পশ্চিমবঙ্গের স্কুল শিক্ষার অচল অবস্থা নিয়ে বড় রকমের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আলোচনায় অচিন চক্রবর্তী ও অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
Education

আমরা কি যথেষ্ট ভাবছি?

শিক্ষার গুরুত্ব কোথায়, ‘সোশ্যাল গুড’ হিসেবে কেন সেটা এতটা মূল্যবান, কী ভাবে শিক্ষার ভেঙে-পড়া হালটাকে আবার গুছিয়ে তোলা সম্ভব?

Advertisement

অচিন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২২ ০৪:৫২
Share:

অনির্বাণ: কয়েক সপ্তাহ আগে একটি আলোচনায় তুমি বলেছিলে, পশ্চিমবঙ্গের স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে যা হচ্ছে, তা নিয়ে তুমি খুব ব্যথিত বোধ করছ। তখন রাজ্য সরকার হুকুম জারি করেছে, নির্ধারিত সময়ের দু’সপ্তাহ আগেই স্কুলে গরমের ছুটি দিয়ে দিতে হবে, এমনকি যে-সব বেসরকারি স্কুল এই নির্দেশের পরেও চলছিল, সরকার থেকে তাদের ধমক দেওয়া হয়েছিল। এমন কাণ্ড ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ বোধ করার পক্ষে যথেষ্ট কারণ বইকি। এমনিতেই আমাদের রাজ্যে বহু স্কুলে লেখাপড়ার হাল ভাল নয়, তার উপর দু’বছর ধরে গোটা শিক্ষার আয়োজনটা নয়ছয় হয়ে গেছে, সবেমাত্র পঠনপাঠন শুরু হয়েছে, কোথায় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এত দিনের ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব এবং যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করার চেষ্টা করা হবে, প্রয়োজনে গরমের ছুটির সময়টাকেও কী ভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে ভাবা হবে, তার জায়গায় দু’দিন বেশি গরম পড়েছে বলে স্কুলের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হল? এমন উল্টোরথের যাত্রা দেখে তখন আমরা হতবাক এবং উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম। কিন্তু এ-বার যা ঘটল, সেটা তো যেন সমস্ত বোধবুদ্ধির বাইরে! অনর্থক প্রলম্বিত গ্রীষ্মাবকাশ শেষ হওয়ার মুখে সরকারি নির্দেশ জারি হল— প্রচণ্ড গরমের কারণে ছুটি চলবে আরও প্রায় দু’সপ্তাহ, স্কুল বন্ধ থাকবে কার্যত জুনের শেষ অবধি। অথচ ইতিমধ্যেই পূর্বাভাস শোনা গেছে যে দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা আসন্ন। উত্তরবঙ্গে তো প্রবল বর্ষণ শুরু হয়েছে কয়েক দিন আগে থেকেই। এই অবস্থায় গরমের ছুটি টেনে আরও লম্বা করার মানে কী? বিশেষ করে যখন এর ফলে লেখাপড়ার বিপুল ক্ষতি বিপুলতর হবে! একটা সরকার ক্রমাগত এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে কেন, যার ফলে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রচণ্ড ক্ষতি হয়? এটা কি নিছক শিক্ষার প্রতি ঔদাসীন্য? না কি এর পিছনে বা গভীরে অন্য কোনও কারণ আছে?

Advertisement

অচিন: এর চটজলদি উত্তর নেই আমার কাছে। তবে আমার বিশ্বাস, জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার এমন কিছু করবে না যার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সরকারের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠেন। তবে কি ধরে নেব তুমি বা আমি স্কুল বন্ধ রাখার এই সিদ্ধান্তে যতটা বিচলিত হচ্ছি, এক জন গড় নাগরিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যাকে বলে ‘মিডিয়ান ভোটার’, তিনি হচ্ছেন না? যদি হতেন তা হলে তো স্কুল চালু রাখার তীব্র দাবি উঠতে দেখতাম। তার মানে কি অধিকাংশের কাছে শিক্ষার গুরুত্ব নেই? কিন্তু তা-ই বা বলি কী করে! শিক্ষাকে তো আমরা একক ভাবে সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের দিক থেকে অবশ্যই গুরুত্ব দিই। বস্তুত যারপরনাই গুরুত্ব দিই। আমি তো চাই আমার সন্তান শ্রেষ্ঠ শিক্ষাটুকু পাক, যা তাকে অন্য পাঁচ জনের থেকে কেরিয়ারের দৌড়ে এগিয়ে রাখবে। আর এই চাওয়ার প্রকৃতি এবং তীব্রতাটা যে হেতু আর্থ-সামাজিক বৈষম্য অনুসারে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে আলাদা, তাই শিক্ষার ‘সোশ্যাল গুড’-এর প্রকৃতিটা মাথা তুলতেই পারে না। এই দৌড়ে জেতার প্রবৃত্তির সঙ্গে শিক্ষার সোশ্যাল গুড চরিত্রের সম্পর্ক যেন সরাসরি সংঘাতের। ফলে শিক্ষা একান্ত ভাবে একটি ‘প্রাইভেট গুড’ হয়ে থেকে যায়, যা সাধ্যমতো বা সাধ্যের বাইরে গিয়েও অর্থব্যয় করে কিনতে হয়। যাঁরা একাধিক প্রাইভেট টিউটর দিয়ে সন্তানকে পরীক্ষায় ভাল ফলের উপযুক্ত করে তুলতে পারছেন, তাঁদের কাছে সরকারি স্কুলের ভালমন্দের গুরুত্ব স্বভাবতই কমে এসেছে। আশঙ্কা হয়, সরকারের কিছু অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষার এই সমান্তরাল জোগান ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীলতা বাড়তেই থাকবে। এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স। এক দিকে সরকার শিক্ষাকে গ্রহীতার কাছে ব্যয়ভারহীন করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ব্যয় লাঘব করে দিয়েছে— অবৈতনিক শিক্ষা থেকে সাইকেল বিতরণ। অন্য দিকে, বিদ্যাশিক্ষার জন্যে সরকারি স্কুলের পঠনপাঠনকে অভিভাবকরা তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না, যদিও পশ্চিমবঙ্গে এখনও প্রায় ৮৮ শতাংশ ছেলেমেয়ে সরকারি স্কুলে নথিভুক্ত, যা অন্য প্রায় সব রাজ্যের তুলনায় বেশি।

অনির্বাণ: এখান থেকে নানা প্রশ্ন ওঠে। প্রথমত, ‘সোশ্যাল গুড’ হিসাবে শিক্ষার মূল্য যে প্রচুর, অর্থাৎ ব্যক্তি শিক্ষিত হলে যে কেবল ব্যক্তির উন্নতির সম্ভাবনাই বাড়ে না, সমাজের সামগ্রিক উন্নতির পথও প্রশস্ত হয়, সেটা তো কার্যত সর্বত্র এবং সর্বদাই দেখা গেছে। তা সত্ত্বেও জনশিক্ষার প্রশ্নে আমাদের ‘শিক্ষিত’, ‘এগিয়ে-থাকা’ নাগরিক সমাজে এতটা ঔদাসীন্য কেন? এর পিছনে অসাম্যের— কেবল আর্থিক অসাম্য নয়, বৃহত্তর অর্থে সামাজিক অসাম্যের একটা বড়সড় ভূমিকা আছে বলে মনে হয়। পশ্চিমবঙ্গে ‘ভদ্রলোক’-এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্য ঐতিহাসিক ভাবে, অন্তত সাম্প্রতিক অতীত পর্যন্ত, অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় অনেকটাই বেশি। বৃহত্তর জনসমষ্টি থেকে এই শ্রেণির মানসিক দূরত্ব বিস্তর। এই দূরত্ব কি শিক্ষার প্রসারে একটা বড় রকমের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে? এটা খুবই লক্ষ করার ব্যাপার যে, এই শ্রেণির লোকেরা সন্তানদের ক্রমশই সরকারি স্কুল থেকে সরিয়ে নিয়েছেন, সুতরাং সেখানে শিক্ষার মান পড়লেও তা নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাননি, স্কুলগুলো ঠিক ভাবে চালাতে হবে বলে সরকারের উপর চাপ দেননি। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, সরকারি স্কুলে ভাল পড়াশোনার প্রত্যাশাটাই হারিয়ে গেছে। নথিভুক্তির হার আর শিক্ষার মান, দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। স্কুল খোলার দাবি যে আজও তেমন জোরদার হল না, তার পিছনে হয়তো এই বাস্তবের একটা ভূমিকা আছে।

Advertisement

অচিন: সাম্প্রতিক কালের মিডিয়ান ভোটারের চাহিদাগুলোর দিকে দেখো। তিনি বলবেন, সরকারি স্কুলে লেখাপড়া হয় না, তাই বেসরকারি শিক্ষা চাই আমার সন্তানের, কিন্তু অত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তাই সরকার যদি ও-দিকটা দেখে। স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও একই যুক্তি— সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয়? আমার বেসরকারি চিকিৎসার খরচটা সরকার মিটিয়ে দিক। ফলে স্বাস্থ্যসাথী। তবে কি এ বার আমরা স্বাস্থ্যসাথীর মতো ‘শিক্ষাসাথী’ পাব, যা প্রাইভেট টিউশনের খরচটা মিটিয়ে দেবে? অথচ অন্য পথের দিকে ফিরেও দেখলাম না। মানুষের চাহিদার সঙ্গে খানিক সামঞ্জস্য রেখে সরকারি স্কুলগুলোতে কিছু কিছু সংস্কার হল না কেন? আমরা দাবি করিনি বলে। প্রতিষ্ঠানের অবনমনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আলবার্ট হার্শম্যান এক চমৎকার শব্দজুটি ব্যবহার করেছেন: ‘নিষ্ক্রমণ’ আর ‘কণ্ঠস্বর’। পরিষেবার গুণ পছন্দ না হলে আমি প্রদানকারীকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র যেতে পারি। অন্য বিকল্পটি হল— দল জুটিয়ে হইচই করে তার অবনমন ঠেকাতে পারি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত অতি দ্রুত প্রথমটি বেছে নিচ্ছে। ফলে সেখানে যারা রয়ে যাচ্ছে তাদের গলা তোলার জোরও কমে গেছে। আর, স্কুল বন্ধ থাকলেও প্রাইভেট টিউশন তো বন্ধ হয় না। কিন্তু যথাযথ মানের টিউটর যাদের নাগালের বাইরে, ক্ষতিটা তাদেরই। কোনও একটি নীতিতে যদি সবাই সমান ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিংবা সবাই যদি মনে করে তারা সমান ক্ষতিগ্রস্ত, তা হলে হইচই করার দল ভারী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ক্ষতিটা যদি হয় নীচের ধাপে সবচেয়ে বেশি তা হলে ক্ষতি ঠেকানোর দাবিটা সব শ্রেণি থেকে জোরালো ভাবে আসতে পারে না, তাই না?

অনির্বাণ: কিন্তু এই ঔদাসীন্যের পরিণাম তো ক্রমশই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে তার চাপটা উত্তরোত্তর বাড়ছে। সাধারণ ভাবে যাঁদের মধ্যবিত্ত বলা হয়, তাঁদের একটা বড় অংশের পক্ষেও সন্তানের ঠিকঠাক শিক্ষার খরচ মেটানো কঠিন বা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। অতিমারির সময় অনেকেই বেসরকারি স্কুল ছাড়িয়ে সরকারি স্কুলে ছেলেমেয়েকে ভর্তি করেছেন। তাঁদের মধ্যে মধ্যবিত্তের অনুপাত সম্ভবত খুব কম হবে না। তা ছাড়া, আর্থিক অসাম্য যে চেহারা নিচ্ছে তাতে মধ্যবিত্তের স্তর থেকে বহু পরিবার যে নীচে নামতে বাধ্য হচ্ছে সেটাও মনে হয় স্পষ্ট; ‘ভ্যানিশিং মিডল’-এর গল্পটা ক্রমশই জোরদার হচ্ছে। আবার, বেসরকারি স্কুলে বা কোচিং ক্লাসে অনেক টাকা খরচ করেও সব সময় যে লেখাপড়া মনোমত হচ্ছে এমনও নয়। এই অবস্থায় সমাজের একটা বড় অংশ, যাঁরা ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখানোর প্রয়োজন খুব ভাল করে বোঝেন, সেই প্রয়োজন মেটানোটা ক্রমশই তাঁদের সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ, ‘নিষ্ক্রমণ’-এর পথটা তাঁদের সামনে ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। কিন্তু— পরিস্থিতির চাপে পড়ে— তাঁদের ‘কণ্ঠস্বর’ জোরদার হওয়ার, অনেক স্বর একজোট হওয়ার একটা সম্ভাবনা কি তা হলে নেই? অন্য ভাবে বললে, সেই সম্ভাবনা তৈরি করার কাজটাই কি রাজনীতির কাজ নয়? রাজনীতিকে ‘আর্ট অব দ্য পসিবল’ বলার একটা মানে কি এই ধরনের পরিস্থিতি থেকেই তৈরি হয় না? যদি তা হয়, তবে কী ভাবে রাজনীতিটাকে গড়ে তোলা সম্ভব?

অচিন: খুব কঠিন প্রশ্ন। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলব। এখানে রাজনীতি বলতে দলীয় রাজনীতির বাইরে আমরা ভাবতে পারি না। কেউ কোনও দাবি তুললেই ধরে নেওয়া হয় তার মূল উদ্দেশ্য সরকারকে বিব্রত করা এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করা। ফলে সরকার পক্ষের প্রতিক্রিয়া সব সময়েই হয় আক্রমণাত্মক, খামতিটাকে অস্বীকার করে। অথচ খামতিটা বুঝে নিয়ে, ভুল থাকলে সংশোধনের চেষ্টাও তো করা যেত। আমার তো মনে হয় এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের ‘পলিটিক্যাল ডিভিডেন্ড’ বেশি বই কম হত না। কেরলে অতি-দ্রুতগামী সম্পূর্ণ নতুন এক রেল ব্যবস্থা স্থাপন নিয়ে ইদানীং জোর বিতর্ক চলছে। প্রকল্পটির অনেক দিক আছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশের উপর এর প্রভাব নিয়ে অনেকে প্রতিবাদে নেমেছেন। সে দিন এক অনলাইন বিতর্ক শুনলাম, পাবলিক ডিবেট। বাম সরকারের পক্ষে নতুন রেল ব্যবস্থাটিকে সমর্থন করে বললেন রাজ্যের ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রী, আর বিপক্ষে ছিলেন কেরলের বিজ্ঞান মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত থাকা আর এক বরিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। তীব্র বিতর্ক, রীতিমতো পরিসংখ্যান, টেবল, চার্ট, পর্দায় দেখিয়ে। আমি তো অভিভূত। এই তো প্রকৃত ‘ডেলিবারেটিভ ডেমোক্র্যাসি’। আমার এক মালয়ালি বন্ধু প্রকল্পটির ঘোর বিরোধী। হেসে বললেন, সরকার হয়তো শেষে ওটা করবেই, এবং আমরাও মার্ক্স-কথিত ‘ক্রিটিসাইজ়িং আফটার ডিনার’ করতে করতে এই দলকেই আবার ভোটে জিতিয়েও আনব।

অনির্বাণ: এই প্রসঙ্গে বলি, ইদানীং একটা ব্যাপার খুব চোখে পড়ছে। সরকারের বিভিন্ন নীতি ও কার্যকলাপ নিয়ে রোজই নানা সমালোচনা শুনছি, পড়ছি। বিশেষ করে সমাজমাধ্যমে। সেটা খুব স্বাভাবিক, সঙ্গত। বস্তুত, সমালোচনা এবং প্রতিবাদ আরও বেশি হওয়া দরকার। সেটা তো গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে সমালোচনাগুলো প্রধানত কিছু সস্তা এবং হালকা ব্যঙ্গবিদ্রুপেই আটকে থাকছে, তার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে কতকগুলো একঘেয়ে নিন্দেমন্দ, বাঁধা গতে, এক সুরে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই সেই সমালোচনা ব্যক্তিগত আক্রমণেই সীমিত। আমার মনে হয়, এতে কাজের কাজ তো হয়ই না, বরং যথার্থ ‘পাবলিক ডিবেট’-এর ক্ষতি হয়। আর, গোটা ব্যাপারটা ওই তরজার স্তরেই বাঁধা থাকলে শাসকদের উপরেও সত্যিকারের আত্মসংশোধনের চাপ থাকে না।

এই সূত্রেই মনে হয়, শিক্ষার গুরুত্ব কোথায়, ‘সোশ্যাল গুড’ হিসেবে কেন সেটা এতটা মূল্যবান, কী ভাবে শিক্ষার ভেঙে-পড়া হালটাকে আবার গুছিয়ে তোলা সম্ভব, তাতে সরকার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের, যেমন শিক্ষকদের, অভিভাবকদের, বৃহত্তর সমাজের কী করণীয়, এ-সব প্রশ্নে আমাদের অনেক বেশি কথা বলা দরকার। অন্তত মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সর্বজনীন শিক্ষা কেন আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে, এ-রাজ্যে সেই স্তরের লেখাপড়ার, বিশেষত বিজ্ঞান শিক্ষার দুরবস্থা সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর হচ্ছে, এই নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা দরকার, গণতান্ত্রিক আন্দোলন দরকার। তাই না?

অচিন: একদম ঠিক। শিক্ষার অধিকার আইনটির কথাই ভাবো। অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইন করতে গেলে কার কোনটি কর্তব্য তা-ও বেঁধে দিতে হয়, না হলে আইনটি অর্থহীন হয়ে যায়। শিক্ষার অধিকার আইন সে কাজটি বেশ পরিপাটি করেই করেছিল— স্কুলশিক্ষা বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে শিক্ষক, অভিভাবক সকলকেই কী করতে হবে তা স্পষ্ট ভাবে বলে দেওয়া আছে। তবু আইন রয়ে যায় আইনেই, যদি না বৃহত্তর সমাজের দিক থেকে চাপটা থাকে। আর সে চাপটা আসতে পারে তখনই, যখন শিক্ষা-বঞ্চিত শিশুদের কথা ভেবে আমার রাতের ঘুম নষ্ট হবে। আশার কথা, অনেক সংবেদনশীল মানুষ নিজেদের উদ্যোগে, কখনও অন্যদের সঙ্গে মিলে সংগঠিত ভাবে, সুযোগবঞ্চিত শিশু কিশোর/কিশোরীদের শিক্ষণে সাহায্য করেন। শিক্ষকদের কিছু সংগঠনও অনেক কাজ করছে। এই উদ্যোগগুলি অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য, এবং অনেক বেশি মানুষ শামিল হলে অনেকটা কাজ হবে, বিশেষত কোভিড-পরবর্তী বিপর্যয়ের সময়ে। কিন্তু তা সুপরিকল্পিত সুসংগঠিত সঠিক গুণমানের সর্বজনীন শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না। সে শিক্ষার ব্যবস্থাপনা সরকার ছাড়া কে করবে? উন্নয়ন চর্চায় সরকারের ‘স্টুয়ার্ডশিপ’ ভূমিকার কথা বলা হয়। যে ভূমিকায় সব রকমের উদ্যোগকেই এক সামাজিক ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখে তাদের এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা প্রসারিত করে চলবে সরকার। সরকারের নীতিচিন্তা যদি হয়ে ওঠে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ামূলক— দক্ষিণবঙ্গে দু’দিন বেশি গরম পড়েছে বলে রাজ্যের সব স্কুল বন্ধ রাখতে হবে— তা হলে ওই স্টুয়ার্ডশিপ ভূমিকাটির কথা কে কাকে কী ভাবে মনে করিয়ে দেবে, সেটাই বুঝতে পারি না।

অচিন চক্রবর্তী: ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement