নিজের শরীরের উপর মেয়েদের মালিকানা কোন সমাজ মানে?
Abortion Law

ভাষার আড়ালে অধিকার

আমেরিকার অবস্থানের প্রভাব সে দেশের বাইরেও পড়বে, এটা অবধারিত। তবে সে সব দেশ, সে সব সমাজ শূন্য পাতা খুলে বসে নেই।

Advertisement

অলকা মালওয়াদে বসু

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২২ ০৫:২৪
Share:

সহযোদ্ধা: গর্ভপাতের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার দাবিতে মিছিল। লন্ডন, ৯ জুলাই, ২০২২। ছবি: রয়টার্স।

গর্ভপাতের বৈধতা নিয়ে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট তার রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। কোনও মেয়ের অনিচ্ছায় তার গর্ভসঞ্চার হয়ে থাকলে গর্ভপাত করার সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে কি না, সে বিষয়ে রাজ্যগুলি এখন পৃথক ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ইতিমধ্যেই কানসাস, ইন্ডিয়ানার মতো রাজ্য সেই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে শুরু করেছে।

Advertisement

আমেরিকার অবস্থানের প্রভাব সে দেশের বাইরেও পড়বে, এটা অবধারিত। তবে সে সব দেশ, সে সব সমাজ শূন্য পাতা খুলে বসে নেই। মেয়েদের অধিকার, এবং গর্ভপাতের সুযোগ নিয়ে সব দেশেই নিজের নিজের মতো আলোচনা হয়েছে। যে সব দেশ গর্ভপাতে তেমন কড়াকড়ি করে না, সে সব দেশও যে খুব উদার অবস্থান নিয়েছে, এমন নয়। যে সব দেশে গর্ভপাত আইনত বৈধ, সে সব দেশও অনেক সময়ে মেয়েদের নিজের শরীর সম্পর্কে সিদ্ধান্তের অধিকার স্বীকার করে না। পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলি জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহারের সুযোগ দিত না, কিন্তু চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে গর্ভপাতকে জোরালো সমর্থন করত। চিনের সরকার এমন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করেছিল, যা একটি বা দু’টি সন্তান থাকলে মেয়েদের গর্ভপাত করাতে জোর করত। ভারতের পিতৃতন্ত্র মেয়েদের বাধ্য করে কন্যাভ্রূণ মোচন করতে। এ সবই মেয়েদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা, যা আপাত-উদার আইনের আড়ালে কাজ করে চলে।

অন্য দিকে, যে সব সরকার, সমাজ বা মহিলারা কিছু শর্তসাপেক্ষে গর্ভপাতের পক্ষে সওয়াল করেন, তাঁরা সকলেই যে গর্ভস্থ ভ্রূণের জীবনের অধিকারকে নস্যাৎ করছেন, এমনও নয়— যদিও তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা, অর্থাৎ আমেরিকার গর্ভপাত-বিরোধীরা, সে ভাবেই তাঁদের দেখাতে চান। সেই বিরোধীদের চরিত্র কেমন? ‘ক্যাথলিকস ফর ফ্রি চয়েস’ সংগঠনের সদস্যরা বার বার দেখিয়েছেন যে, যাঁরা গর্ভপাতের বিরোধী, তাঁরা নানা কারণে প্রায়ই প্রাণের অধিকার কেড়ে নেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন— তাঁরা অপরাধীদের প্রাণদণ্ডের সমর্থন করেন; বন্দুক কেনার অবাধ স্বাধীনতা দাবি করেন; বাকি বিশ্বের উপরে পুঁজিতন্ত্র, গণতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়ার অধিকারও চান। অথচ, তাতে যে কোনও স্ববিরোধ রয়েছে, এমনও মনে হয় না তাঁদের। তাই গর্ভস্থ শিশুর ‘বেঁচে থাকার অধিকার’ নিয়ে যাঁরা সরব, তাঁদের ‘শান্তিবাদী’ বলে দাবি করা কঠিন।

Advertisement

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বাইরে অন্যরা গর্ভপাত বিষয়ে তাদের নিজস্ব নৈতিক চিন্তাধারা অনুসরণ করে। যে সব সমাজ গর্ভপাতের প্রতি বিরূপ নয়, অতীতেও সহনশীল মনোভাবই দেখিয়েছে, সেখানেও গর্ভপাতের সিদ্ধান্তগ্রহণ সহজ নয়। কখনও রাষ্ট্রের বিপক্ষে, কখনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা অন্তত তার প্রবক্তাদের বিপক্ষে, কখনও বা নিজের ঘনিষ্ঠজনের বিপরীতে দাঁড়াতে হয়। তবে যে মেয়েরা গর্ভপাত করতে চান, তাঁদের সব চাইতে বেশি যুঝতে হয় নিজের অন্তরের দ্বন্দ্ব আর উদ্বেগের সঙ্গে।

গর্ভপাত-বিরোধীরা বেশির ভাগ সময়েই— জেনে বা না জেনে— ভাষার অস্পষ্টতাকে অস্ত্র করে। ডাক্তাররা যাকে এক কথায় বলেন ‘গর্ভপাত’ (‘অ্যাবর্শন’), নানা সংস্কৃতিতে তার জন্য রয়েছে অনেক বিচিত্র, অর্থসমৃদ্ধ শব্দাবলি। এই সব শব্দ কিছু প্রশ্নের চার দিকে ঘিরে-থাকা অনিশ্চয়তা এবং বিভ্রান্তির ফয়দা তোলে। যেমন, ১) ঋতুস্রাবে কত দেরি হলে তাকে গর্ভ বলা চলে? ২) গর্ভস্থ কোষগুলিতে কখন প্রাণসঞ্চার হয়? ৩) গর্ভ-অভ্যন্তরের প্রাণে কখন ‘আত্মা’ আসে?

আফ্রিকার নানা সংস্কৃতিতে ঋতুস্রাবে দেরি হওয়া মানে কেবল সেটুকুই— ঋতুস্রাবে দেরি। অন্য যে কোনও শারীরিক সমস্যার মতো এটাও একটা, সময়মতো যার চিকিৎসা না হলে বরং ভবিষ্যতে গর্ভসঞ্চারে বাধা আসতে পারে। গর্ভপাতকে অনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিতে আপত্তিকর বলেই দেখা হয়, কিন্তু জড়িবুটি খেয়ে বা কোনও যান্ত্রিক উপায়ে নিয়মিত ঋতুস্রাব ফিরিয়ে আনার সঙ্গে গর্ভপাতের কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয় না। তানজ়ানিয়াতে কোনও মাসে ঋতুস্রাব না হলে তার কারণকে বলা হয় ‘বালির কণা’, যা বাস্তবিক গর্ভে পরিণত হবে, কেবলমাত্র তা যদি শিশুর কোনও উপযুক্ত সম্ভাব্য পিতার সঙ্গে নিয়মিত যৌনসঙ্গম থেকে পুষ্টি পায়। যদি তেমন কোনও পুরুষ না থাকে, তা হলে ফের ঋতুস্রাব শুরু করার সঙ্গে কারও জীবন নেওয়ার কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয় না। আর উত্তর নাইজিরিয়াতে যদি বা ঋতুস্রাব না হলে তা গর্ভসঞ্চার বলে ধরা হয়, তা হলেও ফের ঋতু শুরু করানোকে মনে করা হয় গর্ভকে ‘ঘুম পাড়িয়ে রাখা’— আরও সুবিধাজনক কোনও সময়ে তাকে ফের জাগানো হবে।

ধর্মীয় বিধির নানা ধরনের ব্যাখ্যা করে নানা ব্যক্তি, নানা গোষ্ঠী। কখন গর্ভের ভ্রূণে আত্মা প্রবিষ্ট হয়, কখন তা ‘মানুষ’ বলে গণ্য করা যায়, সে বিষয়ে ক্যাথলিক চার্চ তার ইতিহাসে বার বার মত বদলেছে। বৌদ্ধ ধর্মে দু’টি ধারা দেখা যায়। দক্ষিণের কঠোর ‘থেরাবাদ’ যা এখনও শ্রীলঙ্কার মতো দেশের গর্ভপাত নীতি প্রভাবিত করে, এবং তুলনায় উদার মহাযান, বা উত্তরের ধারা, যাকে দেখা যায় কোরিয়া, জাপানে। হিন্দু ধর্মে অবশ্য নানা মুনির নানা মত— তাই কেন্দ্রে এবং বেশ কিছু রাজ্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ভারতের উদার গর্ভপাত নীতিতে এখনও পরিবর্তনের চেষ্টা হয়নি।

ইসলাম আইনশাস্ত্রের পাঁচটি ধারার মধ্যে চারটি গর্ভসঞ্চারের একেবারে গোড়ার দিকে— অর্থাৎ ‘আত্মা সঞ্চারিত হওয়ার আগে’— গর্ভপাতকে সরাসরি নিষিদ্ধ করে না। কখন আত্মার সঞ্চার হয়, সে বিষয়েও অবশ্য সহমত নেই। এই মতপার্থক্যের ফলে যে ফাঁকটুকু পাওয়া যায়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেডিক্যাল প্রযুক্তির শক্তি। ঋতু বন্ধের অল্প কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে ‘ঋতু নিয়মিতকরণ’ বা ‘মেনস্ট্রুয়াল রেগুলেশন’-এর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, সে দেশের মেয়েরা প্রজননতন্ত্র সম্পর্কে যথেষ্ট জানেন-বোঝেন— তাঁরা বিলম্বিত ঋতু এবং সম্ভাব্য গর্ভের মধ্যে ভালই পার্থক্য করতে পারেন। তবু ‘গর্ভপাত’ না বলে তাঁরা বলেন ‘ঋতু নিয়মিতকরণ’।

আইন যখন এমন নানা উপায়ে বিরুদ্ধাচরণও কঠিন করে দেয়, তখন অন্যান্য উপায় দেখা যায়, কারণ প্রায় সব সমাজে গর্ভপাতের প্রয়োজন প্রায় অবধারিত ভাবে অনুভূত হয়। হয় অবৈধ গর্ভপাত আকছার হচ্ছে জেনেও রাষ্ট্র ব্যবস্থা করা থেকে বিরত থাকে, না হলে বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসে পরিষেবা দিতে— কখনও তা আর্থিক লাভের আশায়; কখনও আদর্শের জন্য (যেমন শ্রীলঙ্কায়); আর না হলে কোনও স্থানীয় হকার ‘টনিক’ বিক্রি করেন মেয়েদের, আর বার বার এই বলে নিষেধ করে দেন যে, গর্ভবতী মেয়েরা যেন কিছুতেই না খান সেই ‘টনিক’, কারণ তা হলে গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে!

অর্থাৎ, গর্ভপাতের সিদ্ধান্তকে ঘিরে যে সব পরস্পর-বিরোধী অনুভূতি কাজ করতে পারে, সেগুলি সম্পর্কে প্রত্যেকটি সংস্কৃতিই যথেষ্ট অবগত। তারা নানা যুক্তি তৈরি করেছে, যাতে সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অস্বস্তি কমতে পারে। একই সঙ্গে, গর্ভপাতের সপক্ষে নৈতিক যুক্তি থাকার মানে এই নয় যে, তা দিয়ে যে কোনও ‘পাপ’ করা যায়। ক্যাথলিক সংস্কৃতির বাইরে বেশ কিছু সমাজে গর্ভপাতের উপর কোনও স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা নেই।

আমেরিকায় ভাষাকে যে ভাবে ব্যবহার করা হয় নৈতিক এবং রাজনৈতিক লাভের জন্য গর্ভপাতের বিরোধিতা করতে, তা এই অদ্ভুত শব্দচয়ন থেকেই বোঝা যায়— প্রো-চয়েস অর্থাৎ নির্বাচন-পক্ষীয়, বা প্রো-লাইফ অর্থাৎ জীবন-পক্ষীয়। আমেরিকার রাজনৈতিক বিতর্ক হয়তো অনেক লাভবান হবে, যদি তা গর্ভপাত বিষয়ে আমেরিকার বাইরের নানা সংস্কৃতির নৈতিক অবস্থানকে বিবেচনা করে। আরও বাস্তববাদী দৃষ্টিতে গর্ভপাতকে দেখতে এর প্রয়োজন আছে। যে ভাবে গর্ভপাতকে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে এনে ফেলেছে আমেরিকা, তা থেকে সরা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে, যে দুনিয়ায় আমেরিকা অন্য সব দেশের নীতি নির্ধারণ করতে চায় অর্থ আর পেশিশক্তি দিয়ে, সেখানে এটা প্রয়োজন। যদি অন্যান্য দেশের উপর আধিপত্যের এই চেষ্টা তাদের সংস্কৃতিতে গর্ভপাতের প্রতি মনোভাব সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত না হয়, ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনের পরে মেয়েদের যৌনতা ও প্রজননের স্বাধিকারে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তার অনেকটাই আমরা হারাব। এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির জন্য যে সহায়তা মিলছিল, তার অনেকটাই আমরা হারাব কেবল এই দেশগুলি গর্ভপাত বিষয়ে আমেরিকার সরকারের ধারণা অনুসরণ করে না বলে। এ ভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ সঙ্কুচিত হলে তাতে হিতে বিপরীত হবে। অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব নিয়ে আরও বেশি সংখ্যায় মহিলারা যাবেন গর্ভপাত করাতে।

কর্নেল ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement