অনেক দিন থেকেই একটা প্রশ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছে— রাজনৈতিক জনমত গঠনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার গুরুত্ব কি নিম্নমুখী? আমেরিকায় যেমন দিনের পর দিন ট্রাম্প সাহেবের বিভিন্ন মতামতকে তুলোধুনা করেছেন সংবাদমাধ্যম এবং বুদ্ধিজীবীরা, তেমন কিছু হয়নি অনেক দিন। এমনকি গত নির্বাচনেও অনেকেই তাঁকে ভোট দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে হয়তো অনেকেই অতিমারিতে শঙ্কিত না হয়ে ভ্যাকসিন নিচ্ছেন না এবং সামাজিক সুরক্ষাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাচ্ছেন।
আমাদের দেশে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীকে জেলে আটক করে রাখা হয়েছে— ‘আরবান নকশাল’ নাম দিয়ে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ঘোষিত হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু সব ছাপিয়ে যে সমস্যা, তা খানিকটা এই রকম— সমালোচনার ঝড় ‘আমরা’ই তুলছি ‘আমরা’ই শুনছি, ‘আমরা’ই ধিক্কার দিচ্ছি। তবুও আঞ্চলিক ভাষায় একটু লেখালিখি হলে এক রকম, ইংরেজিতে হলে তো কথাই নেই। অনেকটা আমেরিকা মুলুকের বড় বড় পত্রিকার মতো অবস্থা। নামীদামি লোকে লিখছেন, তর্ক করছেন, সেমিনার হচ্ছে, প্রতিবাদ হচ্ছে, মোমবাতি জ্বলছে— ও দিকে ট্রাম্প সাহেব সমানে জনসমর্থন পেয়েছেন।
একটি দৈনিকে পড়লাম, উত্তরপ্রদেশের আগামী নির্বাচনে, মোটামুটি ভাবে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ছাড়া প্রায় সর্বত্র অনেকেরই প্রধানমন্ত্রী মোদীর উপর এখনও আস্থা আছে— তাঁরা সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং বিদ্যুৎ, এই তিনটে পেয়ে খুশি। কী থেকে সুরক্ষা, তাঁদের নিরাপত্তা মানে কী, এ সব নিয়ে তাঁদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই, কারণ তাঁরা তাঁদের মতো করে বোঝেন। সমস্যাটা আমাদের। যে যে ব্যাপারে সরকার বারংবার সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে বুদ্ধিজীবী এবং প্রতিবাদী সংবাদমাধ্যমগুলোতে, সেই সব বিষয়ে সাধারণ মানুষ কী ভাবছেন, তা জানা হচ্ছে না। উত্তরপ্রদেশের উদাহরণটি তাই প্রাসঙ্গিক।
সাধারণ মানুষের আলোচনায় আরবান নকশালদের কথা নেই; উচ্চশিক্ষার সিলেবাসে হিন্দুত্ব সংক্রমণের কথা নেই; মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কথা নেই, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি লঙ্ঘনের আলোচনা নেই; সংখ্যালঘু নিপীড়নের কথা নেই, কাশ্মীর প্রসঙ্গ নেই; এলআইসি এবং ব্যাঙ্কের শেয়ার, বা অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রির কথা নেই। অথচ, এর মধ্যে অনেক বিষয়ই বাস্তব এবং ভয়ানক সমস্যা।
আমরা যারা সমাজের উচ্চকোটির বাসিন্দা, তারা এই সব নিয়ে লিখে, আলোচনা করে, চায়ের কাপে তুফান তুলে, বিদেশি প্রেসে সমালোচনার ঝড় তুলে, ইন্টারভিউের পর ইন্টারভিউ দিয়ে, টিভির সান্ধ্য-আসর জমজমাট করে তুলছি। এটা আদর্শ নাগরিকের কর্তব্য, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, সমাজকে যদি ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’, এই দু’ভাগে ভাগ করে নিই— সচেতন উচ্চকোটির মানুষ ‘আমরা’, এবং অন্যান্যরা ‘ওরা’— তা হলে প্রশ্ন হল, আমাদের চোখে যেটা সমস্যা, ওদের চোখে সেটা সমস্যা হিসাবে ধরা দেয় না কেন? আমাদের গণতন্ত্রের তথা পৃথিবীর গণতন্ত্রের এ এক বিরাট সমস্যা। বৌদ্ধিক সমস্যা আসলে জনমতকে কার্যকর ভাবে প্রভাবিত করতে পারছে না। আমাদের তোলপাড় করা আলোচনায় ব্যালট বাক্স প্রভাবিত হচ্ছে না।
খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, ওই সমস্যাগুলোকে নিজেদের সমস্যা ভাবতে গেলে মানুষের যে ন্যূনতম প্রাপ্তির প্রয়োজন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তা থেকে বঞ্চিত। তাই অনেক আলোচনাই তাঁদের কাছে অবান্তর। সরকার যদি বলে যে, ব্যাঙ্কে পাঁচ লক্ষ টাকার বেশি আমানতের সুরক্ষার দায় তারা নেবে না— ব্যাঙ্কে যাঁর দশ হাজার টাকাও নেই, এই ঘোষণায় তাঁর কী বা আসে যায়? মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে আমরা যেটা বুঝি, সেটা অনেকেরই নেই, ছিল না কোনও দিন। স্ত্রী কথা না শুনলে তাকে দু’চার ঘা দেওয়ার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই, এই ভয়ঙ্কর কথাটাতে দেশের এত লোক বিশ্বাস করেন যে, শুধু তাঁদের ভোটেই সরকার তৈরি হয়ে যেতে পারে। অন্য দিকে, সেই অত্যাচারিত মহিলাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য যে সচেতন মহিলারা কাজ করছেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গে এক টেবিলে বসে চা খাওয়ার অধিকার এত দিনেও সেই মহিলারা অর্জন করতে পারেননি। উন্নয়নের নীতি নিয়ে আয়োজিত কোনও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমরা কখনও কোনও অনুন্নয়নতাড়িত মানুষকে নিমন্ত্রণ করি না।
মানুষ আসলে কী চান, সেটা বোঝেন রাজনীতির সফল মানুষেরা। সারা পৃথিবীতে পিছিয়ে-পড়া মানুষ এই সময়ের লাভক্ষতির হিসাব করেন, কারণ ভবিষ্যতের সুদিন নিয়ে ভাবার সময় তাঁদের নেই। তাই রুজি-রোজগার ছাড়া, দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়া এবং নিজের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করে সমাজে একটু উচ্চ জায়গায় পৌঁছনোর স্বপ্ন ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবনাচিন্তা বিলাসিতামাত্র। হয়তো তাঁদের কাছে মৌলিক অধিকার একটি ভোট দেওয়ার অধিকার আর সরকারি অনুদান পাওয়ার অধিকার।
জটিল মতামতকে রাজনীতির মাধ্যমে ব্যালটের ভোটকে এ পাশ-ও পাশ করে দেওয়ার মতো জনমত গঠনে কার্যকর করার জন্য দরকার তেমন রাজনীতির মানুষ। যাঁরা বৌদ্ধিক মতামতের দাম তখনই দেবেন, যদি তাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা বাড়ে। অর্থাৎ, সেই মতামত জনগণের কাছে চট করে পৌঁছে দেওয়া যায়, জনগণ আত্মস্থ করতে পারেন, নচেৎ নয়।
‘আমরা’ যখন মনে করছি যে, চুলচেরা তত্ত্ব, তথ্য, দর্শন দিয়ে নির্মিত আদর্শ মতামত তৈরি করে দিচ্ছি, ‘ওরা’ আমাদের চেয়ে তত দূরে সরে যাচ্ছে। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ যাঁরা, তাঁরা হয়তো বিশ্বাস করেন যে, মোদীজি তাঁদের বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন, অদৃশ্য শত্রুর থেকে সুরক্ষিত রাখছেন, আর বিজলি দিচ্ছেন, আর তা হলেই তাঁদের হল। এই রাজ্যের মানুষ ঠিক একই ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আঁকড়ে ধরেছেন, কারণ রাজ্য সরকার তাঁদের উপকারের জন্য একের পর এক প্রকল্প জড়ো করে দিচ্ছে।
আর একটা ব্যাপার আমরা দেখেও দেখি না— ভারত একটা দেশই নয়; বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, কখনও স্বার্থের একই সূত্রে বাঁধা, কখনও নিজেদের একেবারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত একটা বিশাল প্রায় অসম্ভব সমঝোতার নাম ভারত। এক কালে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, এ দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ইউরোপকে নকল করা উচ্চ শ্রেণির আন্দোলন বিশেষ। আর আসলে এক জাতি এক প্রাণ আখ্যা যাকে দিচ্ছি তা বহুধাবিভক্ত এক ধারণা। অনেকেই ভাবেন যে, ছত্তীসগঢ়ে কী হচ্ছে, তাতে আমার কী আসে যায়। আবার, সৈনিক মারা গেলে তাঁদের ভীষণ দুঃখ হতেই পারে— হাজার হোক তাঁরা তো আমাদের প্রাণ রক্ষার জন্য নিয়োজিত। এটা সাদামাটা সত্য। ঐতিহাসিক বিবর্তনের গল্প যতই আসল কারণ হোক না কেন, মজুরের স্বার্থে হলেও দুনিয়ার মজদুর জীবনে এক হতে পারেননি, পারবেনও না। কারণ, অর্থনৈতিক স্বার্থ বিপরীত দিকে দৌড়তে থাকবে। চিনে শ্রমিকেরা গরিব না হলে আমেরিকার শ্রমিকেরা কম দামে জিনিস পাবেন না। অর্থনীতিতাড়িত সংগ্রাম যত প্রখর হবে, ততই মানুষ নিজের নিজের সমস্যাকে আঁকড়ে ধরবে। যদি সমস্যাগুলো এক রকম হয়, তখন খানিকটা এক দেশ এক জাতি মনে হবে, যেমন কৃষি সংস্কার আইনের বিরোধিতা। বা একশো দিনের কাজের চাহিদা। কিন্তু একে সংরক্ষিত করলে আর ওকে না করলে, চুলোয় যাক দেশের ঐক্য।
সমাজ মাধ্যাকর্ষণের মতো অলঙ্ঘনীয় পথ ধরে মতামত তৈরি করতে পারে না। মানুষ প্রকৃতির মতো স্থিতধী নয়। আজকে এটা চাই, কালকে ওটা। আজকে গলায় গলায়, কাল চুলোচুলি। বৌদ্ধিক চিন্তাধারা-চর্চিত দর্শন রাম-শ্যাম-রহিম-রাসুল সবাইকে একটা কাম্য পথের কথা বলতে চায়। কিন্তু তাঁরা সবাই সময়বিশেষে এককাট্টা আর অন্য সময়ে বিনা যুদ্ধে একে অপরকে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়তে চান না। আর যাঁরা অন্যদের পথ দেখানোর ভাল-মন্দের ফারাক করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের ভাল মন্দের ধ্যানধারণা ওঁদের ধারণার সঙ্গে মিলছে না। দেশে এমন নেতা-নেত্রীর প্রয়োজন, যাঁরা সব্যসাচী হবেন— কিছু গভীর দর্শন-অনুপ্রাণিত সমস্যাকে সমস্ত জনগণকে বোঝাতে পারবেন, আবার ভোটেও জিততে পারবেন। কিন্তু যে মানুষ আজ আর কালের গল্প ছাড়া কিছু ভাবতে পারেন না, চান না, তাঁদের পরশুর গল্প শোনাবেন কী করে?