দুঃশাসক: ছাওয়া ছবিতে ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায় অক্ষয় খন্না।
শিবাজিপুত্র সম্ভাজিকে নিয়ে নির্মিত লক্ষ্মণ উতেকরের ছাওয়া ছবিটিতে সম্ভাজির বীরত্ব ও ধার্মিকতা এবং ধর্মান্ধ ঔরঙ্গজেবের অত্যাচারে তাঁর মৃত্যুর কাহিনি দেখে শুরু হয়েছে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উন্মাদনা। সিনেমাটির সমালোচনা ও ঔরঙ্গজেবের প্রশংসা করার জন্য মহারাষ্ট্র বিধানসভা থেকে সাসপেন্ড হতে হয়েছে, ক্ষমা চাইতে হয়েছে সমাজবাদী পার্টির বিধায়ক আবু আজমিকে। ঔরঙ্গজেবের সমাধি উপড়ে ফেলার দাবি উঠেছে, নাগপুরে ঘটে গিয়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। সিনেমায় দেখা গুপ্তধনের খোঁজে আসিরগড় দুর্গের কাছে খোঁড়াখুঁড়ি করতে বেরিয়ে পড়েছে মানুষ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী-সহ শাসক বিজেপির বহু নেতা-মন্ত্রী এই সিনেমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সংসদেও সিনেমাটি দেখানোর উদ্যোগ করা হচ্ছে।
স্বাভাবিক ভাবেই ইতিহাস-সচেতন মানুষ তুলে ধরেছেন শিবাজি সাওন্তের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটির নানা ঐতিহাসিক বিচ্যুতি। এক ব্রাহ্মণীর উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগে সম্ভাজিকে স্বয়ং শিবাজির পানহালা দুর্গে বন্দি রাখা, শিবাজির বিরুদ্ধে মোগল সেনাপতি দিলের খাঁ-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে সম্ভাজির ষড়যন্ত্র, ভাই রাজারামের সমর্থকদের নৃশংস হত্যা— উঠে এসেছে এ সব কথাও। যাঁরা এত কাল ‘বামপন্থী ইতিহাসবিদ’দের লেখা না পড়ে রমেশচন্দ্র মজুমদার-যদুনাথ সরকারের মতো ‘জাতীয়তাবাদী’ ইতিহাসবিদদের লেখা পড়ার বিধান দিতেন, তাঁরা অবাক হয়েছেন যে রমেশচন্দ্রের বয়ানে সম্ভাজি ‘দুশ্চরিত্র যুবক’, যদুনাথের লেখায় ‘শিবাজির বৃদ্ধ বয়সের অভিশাপ’। মরাঠা সাহিত্যে সম্ভাজির মদ্যপান ও লাম্পট্যের ধারণা এতটাই সুপ্রচলিত যে, গোলওয়ালকর ও সাভারকরও তার উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসবিদ স্টুয়ার্ট গর্ডন দেখিয়েছেন যে, মরাঠি সাহিত্যের বয়ানও অতিরঞ্জিত। যদিও সম্ভাজির উপর বিরক্ত হয়েই শিবাজি তাঁর ও রাজারামের মধ্যে রাজ্য ভাগ করে দিতে চেয়েছিলেন। বাংলায় মরাঠা বর্গিদের লুটপাট ও গণধর্ষণ সম্ভাজির সময়ের অনেক পরের ঘটনা হলেও যদুনাথ মনে করিয়ে দেন যে, গোয়া আক্রমণের সময়ে সম্ভাজিই মরাঠা সৈন্যদের অবাধ লুটতরাজ ও গণধর্ষণের অনুমতি দিয়েছিলেন। যদুনাথের মতে, সভাসদদের অনুরোধে ঔরঙ্গজেব সম্ভাজিকে হত্যা না করতে নিমরাজি ছিলেন, যদি সম্ভাজি তাঁর লুকানো ধনসম্পত্তির হদিস ও মোগলদের বিরুদ্ধে মরাঠাদের গোপনে সাহায্য করা ব্যক্তিদের নাম বলে দিতেন— কিন্তু জবাবে সম্ভাজির মহম্মদকে নিয়ে কটূক্তি এবং সম্রাটের মেয়েকে নিয়ে অশালীন প্রস্তাবই তাঁর নৃশংস মৃত্যু নিশ্চিত করে! এ-হেন সম্ভাজির উপর নির্মিত সিনেমা এতটা অভিঘাত কী করে তৈরি করল? এর উত্তর সম্ভবত নিহিত সম্ভাজির নায়কত্বে নয়, ঔরঙ্গজেবের খলনায়কত্বে।
স্কুলপাঠ্য ইতিহাস যখন সাম্প্রদায়িক ইতিহাস-বিকৃতির কবলে পড়েনি, তখনও স্কুল স্তরের বইগুলি নায়ক বনাম খলনায়কের অতিসরলীকরণ এড়াতে পারেনি। উদার আকবরের বিপরীতে সাম্প্রদায়িক ঔরঙ্গজেব, সমন্বয়বাদী দারাশিকোর প্রতিদ্বন্দ্বী মৌলবাদী ঔরঙ্গজেবের কাহিনি পড়ে বেড়ে ওঠা মানুষের কাছে নৃশংস ধর্মান্ধ ঔরঙ্গজেবের গল্প সহজেই বিশ্বাসযোগ্য। অথচ, ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় গোঁড়ামিকে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হিসাবে দেখান যিনি, সেই যদুনাথের বয়ানে ঔরঙ্গজেব এক জটিল চরিত্র— “ঔরঙ্গজেবের জীবন ছিল এক দীর্ঘ ট্র্যাজেডি— অদৃশ্য ও অবশ্যম্ভাবী ভবিতব্যের বিরুদ্ধে এক জন মানুষের ব্যর্থ লড়াইয়ের কাহিনি, যুগের শক্তির সামনে মানুষের প্রবলতম চেষ্টারও হেরে যাওয়ার গল্প। পঞ্চাশ বছরের দৃঢ়তম শাসনের অবসান ঘটে এক বিপুল ব্যর্থতায়। অথচ এই রাজা বুদ্ধি, চরিত্র, ও প্রচেষ্টায় ছিলেন এশিয়ার শ্রেষ্ঠ শাসকদের এক জন।”
পরবর্তী কালের ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র দেখিয়েছেন যে, ঔরঙ্গজেব যখন রাজা হন, আকবরের গড়ে তোলা সাম্রাজ্য-কাঠামোর মেরুদণ্ড মনসবদারি-জায়গিরদারি ব্যবস্থা ছিল সঙ্কটাপন্ন। ইরফান হাবিব বলেছেন কৃষি-সঙ্কটের কথা। তার উপর, রক্তক্ষয়ী উত্তরাধিকারের লড়াইতে শাহজাহানের মনোনীত উত্তরসূরি দারাশিকোর পিছনে ছিল শিয়া, সুফি ও হিন্দু জনসমাজের বিশাল অংশের সমর্থন। ঔরঙ্গজেবকে তাই রাজনৈতিক সমর্থন খুঁজতে হয়েছে রক্ষণশীল সুন্নি মুসলিমদের থেকে। কিন্তু জীবিত বাবা শাহজাহানকে বন্দি করে ঔরঙ্গজেবের ক্ষমতা দখলকে ইসলামবিরোধী বলে মনে করেছে মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ। সাম্রাজ্য যত সঙ্কটাপন্ন হয়েছে, ঔরঙ্গজেব তত গোঁড়া মুসলমানদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন। অথচ মেবারের রানা রাজসিংহকে লেখা চিঠিতে ঔরঙ্গজেব বলেছিলেন যে, সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই শাসনব্যবস্থার ভিত্তি। আতহার আলি দেখিয়েছেন, ঔরঙ্গজেবের সময় প্রশাসনে হিন্দুরা ছিল ৩১% (আকবরের সময়েও সংখ্যাটা ছিল ২২-২৩%)। জীবনের শেষ দশকে ঔরঙ্গজেবের প্রধান তিন সেনাপতিই ছিলেন হিন্দু— রামসিংহ হাডা, দলপত বুন্দেলা, জয়সিংহ। ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে দারাশিকোকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও তাঁর লেখাগুলি পোড়াননি ঔরঙ্গজেব। বরং, দিদি জাহানারাকে চালিয়ে যেতে দিয়েছেন দারার চিন্তাধারা অনুযায়ী ধর্মচর্যা। বহু হিন্দু ও জৈন মন্দির প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা যে ঔরঙ্গজেব করেছিলেন, তার খতিয়ানও দিয়েছেন অড্রে ট্রুশকে।
১৬৬৪-তে শিবাজির বিদ্রোহ ও পর পর রাজনৈতিক সঙ্কটে দীর্ণ ঔরঙ্গজেব ধর্মীয় মৌলবাদের হাত ধরেছেন বার বার। রাজা হওয়ার দুই দশক পর হঠাৎ অ-মুসলিম প্রজাদের উপর জিজিয়া কর ফিরিয়ে এনে প্রাপ্ত অর্থ ধর্মগুরুদের হাতে তুলে দিয়েছেন। পট্টভি সীতারামাইয়ার উদ্ধৃত কিংবদন্তি যতই বলুক বারাণসীতে মন্দির ধ্বংসের কারণ ছিল পুরোহিতদের হাতে এক হিন্দু রানির ধর্ষণ, মাধুরী দেশাই-সতীশ চন্দ্র-ক্যাথরিন অ্যাশার-অনিকেত ছেত্রীরা দেখিয়েছেন, ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির চালিকাশক্তি ছিল রাজনীতি। রাজসিংহাসনে বসেই যে বারাণসীর মন্দিরগুলির ও ব্রাহ্মণদের নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেখানেই জ্ঞানবাপী মন্দির ধ্বংস করেছেন তিনি। পরের বছর মথুরার কেশবদেব মন্দির ধ্বংস করেছেন। বেশির ভাগ পুরনো মন্দির অক্ষত রাখলেও নিষিদ্ধ করেছেন নতুন মন্দির নির্মাণ। শরিয়তি যুক্তিতে রাজদরবারে হোলি-মহরম-দেওয়ালি-নওরোজ পালনে রাশ টানা, বাদশার সামনে সঙ্গীতে বা রাজসভায় অভিজাতদের বিলাসব্যসনে নিষেধাজ্ঞা জারি আর্থিক সঙ্কটে ধুঁকতে থাকা মোগল রাজসভার ব্যয়ভারও কমিয়েছে।
অথচ, তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক সহযোগী জয়সিংহ ১৬৮০-তে বারাণসীতেই নতুন বিশ্বনাথ মন্দির নির্মাণ করলে ঔরঙ্গজেব বাধা দেননি। শিখ সাধক রাম রাইকে ঔরঙ্গজেবের দেওয়া জমির উপরেই গড়ে উঠেছে দেহরাদূন শহরটি। হিন্দু ও শিখদের সঙ্গে সংঘাতের সময়েও জৈন ব্যবসায়ীরা অর্থের জোগান দিয়েছেন তাঁকে। উপনিষদ ও কোরানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে দারাশিকো যে অভিন্ন একেশ্বরবাদের স্বপ্ন দেখছিলেন, নিরীশ্বরবাদী জৈনরা তাতে আগ্রহী হননি। বরং ভগবতীদাস, রামচন্দ্র, জগৎ রাইয়ের মতো জৈন কবিরা ঔরঙ্গজেবের সুশাসন ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রশংসা করেছেন! দুর্নীতিপরায়ণ তানাশাহের লুকানো সম্পত্তি উদ্ধার করতে মসজিদ ভাঙতেও পিছপা হননি ঔরঙ্গজেব। ব্যয় কমিয়েছেন ইদের সমারোহেও। ধর্মগুরুদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে লড়াই করেছেন মুসলমান-শাসিত বিজাপুর ও গোলকোন্ডার সঙ্গে।
রাজনীতির প্রয়োজনের বাইরে কতটা অসহিষ্ণু ছিলেন ঔরঙ্গজেব? ব্যঙ্গকৌতুকশিল্পী নিয়ামত খান মোগল অভিজাত কামগর খানকে নিয়ে অশ্লীল কবিতা লিখলে কামগর তাঁর শাস্তি চান। ঔরঙ্গজেব বলেন, নিয়ামত তাঁকেও ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি। পুরস্কার দিয়েও তাঁকে হাত করা যায়নি। কৌতুকশিল্পীকে শাস্তি দেওয়া যায় না— তাঁকে দেখা উচিত এমন এক বন্ধু হিসাবে যিনি ঘনিষ্ঠও হবেন না আবার ছেড়েও যাবেন না! শাহজাহানের ব্যয়বহুল সমাধি-নির্মাণে বীতশ্রদ্ধ ঔরঙ্গজেব চেয়েছিলেন অনাড়ম্বর, কাঁচা মাটির সমাধি। পরবর্তী কালে লর্ড কার্জ়ন সেখানে বসান স্মারক ফলক— এই সমাধি সব থেকে বেশি দিন ভারত শাসন করা সম্রাটের! ঔরঙ্গজেবের সমাধি ভাঙলে মৃত সম্রাটের কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। আবারও ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষা করতে না পারার লজ্জা জুটবে আধুনিক ভারতের।
ঔরঙ্গজেবের মৌলবাদ-তোষণের রাজনীতি তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চোখে তাঁকে করে তুলেছিল সাম্প্রদায়িক শক্তির মদত দাতা। যে যুগসঙ্কটে ঔরঙ্গজেব রাজা হয়েছিলেন, তা সামলাতে বিদ্বান কিন্তু বিলাসব্যসন ও শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় নিমগ্ন দার্শনিক দারাশিকো হয়তো পারতেন না। কিন্তু দক্ষতর প্রশাসক ও যোদ্ধা, ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নাস্তানাবুদ করা ঔরঙ্গজেবও পারেননি সাম্রাজ্যকে সুরক্ষিত করতে, আকবরের মতো প্রজাদের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠতে। শেষ বয়সে পুত্র আজম শাহের কাছে নিজেই স্বীকার করেছেন যে শাসক হিসাবে তিনি ব্যর্থ। তিনশো বছর আগের রাজতন্ত্রের ব্যর্থ সম্রাটের দায়ভার আজকের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু মানুষের উপর চাপানো অযৌক্তিক। বরং ঔরঙ্গজেবের ইতিহাস মনে করায় নাদিম রেজাভির সতর্কবার্তা, “ঔরঙ্গজেব শাসক হিসাবে নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে চেয়েছিলেন ধর্মকে হাতিয়ার করে— পারেননি। এটা সমস্ত শাসকের জন্যই একটা শিক্ষা।”
ইতিহাস বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়