দিয়েও বলান। এটা লিখেছিল দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত এক এগারো বছরের মেয়ে। সে তার দ্বাদশ জন্মদিন দেখে যেতে পারেনি। আবছা ভবিষ্যৎ নিয়ে যত ভয়-দ্বিধা, আশ্রয়ের অস্ফুট আকাঙ্ক্ষা, সবটা সে কল্পনায় সঁপে দিয়েছে দেবীর কোলে, আশা-ভরসার সংস্থান করে নিয়েছে। এটা ভক্তি নয়, সরল আস্থা, মা-বাবার প্রতি শিশুর সহজাত আস্থার মতো।
প্রথম যিনি দুর্গার অকালবোধন করেন, সেই রামচন্দ্র ব্যাপারটা বুঝতেন। নীলোৎপল নিয়ে দেবীর টুকি খেলার পর অভিমান করে তিনি বলেছিলেন, “ভালো দুঃখ দিলে, মাতা, পেয়ে অসময়। কিন্তু জননীর হেন উচিত না হয়।” ততক্ষণে অবশ্য তিনি বুঝে গিয়েছেন, জননী আসলে এমন নন: ‘আশা আছে আশ্বাসেতে দাও মা আশ্বাস।’ সত্যিই দেবীর বরে তাঁর বীরত্ব বৃথা যায়নি।
অকালবোধনের কাহিনি বাল্মীকির রামায়ণে নেই। কৃত্তিবাস এটি পেয়েছিলেন দু’টি গৌণ পুরাণ থেকে, যার উৎপত্তি বাংলা বা পূর্ব ভারতে। বাঙালি মানসিকতাই যেন বে-তাল বে-আদব। আমাদের প্রধান পুজো এমন সময়, যখন ওই দেবীর আরাধনা হওয়ার কথাই নয়। তার সূত্র রামচন্দ্রের যে ক্রিয়াকর্মে, বাকি ভারত তার খবর রাখে না; অন্তত বাকি ভারতের পুরুষতান্ত্রিক ধর্মবোধের সঙ্গে দেবীপূজার— এক নয়, দেবীশক্তির একাধিক রূপে পূজার— রাজ্যভর এই প্রচলন মেলে না। বাংলার কৃষ্টিতে পুরুষতন্ত্র নেই, এমন গালগল্প বলছি না। উপরন্তু অতীত থেকে বঙ্গভূমি বর্ণাশ্রমের উৎকট আতিশয্য দেখেছে; দেখেছে ধর্মীয় বিভাজন, অতএব নতুন হিংসা ও বিভেদ। কিন্তু পাশাপাশি দেখেছে হিন্দুধর্মের বহুল বিচিত্র প্রচলন ও ভাবধারার সঙ্গে জনজাতির এবং বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান আচারধর্মের অশেষ সংমিশ্রণ, তথাকথিত ‘গৌণ ধর্ম’-এর সমারোহ। নিশ্চয় এমন ঘটেছে ভারতের সর্বত্র, কিন্তু আজকের দিনে প্রমিত স্তরে এতটা মান্যতা পাচ্ছে না, বরং বিলোপের চেষ্টা হচ্ছে। হচ্ছে বাংলাতেও, নিরস্ত করা যাচ্ছে না, কিন্তু সমন্বয় আর সহাবস্থানের কথা এখনও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে। আমাদের চেতনার একটা মোক্ষম স্তরে, ভাষা কল্পনা অতিকথার গহনে, এই অন্য বার্তাটা গেঁথে আছে।
এর পরিপূরক একটা বিষয় দেখা যাক। কৃত্তিবাসের রামের একটা কৌতূহলকর চরিত্রগুণ তাঁর রোদনশীলতা। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছেন, “কোনও একটা কিছু ছল পাইলেই রামচন্দ্র কাঁদিয়া পৃথিবী ভাসাইয়া ফেলেন।” এটা বাল্মীকির থেকে ভবভূতির উত্তররামচরিত-এ অনেক বেশি দেখা যায়, কৃত্তিবাসেও। অকালবোধনের আখ্যানটুকুতেই কৃত্তিবাসের রাম সাত দফায় কাঁদছেন। সীতাকে পরিত্যাগ করে বাল্মীকির রামচন্দ্র বিলাপ করেন বটে, কিন্তু লক্ষ্মণ বীরধর্মের কথা মনে করালে বিরতও হন। কৃত্তিবাসের রাম কিন্তু বৌকে তাড়িয়ে ক্রমাগত কাঁদছেন। তাতে বৌয়ের প্রতি অবিচার কমছে না, কিন্তু একটা স্পর্শকাতর অসহায়ত্ব ফুটে উঠছে। রামের নামে উৎপীড়ন বা স্বৈরাচার চালানোর পক্ষে বাল্মীকির মডেলটার অপপ্রয়োগ ঢের সহজ।
বঙ্গীয় চেতনার এই স্বকীয়তায় বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব প্রভাবের কথা বলা হয়। কারণ যা-ই হোক, অতীত ও বর্তমানে যতই বিদ্বেষ-হানাহানি ঘটুক, বাঙালির মনে ধর্মের মৌলিক চরিত্র কঠোর জবরদস্ত নয়, বরং মানবিক, অন্তরঙ্গ এবং নারীত্বের প্রসাদপ্রাপ্ত। তাতে সব অর্থেই ‘মমত্ববোধ’ আছে: এটা আমাদেরই সহজ সৃষ্টি ও উত্তরাধিকার— কোনও দৈবশক্তির চাপিয়ে দেওয়া নয়, রাজশক্তির তো নয়ই, বরং সাধারণ মানুষের অন্তরের রচনা, আমাদের সুখদুঃখের চিরন্তনীর একটা মহিমান্বিত অতিকথা। বাঙালির প্রধান পার্বণের ভিত্তি তাই ছেলেপুলে নিয়ে বিবাহিতা মেয়ের বাপের বাড়ি যাওয়ার গল্প। তার প্রকাশ গ্রাম্য ছড়ায়: “শয়নকালে দুর্গা বলে আজ্ঞা দেহ স্বামী,/ ইচ্ছা হয় যে বাপের বাড়ি কাল যাইব আমি।” আগমনী গান কৌতুক-নকশার রূপ নেয়: উলঙ্গ জামাই দেখে মেনকা বিচলিত হন, গিরিরাজ কন্যাকে জেরা করেন কার দাক্ষিণ্যে তার এত গয়নাগাটি।
এ দিকে বাংলার যত স্বপ্ন-দেখা সংগ্রামী মেয়ে দুর্গার প্রতিরূপের সাধনা করে। ঘরে-বাইরে’র বিমলা বলে: “আমি দেশের এমন একটি প্রত্যক্ষ রূপ চাই যাকে আমি মা বলব, দেবী বলব, দুর্গা বলব।” সেই দেবীর নানা অভিব্যক্তি আমরা আপন করে নিয়েছি, “আন্দোলনে উগ্রপন্থে শিক্ষাব্রতে কর্মযজ্ঞে রান্নাঘরে আঁতুড় ঘরে।” মল্লিকা সেনগুপ্তের ভাষায় সকলেই বলি, “আমার দুর্গা বাঁচতে শিখেছে নিজেই নিজের শর্তে।” শর্তটা অবশ্য প্রায়ই নিজের থাকে না। বাঁচার তাগিদে সন্তান কাঁখে দুর্গা তখন পরিযায়ী হয়ে রাস্তায় নামেন, ই়টভাটায় মাটি কাটেন, নাগরিকত্ব হারিয়ে মানুষ সীমান্তে বসে থাকেন। আজকের মূর্তিকারেরা আমাদের সেই দুর্গাদের দেখতে শিখিয়েছেন। ইটভাটার দেবীকে কিন্তু আগেই দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে আর এক ছোট্ট দুর্গা। মা যখন কর্মব্যস্ত, সে বাসন মাজে, জল আনে, ছোট ভাইকে সামলায়: “কর্মভারে অবনত অতি ছোট দিদি।” স্বাধীন ভারত সেই বালিকাকে না হতে দিল লক্ষ্মী, না সরস্বতী: সে অপরিণত দুর্গাই রয়ে গেল।
আরও বাকি থাকে। আজ কি আমরা বলতে রাজি, আমাদের তপস্বী উমা কখনও ধর্ষিত, কিন্তু অদলনীয় দলিত ললনা, কখনও জেলবন্দি প্রতিবাদী মুসলিম তরুণী? আমাদের শিবঠাকুর কখনও জনহিতপ্রাণ খ্রিস্টান পাদরি— তিনিও জেলবন্দি, জেলেই তাঁর মৃত্যু— আবার কখনও হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নিগৃহীত হিন্দু সন্ন্যাসী? বিবেকানন্দ বহু দিন গত হয়েছেন, তাঁর বাণী পরিত্যাগ করে তাঁর গৈরিক বসনকে তাই শিখণ্ডী করা যায়। সন্দেহ হয়, আজ বেঁচে থাকলে তাঁর পরিণতি হত স্বামী অগ্নিবেশের চেয়ে মর্মান্তিক।
এই সহস্র শিব-দুর্গার আরাধনার পথ বিবেকানন্দই দেখিয়েছেন। বলেছেন, “কৃষ্ণের প্রাচীন বাণী বুদ্ধ, খ্রীষ্ট ও মহম্মদ— এই তিন মহাপুরুষের বাণীর সমন্বয়।” বলেছেন, যথার্থ সর্বজনীন ধর্ম “শুধু ব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান বা মুসলমান হইবে না... স্বীয় উদারতাবশতঃ সেই ধর্ম অসংখ্য প্রসারিত হস্তে পৃথিবীর সকল নরনারীকে সাদরে আলিঙ্গন করিবে।” রবীন্দ্রনাথও বলছেন: “সমগ্রের মধ্যেই শিব, শিব ঐক্যবন্ধনে।” এর বিপরীত সেই দেবতা, “যার কল্পনা মানুষকে আপনার বাইরে বন্দী করে রাখে; তখন মানুষ আপন দেবতার দ্বারাই আপন আত্মা হতে নির্বাসিত, অপমানিত।” রচনার নাম ‘মানুষের ধর্ম’।
আশ্চর্য সমাপতনে বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ, দু’জনেই এমন আদর্শ পরিবারের কল্পনা করেছেন যার এক সদস্য বৌদ্ধ বা বৈষ্ণব, এক জন মুসলমান, এক জন খ্রিস্টান। শুনে কেউ তেড়ে এলে যেন বলতে পারি, এটাই আমাদের ধর্ম, এতেই আমাদের যেমন দেবভক্তি তেমন মনুষ্যত্ব, খবরদার এর অপমান করো না। মুসলিম শিল্পী আমাদের দেবীমূর্তি গড়েছে; মুসলিম গ্রামবাসী আমাদের দেউলের পরিচর্যা করেছে, হিন্দুরা পিরের মাজারের। সেই ধর্ম আমাদের নয়, যা রামলীলার মুসলিম নটকে বিতাড়িত করে, তৃষ্ণার্ত বালক জল খেতে মন্দিরে ঢুকলে মারধর করে, কিশোরকে ট্রেনভর্তি লোকের সামনে পিটিয়ে খুন করে, আক্রমণ করে ভিন্ধর্মী সন্ন্যাসিনীদের।
আমাদের দেবতার পুজো মনের মধ্যে, মানুষে-মানুষে সম্পর্কের মধ্যে, খোলামেলা জীবনযাপনের মধ্যে। মনুষ্যত্বের টানেই আমরা পুজোর সময় রাস্তায় ভিড় জমাই। অতিমারি কালের পুজোয় রাস্তায় না বেরোনোর বিধান: সেটাও আমাদের আত্মস্থ দেবীরই পুজো। কিন্তু মনের মণ্ডপ যেন কিছুতেই বন্ধ না হয়।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়