বিদ্বেষ বাড়ছে, সংঘাতও
Assam

বরাক উপত্যকার বাঙালি সমাজ: পুরনো দ্বন্দ্বের নতুন রূপ

ক্রমে অসমিয়া জাতির অস্তিত্বের বিরোধিতার তত্ত্বের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বঙ্গভাষী বিরোধিতাকে।

Advertisement

অনিন্দিতা ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:৪৮
Share:

আশঙ্কিত: নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আ‌ইনের বিরুদ্ধে আসু-র আন্দোলন। গুয়াহাটি, ২০১৮।

উত্তর-পূর্বাঞ্চল, অসম, বরাক উপত্যকা। বার বার ভৌগোলিক ব্যবচ্ছেদ এবং আঞ্চলিক রাজনীতির ভোলবদল হয়েছে, কিন্তু অসমের দুই বৃহত্তম জনগোষ্ঠী, অসমিয়া আর বাঙালিদের মধ্যে জাতিগত এবং ভাষিক বিদ্বেষের ধারা পাল্টায়নি। অসমে বাঙালি-বিরোধিতার ইতিহাস খুঁজতে গেলে পথ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। বরং মুসলিম-বিরোধিতার তত্ত্ব তুলনামূলক ভাবে নতুন। স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকে অসমের জাতিসত্তার রাজনীতির মূল সুর বাঁধা ছিল অসমিয়া জাতির অস্তিত্বের বিপন্নতাকে ঘিরে। এখন এনআরসি রাজনীতি তার সঙ্গে যোগ করেছে নতুন আর একটি দিক, মুসলিমবিদ্বেষ। সম্প্রতি অসমের মুখ্যমন্ত্রী অনেক তথ্য সাজিয়ে এক নতুন তত্ত্ব তুলে ধরেছেন, যার সারমর্ম, অসমে মুসলিম জনসংখ্যা এত বাড়ছে যে, অদূরে রাজ্যে হিন্দুরা নাকি সংখ্যালঘু হয়ে যেতে পারে। মুসলমানদের তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, দু’টির বেশি সন্তান হলে পাওয়া যাবে না সরকারি চাকরি। সরকারের সব সমাজকল্যাণ প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হতে হবে সে ক্ষেত্রে।

Advertisement

কিন্তু, লক্ষ্য কি কেবল অসমের মুসলমান সম্প্রদায়? অসমের সুরমা বা বরাক উপত্যকার বাঙালিদেরও একই ক্ষোভ, তাঁরাও ভুগছেন তাঁদের ভাষিক অস্তিত্ব নিয়ে অজানা আতঙ্কে। ১৯৬০ ও ১৯৭২ সালে অসমিয়া-বাঙালি ভাষিক পরিচিতির প্রশ্নে আসু-র আন্দোলন, ১৯৭৯-তে সংগঠিত ‘বঙ্গাল-খেদা’ বা ‘বিদেশি বিতাড়ন’ আন্দোলনের কথা নাহয় বাদ দেওয়া গেল, কিন্তু তার পর প্রতি দশকেই বাঙালি ভাষাভাষীদের লক্ষ্য করে আসা হয়েছে। অনুপ্রবেশ বা বিদেশি বিতাড়ন ইত্যাদি সমস্যার সমাধানসূত্র হিসাবে ১৯৮৫ সালের ১৪ অগস্ট ত্রিপাক্ষিক অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর উদ্যোগে, কিন্তু তাতে আক্রমণ থেমে যায়নি, বরং অর্থনৈতিক বৈষম্যের রূপ নিয়েছে। ২০১৫ সালের পর এনআরসি রাজনীতির আবহে বাঙালি হিন্দুদের প্রতি ভাষিক আগ্রাসনের সঙ্গে যোগ হয়েছে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও বৈষম্য।

১৯৪৭ সালে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রেফারেন্ডাম করেও অসমে ধর্ম-জাতি-সম্প্রদায় ও ভাষা সংক্রান্ত সমস্যার স্থায়ী কোনও সমাধানসূত্র বার করা যায়নি। বরং ক্রমে অসমিয়া জাতির অস্তিত্বের বিরোধিতার তত্ত্বের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বঙ্গভাষী বিরোধিতাকে। আপাত ভাবে কাছে টেনে নেওয়া হয়েছিল বাঙালি ‘মিয়া’ মুসলমানদের, কারণ তাঁদের ভিটেমাটিটুকু আঁকড়ে বাঁচার জন্য জনগণনা করতে আসা প্রতিনিধিদের তাঁরা বলেছিলেন, ‘আমাগো ভাষা অসমিয়া’। কিন্তু সমভাষিকতার সুবিধার সেই রক্ষাকবচ চলে গিয়েছে ২০১৬ সালে অসমে রাজ্য সরকার বদলের পরে। সংঘাতের মাত্রা বেড়েছে, বিদ্বেষের চরিত্রও পাল্টেছে।

Advertisement

২০১৫ সালের মার্চ মাস। তখনও মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ-এর নেতৃত্বে অসমে কংগ্রেস শাসন চলছে। ঠিক করা হয়, অসম বিধানসভার তৎকালীন স্পিকার প্রণব কুমার গগৈ-এর নেতৃত্বে অসমে ‘ভূমিপুত্র’ বা আদি বাসিন্দা কারা, তার তালিকা তৈরি করে, নতুন করে অসমিয়াদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হবে। যত ধরনের জাতিসত্তার মানুষ আছেন অসমে, তাঁদের সংগঠনগুলোর পুরোধাদের ডেকে পাঠানো হয় মতামতের জন্য। উদ্দেশ্য, ১৯৮৫ সালে ‘অসম অ্যাকর্ড’-এর ধারাগুলোর উপযুক্ত বাস্তবায়ন। কিন্তু সে সময় স্পিকারের ডাক পাননি বরাক উপত্যকার বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলের কোনও সংগঠনই। বরাক উপত্যকা সংস্কৃতি বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন নামে এক সংগঠন নিজেদের উদ্যোগে স্পিকার প্রণব গগৈকে চিঠি লেখেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করে বরাকের বাঙালি হিসাবে অসমের ‘আদি বাসিন্দা’ বলে তাঁরা দাবি জানান। প্রণব গগৈ রেগে গিয়ে মন্তব্য করেন, বাঙালিরা যে হেতু শঙ্কর দেবকে মানেন না, তাই তাঁদের ত্রিপুরায় চলে যাওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত মাঠে নামেন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, সমঝোতায় আসেন। তরুণ গগৈ বুঝতে পেরেছিলেন, অসমের ভৌগোলিক মানচিত্রের যে ঘটনাবহুল ইতিহাস, তাতে এমন একটি পদক্ষেপ অসমের দুই উপত্যকার ঐক্য ও সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।

বিজেপি প্রথম বার অসমে ক্ষমতায় আসার পর যখন এনআরসির কাজ শুরু হয়, প্রণব কুমার গগৈ-এর এই সুপারিশকে কেন্দ্র করে নতুন আর এক বিপজ্জনক রাজনীতি শুরু হয়। পরিকল্পনা করা হয় যে, রাজ্য সরকার নতুন এক ফর্মুলার সাহায্যে স্থির করবেন, অসমের আদি বাসিন্দা কারা, এবং কারা তা নয়। বিজেপির প্রথম মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বরাকের বাসিন্দাদের কথা দিলেন যে, অন্তত তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বে বাঙালিদের সরকারি নথিতে অসমের ‘অ-আদি বাসিন্দা’ বলে তুলে ধরা হবে না। তবু বরাক উপত্যকা সংস্কৃতি বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন সংগঠনের প্রতিনিধিরা অনুরোধ জানালেন, এই নথি আদৌ তৈরি না করার জন্য। ফল হল না। এবং, আস্তে আস্তে এই তথ্যসূত্র বা ডেটাবেসের ভিত্তিতে অধিকাংশ বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানরা অসমে ‘অ-আদিবাসী’র পর্যায়ে চলে গেলেন।

অসম চুক্তির ছয় নম্বর ধারানুযায়ী ঠিক হল, অসমের ভূমিপুত্রদের ভাষিক, সাংস্কৃতিক, সাংবিধানিক, রাজনৈতিক অধিকার ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা হবে। অল অসম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বা আসুর বহু দিনের দাবি ছিল এই অধিকার কার্যকর করার বিষয়ে। কংগ্রেস আমলে দাবিটিকে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির শাসনকালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একে সমর্থন করে। এর জন্য বিপ্লব কুমার শর্মা কমিটি তৈরি হলে সরকারি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সবার মত জানতে চাওয়া হয়। লক্ষণীয়, বাঙালিরা অসমের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও কোনও বাঙালিকে এই কমিটিতে রাখা হয়নি। তবু তাঁরা প্রতিবেদন দিয়ে জানান, ১৯৭১ সালের অনেক আগে, এমনকি ১৯৪৭ সালেরও আগে, বরাকের অধিকাংশ বাঙালিরা অসমে এসেছেন— সেই হিসাবে এঁরা কেউ বহিরাগত নন। এ দিকে যখন বিপ্লব শর্মা কমিটি শিলচরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কথা শুনতে আসেন, তখন অন্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর দ্বারা তৈরি সংগঠনগুলো থেকে বিবৃতি দেওয়া হয় যে, বরাকের হিন্দু-মুসলমান সব বাঙালিই আসলে বহিরাগত, এবং তারা ডিমাসা, মণিপুরি ও অন্যান্য জনজাতির আদি বাসিন্দাদের জমি কেড়ে নিয়েছে। তাই, অসম চুক্তির ছয় নম্বর ধারায় কাছাড় অঞ্চলের সব জনজাতির অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। দু’শো পাতার ওই রিপোর্ট রাজনৈতিক কারণে প্রকাশিত হয়নি ঠিকই, কিন্তু উল্লেখযোগ্য ভাবে তার নির্যাস ছিল, বরাক উপত্যকার খিলঞ্জিয়া বা ভূমিপুত্রদের সব অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হোক।

অসমের শেষ নির্বাচনে বিজেপি দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর এই বিরোধিতার ধারা আরও বেগবান হয়েছে। অসমিয়াকরণের প্রক্রিয়া চলছে পরিকল্পিত ভাবে। বরাকে সার্কুলার জারি করে যে অসমিয়া প্রবর্তন করা যাবে না, সেটা হয়তো এত দিনের রাজনীতিতে পরিষ্কার। তবে ভাষিক মাধ্যম হিসাবে বাংলার গুরুত্ব কমানোর জন্য সরকারি চাকরির জন্য অসমিয়া ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা চলছে। জুডিশিয়াল অফিসারের নিযুক্তিতে অসমিয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ক’দিন আগে এনআরসি-র কাজের জন্য যে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তৈরি হয়, তাতে মোট ১,৬০০ জনের নিযুক্তি হয়, কিন্তু গোটা বরাক উপত্যকা থেকে চাকরি পান মাত্র ১২ জন। অস্থায়ী বাসিন্দা থেকে স্থায়ী বাসিন্দার স্বীকৃতি পেতে বরাকের বহু পরিবার পরের প্রজন্মকে প্রাণপণ অসমিয়া শেখানোর চেষ্টা করছেন।

এক দিকে ভাষিক আগ্রাসন ও বৈষম্য, অন্য দিকে ধর্মভিত্তিক বৈষম্য ও বিভাজন। আইনজীবী ইমাদুদ্দিন বুলবুল বলছিলেন, কী ভাবে গরিব, অশিক্ষিত মুসলমানদের ভয় দেখিয়ে বলা হচ্ছে, ২০১১-এর জনগণনায় যাঁরা বাংলাকে মাতৃভাষা বলেছিলেন, এ বার তাঁরা অসমিয়াকে মাতৃভাষা না বললে ১৯৫১ সালের মতো রাতারাতি ‘গোয়ালপাড়া-করণ’ করা হবে। কিছু দিন আগে অসমে সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকে বেরোয়, ‘ভ্যাকসিন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ততা মুসলিম জেলায় সর্বাধিক’। প্রকৃত তথ্য, সর্বনিম্ন ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রথম দশটা জেলার মধ্যে প্রথম ও দশম স্থানে ছিল মুসলমান-প্রধান দু’টি জেলা।

শতাব্দীপ্রাচীন বহুসংস্কৃতির বাসভুমি অসমে এই মুহূর্তে অনেক ধারার বক্তব্য বা ‘ন্যারেটিভ’। অসমিয়া ন্যারেটিভ, বাঙালি ন্যারেটিভ এবং মুসলমান ন্যারেটিভ। ভাষিক বিভেদ ও ধর্মীয় বিভেদের উপর তৈরি করা বিদ্বেষবিষের আবহে এই ন্যারেটিভ-সমূহ ঘুরপাক খাচ্ছে।

ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement