প্রতিবেশীর বোঝাপড়া
Narendra Modi

চটজলদি রাজনীতির পাশ কাটিয়ে ঢাকার কূটনীতির হিসাব

বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা হয়েছে এই বিক্ষোভের ফুলকি যেন বড় কোনও আগুনের জন্ম না দিতে পারে তা নিশ্চিত করার।

Advertisement

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২২ ০৫:২০
Share:

যদি বলি বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত কক্স বাজারের সূর্যাস্ত বিশ্বের সুন্দরতম ফ্রেমগুলির একটি, প্রত্যক্ষদর্শীরা আদৌ ভিন্নমত হবেন না। সাদা বালি আর সবুজ ঘাসের এক ভাগ ডাঙায় চিত্রবিচিত্র সাম্পানের দল অপেক্ষা করে থাকে তিন ভাগ জলের ডাকের জন্য। সূর্যাস্ত তাদের সেই রঙের উপর সোনা গলিয়ে দেয়।

Advertisement

বঙ্গোপসাগরের সেই ছলাৎছলে পা ডুবিয়ে এই সে দিন আমাদের, ভারত থেকে যাওয়া সাংবাদিককুলের, মনেও আসেনি যে, কয়েক কিলোমিটার দূরেই টেকনাফ-এ পয়গম্বর সংক্রান্ত বিজেপি মুখপাত্রদের মন্তব্যকে ঘিরে প্রতিবাদ গর্জন হয়েছে। ঢাকায় বায়তুল মুকাররম মসজিদ থেকে উঠেছে ভারত-বিরোধী স্লোগান।

কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা হয়েছে এই বিক্ষোভের ফুলকি যেন বড় কোনও আগুনের জন্ম না দিতে পারে তা নিশ্চিত করার। বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী মানববন্ধনের খবর যাতে সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব না দেওয়া হয়, সে জন্য সক্রিয়তা দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই। গত বছর মার্চেও প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঢাকা সফরে সে দেশে অশান্তি বেশ বেশি হয়েছিল। এবং বিষয়টি তখন প্রচারমাধ্যমে এসেছিল আজকের চেয়েও বেশি করে।

Advertisement

কুড়িটিরও বেশি ইসলামিক দেশ এবং সংগঠন পয়গম্বরকে নিয়ে বিজেপি নেতাদের মন্তব্যের কড়া নিন্দা করেছে। অনেক দেশ সেখানকার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের রীতিমতো সহিষ্ণুতা ও ভব্যতার পাঠ পড়িয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের তরফ থেকে কোনও সরকারি বিবৃতি নেই এখনও পর্যন্ত। এই নিয়ে প্রশ্ন করায় সে দেশের তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বিষয়টিকে ভারত-নির্দিষ্ট না রেখে বলেছেন, ‘যখন এবং যেখানে’ পয়গম্বরকে লাঞ্ছনা করা হয়, বাংলাদেশ তার কড়া নিন্দা করে। এর পরই তিনি মোদী সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা করার জন্য।

আন্তর্জাতিক স্তরে যে হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং তাঁর সরকারকে, তার মধ্যে এ বিষয়টি গুরুতর। চার দিকে সমালোচনার সমুদ্র সফেন, তার মধ্যে মোদীকে দু’দণ্ডের শান্তি দিয়েছে— শুধু নাটোরই নয়, গোটা বাংলাদেশই!

প্রণিধানযোগ্য আরও একটি বিষয়। সংযুক্ত আরব আমিরশাহিও বিজেপির ওই রাজনীতিকদের সমালোচনা করেছে ঠিকই, কিন্তু ভারতীয় দূতকে ডেকে পাঠায়নি। সম্প্রতি নয়াদিল্লি এবং আবু ধাবির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি সই হয়েছে। বার্তা স্পষ্ট, ভারতীয় বাজারকে খুব বেশি নষ্ট করতে চায় না আবু ধাবি। পাশাপাশি বাংলাদেশও জানে, ভারতে ক্ষমতার চাবিকাঠি আজ এবং অদূর ভবিষ্যতে কার হাতে ন্যস্ত রয়েছে এবং থাকবে। ঢাকা জানে, অন্য আঞ্চলিক দলগুলির যে দৌড় এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, তাতে মোদী তথা বিজেপির উপরেই নিজেদের বাজি রাখা অনেক যুক্তিসঙ্গত। শেখ হাসিনার মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিক দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতাকেন্দ্রগুলি খুব ভাল করেই বোঝেন। চিন এবং ভারতের মধ্যে সচেতন ভাবে ভারসাম্য তৈরিই শুধু নয়, বেজিং-কে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে বাংলাদেশে। অন্য দিকে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্য বিভিন্ন মাধ্যমে ফের জাগিয়ে তুলে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি, ভারতের অবদানকেও ‘রক্তের সম্পর্ক’ হিসাবে বার বার তুলে ধরছেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মন্ত্রীরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রায় চার হাজার ভারতীয় সেনার বলিদানকে স্মরণ করতে কখনওই কোনও কার্পণ্য দেখাচ্ছে না আওয়ামী লীগ সরকার।

সেপ্টেম্বর নাগাদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের প্রস্তুতি চলছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনের আগে বা পরে নয়াদিল্লি আসার কথা রয়েছে তাঁর। আর তার পরই হাসিনা সরকার এবং গোটা দেশই ক্রমশ চলে যাবে জাতীয় নির্বাচনের বলয়ে। দু’হাজার তেইশের শেষে সে দেশে ভোট। এই পরিপ্রেক্ষিতে বহু ইসলামি রাষ্ট্রের থেকে অবস্থানে পৃথক হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কোনও রকম বিবৃতি দিতে না-চাওয়ার পিছনে বাংলাদেশের একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, ঢাকা বুঝে নিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সাপেক্ষে অন্যতম জরুরি নেতা এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদী। যে ঠান্ডা যুদ্ধের ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে রাশিয়া বা আমেরিকা এখনও পর্যন্ত দু’দেশের কাছেই নিজের দূরত্ব বা নৈকট্য বজায় রাখতে পেরেছে মোদী সরকার। তার ভাল-মন্দ কী হবে না হবে, তা ভবিষ্যৎই বলবে, কিন্তু আপাতত পুতিন বা বাইডেন— উভয়েরই নিজ নিজ কারণে প্রয়োজন ভারতকে। অন্য দিকে, আসিয়ান-ভুক্ত অঞ্চলে এবং সার্ক-এও নিজের প্রভাব বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট সক্রিয় সাউথ ব্লক। আর তাই বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদকে সরকারের অমিত প্রতাপশালী নেতা ও মন্ত্রী অমিত শাহের কুখ্যাত ‘উইপোকা’ (বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের) মন্তব্য সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া চাইলে, এতটুকু উত্তেজিত না হয়ে বলতে শোনা যায়, “দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে অনেককেই অনেক কিছু বলতে হয়। তার সঙ্গে বিদেশনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। এটি দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক বিষয় নয়।” একই ভাবে তিস্তা চুক্তির রূপায়ণের বিলম্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, একই রকম শান্ত ভাবে তিনি বলেছেন, “তিস্তা চুক্তির বাস্তবায়নের সমস্যাটা ভারতের প্রাদেশিক সরকারের (পশ্চিমবঙ্গ), কেন্দ্রের নয়। ফলে তিস্তা এখনই রূপায়িত না হলেও হাসিনার ভারত সফরে কোনও বাধা নেই। তবে আমরা অবশ্যই আশা করছি দ্রুত এই বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে।”

যে বিষয়টি দীর্ঘ দিন বাংলাদেশের আবেগের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে, সেই তিস্তা চুক্তি এখনও রূপায়িত না হওয়ার দায় কেন্দ্রের উপর না ঠেলে, রাজ্যের পাতে দেওয়ার (বাস্তব বিচারে যা অসত্য নয়) মধ্যেই স্পষ্ট, মোদী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কে কোনও টাল পড়তে দেওয়া এখন কাম্য নয় হাসিনা সরকারের।

অন্য দিকে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সুবাতাস বজায় রাখার পাশাপাশি ভারতের কাছে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়ের একটি সঙ্কেতও দিতে চাইছে ঢাকা। যা সিএএ, এনআরসি সংক্রান্ত বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ। বায়তুল মুকাররম থেকে তৈরি হওয়া বিক্ষোভ মিছিল, বা টেকনাফের মতোই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভারত-বিরোধী স্লোগান এবং কার্যকলাপের বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দু’টি বার্তা (যা আসলে একে অন্যের সঙ্গে জড়িত) দেওয়া হচ্ছে। এক, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পরতে পরতে মৌলবাদী কট্টর ইসলামিক শক্তি ঘাপটি মেরে রয়েছে। কোনও ভাবে আওয়ামী লীগ দুর্বল হলেই সেই ভয়ঙ্কর মুখ সামনে চলে আসবে। শুধু ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নিরিখেই নয়, গোটা অঞ্চলের স্বার্থেই যাকে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। দুই, ঠিক এই কারণেই আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনও বিকল্প নেই বাংলাদেশে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির উচিত নিজ স্বার্থেই শেখ হাসিনার হাত আরও শক্ত করা।

নয়াদিল্লির বিদেশ করিডর এই বার্তা এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গেই গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি আরও একটি বিষয়কেও ঢাকা বার বার তুলে ধরছে যে, অন্য অনেক দেশের মতো তাদেরও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর পীড়নের নজির ও ঘটনা রয়েছে। গত বছর পুজোয় কুমিল্লায় প্যান্ডেল আক্রমণ যে অভিযোগকে আরও সামনে এনেছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে হাসিনা সরকার। শুধু নিয়ন্ত্রণে আনাই নয়, দোষীদের কারাগারে পাঠিয়েছে।

সেই সাম্পানরঞ্জিত কক্স বাজারেই আবার ফিরে আসি। এর কাছেই রয়েছে এক বৌদ্ধগ্রাম রামু, যা দশ বছর আগে লন্ডভন্ড করে দেয় কট্টরপন্থী জামাত এবং অন্যান্য সংগঠন। হাসিনা সরকার তাকে নতুন করে গড়ে দিয়েছে। তৈরি করে দিয়েছে ১৩ ফুট উচ্চতার ব্রোঞ্জের বৌদ্ধমূর্তি। বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা জানালেন, তাঁরা আপাতত শান্তিতে।

বহু বছর আগে এখানে এসে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন কক্সবাজারে সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থ। তারই একটি পঙ্‌ক্তি— “চাকমার পাহাড়ি বস্তি, বুদ্ধমন্দিরের চূড়া ছুঁয়ে/ ডাকহরকরা চাঁদ মেঘের পল্লীর ঘরে ঘরে/ শুভেচ্ছা জানাতে যায়...।”

ইসলামিক রাষ্ট্রের গর্ভে আগুন জ্বালিয়ে জন্ম নেওয়া এবং বহু ঝড়জল পার হওয়া আজকের বাংলাদেশ এই ‘শুভেচ্ছা’র বার্তা, সহাবস্থানের বার্তাটুকুই পাঠাতে চায় ভারত তথা আন্তর্জাতিক স্তরে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement