—প্রতীকী ছবি।
ভারতের মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি)-এর পরিসংখ্যানে কিছু অতিরঞ্জন থাকেই। যদিও এর পিছনে প্রতারণার কোনও ছক খুঁজতে গেলে ভুল করা হবে। এই অতিরঞ্জনের নেপথ্যে ইতিবাচক একটি আখ্যানই সাধারণত থাকে। জিডিপির ত্রৈমাসিক পরিসংখ্যানে কোথাও যেন এই মর্মে এক অলিখিত সাবধানবাণী রয়ে যায়— ভঙ্গুর বস্তু, সাবধানে নাড়াচাড়া করুন! কেন এমন হয়, বুঝতে গেলে সেই সব সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান বিচার করা দরকার, যা থেকে এই তথ্য উঠে আসে যে, জুলাই-সেপ্টেম্বরের ত্রৈমাসিকে ৭.৬ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছিল। এ বার ক্ষেত্রভিত্তিক পরিসংখ্যানকে সামগ্রিক পরিসংখ্যানের নিরিখে বিচার করে দেখা যাচ্ছে, পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্রে এক বছর আগে বৃদ্ধি ছিল ১৩.৯ শতাংশ। যা কার্যত বেশ অস্বাভাবিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের বৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেকটাই বেশি।
এমন ঘটার কারণ হল, এক বছর আগে ওই একই ত্রৈমাসিকে (আবার অস্বাভাবিক ভাবেই) পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ৩.৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। সে কারণেই চলতি বছরের সঙ্গে তুলনার ক্ষেত্রে মাপকাঠিটি খানিক নীচেই ধরা হয়েছিল। সাম্প্রতিকতম ত্রৈমাসিক এবং এক বছর আগেকার এই ত্রৈমাসিকের পরিসংখ্যান একত্র করলে (১৩.৯ – ৩.৮ =) ১০.১ শতাংশ অথবা গড়ে প্রতিটি ত্রৈমাসিকে ৫ শতাংশ বৃদ্ধির হিসাব পাওয়া যায়। চটজলদি হিসেবের সাংবাদিকসুলভ স্বাধীনতা নিয়ে বলা যায়, যদি ১৩.৯ শতাংশের অঙ্কটিকে ৫ শতাংশের ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরা হয়, তা হলে সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিকে ৭.৬ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে পতন ঘটবে (এবং গত বছরের একই ত্রৈমাসিকের পরিসংখ্যান বেড়ে যাবে)। সুতরাং, জিডিপি-র পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়ার আগে একটি সাবধানবাণী মনে রাখা দরকার— অনিয়মিত (আউটলায়ার) ক্ষেত্রগুলির বিষয়ে সতর্ক থাকুন।
এর বাইরেও অন্য অনেক ব্যাপার রয়েছে, যা দিয়ে পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্রের মাপজোক করা সম্ভব। কিন্তু সেই কাজটি করে ওঠার মতো পরিসর পাওয়া কঠিন। ইতিমধ্যে, জিডিপি-র অঙ্কটিকে বেশ কিছু জঞ্জাল দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হতে থাকে। যে ভাবে মুদ্রাস্ফীতির পরিসংখ্যান নামমাত্র বৃদ্ধির (চালু পণ্যমূল্যের নিরিখে) তুলনায় প্রকৃত বৃদ্ধিকে কমিয়ে দেখাতে ব্যবহৃত হয় (মূল্যস্তর অপরিবর্তিত থাকলে), ঠিক সে ভাবেই। ব্যবহৃত অন্যান্য পরিসংখ্যানের সংখ্যাতত্ত্বগত ভিত্তিও বেশ নড়বড়ে। যার উদাহরণ, অসংগঠিত অর্থনীতির বিপুলায়তন ক্ষেত্র। খনিজ তেলের মতো আমদানিকৃত পণ্যের দাম যে ভাবে পরিবর্তিত হয়, তাতে জিডিপি-র হিসাব বিকৃত হতে থাকে। চলতি ত্রৈমাসিকে এই পণ্যের দাম অর্থনীতির সার্বিক বৃদ্ধিকে বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়েই দেখিয়েছে। এ কথা বললে ভুল হবে না যে, অর্থনীতিবিদ আর পরিসংখ্যানবিদদের কাছে ভারতের সরকারি হিসাব অনুযায়ী জিডিপির খতিয়ান রাখার বিষয়টি কুটির শিল্পের সমতুল হয়ে পড়েছে।
এর মানে এমন নয় যে, অসততা মাত্রা না রেখেই বেড়ে চলেছে। এই সব প্রসঙ্গের অবতারণা এই কারণেই যে, পরিসংখ্যানের ঝনঝনানিতে অর্থনীতির মূল সুরটি যেন অশ্রুত হয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে কিছু মাত্রায় সাবধানবাণী শোনানো। অতিমারির কালে কোভিড তার নিজের পরিসংখ্যান দিয়েই বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছিল। গত বছরের ৭.২ শতাংশ হারে বৃদ্ধিকে কোভিড-কালের মন্দাবস্থা থেকে উত্তরণের দ্বারা পুষ্ট (অন্তত প্রথমার্ধে তো বটেই) বলা যায়। অতিমারি-জাত এ ধরনের গোলযোগ আমাদের পিছনেই হয়তো রয়েছে। কিন্তু ভারতের পরিসংখ্যান গ্রহণ এবং তথ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলি যে বহমান থেকে যাচ্ছে, তা কোনও মতেই অস্বীকার করা যায় না।
এগুলি উভয় ভাবেই কাজ করে। যদি কোনও বিশেষ কালপর্বের পরিসংখ্যানকে বাড়িয়ে বলা হয়, তবে অন্য পর্বের অঙ্ককে কমিয়ে দেখাতেই হবে। সুতরাং, গত বছর যখন জিডিপির বৃদ্ধি ৭.২ শতাংশ এবং চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৭.৭ শতাংশ, তখন তাকে নিঃসন্দেহে ভাল বলতেই হবে। কিন্তু এই পরিস্থিতির অন্তর্নিহিত সত্যটি অতখানি ঝলমলে নয়। এবং আগামী ত্রৈমাসিকগুলিতে বৃদ্ধির পরিমাণ ৬ শতাংশের আশপাশে থাকবে বলেই জানানো হচ্ছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানটি ভারতের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পাকাপোক্ত বৃদ্ধির খুব কাছাকাছিই থাকতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। আপনি যদি আশাবাদী হন, তবে সেই সংখ্যাটিকে খানিক বাড়িয়ে দেখবেন। আর যদি আপনি পরিসংখ্যানের ব্যাপারে সন্দেহবাদী হন, তবে আপনার চোখে অঙ্কটি কিছুটা কম বলেই মনে হবে।
এ ধরনের আশাবাদের পিছনে যে কারণটি কাজ করছে সেটি এই যে, দেশের অর্থনীতির সম্ভাব্য শক্তিকে পুরোদমে চাগিয়ে তোলার জন্য এখনও ব্যক্তিগত বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে— এমন ভাবনা। আর সন্দেহবাদের পিছনে রয়েছে এই সত্য যে, যখন জিডিপি-র পরিসংখ্যান ব্যক্তিগত ভোগের স্তরে বৃদ্ধির সমান সমান বলে দেখানো হচ্ছে, তখনও কিন্তু তার নেপথ্যে কাজ করে চলেছে ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এমন অবস্থা দীর্ঘ কাল চলতে পারে না— এই বোধ। ভোক্তাদের মধ্যে যাঁরা ঋণ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছেন, তাঁরা পরবর্তী ত্রৈমাসিকগুলিতে সেই ঋণ শোধেই ব্যস্ত থাকবেন। ভোগের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গতির স্থায়ী অভাব জিডিপির পরিসংখ্যানকে পিছনের দিকে টেনে রাখবে এবং বিনিয়োগে বাধার সৃষ্টি করবে।
এ সবের কোনওটিই কিন্তু এই সত্যকে অতিক্রম করে যেতে পারে না যে, অর্থনীতির বৃদ্ধির গতির নিরিখে ভারতের অবস্থার বর্ণনা এক বেশ মনোহারি রকমের নতুন আখ্যান। বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় দ্বিগুণ গতিতে এ দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটছে। যে কোনও বৃহৎ অর্থনীতির দেশের তুলনায় ভারত বেশ ভাল ফল প্রকাশ্যে আনছে। এবং সেই কারণে ত্রৈমাসিক থেকে ত্রৈমাসিকান্তরে এ কথা ক্রমেই রটে চলেছে যে, দেশের ভিতরে এবং বাইরে ভারতীয় অর্থনীতি ‘দশকের সেরা অর্থনীতি’ হয়ে উঠছে।