ফাইল চিত্র
আফগানিস্তানে তালিবানি শাসনে মহিলাদের অবস্থা কী হবে? প্রথম সাংবাদিক বৈঠকেই তালিবানের মুখপাত্রকে এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, সময় পাল্টেছে। ২০ বছর আগে যেমন নিয়ম ছিল, তেমন না-ও থাকতে পারে। তবে যা-ই হোক না কেন, হবে শরিয়তি আইন মেনে।
২০২১ থেকে কি তাহলে পরিবর্বিত তালিবানি শাসন দেখতে চলেছে আফগানিস্তান? মেয়েরা কি আগের থেকে একটু হলেও বেশি স্বাধীনতা পাবেন? আফগানিস্তানের ইতিহাস কিন্তু তা বলছে না। বলছে, তালিবানি শাসনে নারী স্বাধীনতা তো দূরস্থান, নারী অধিকার রক্ষাও কঠিন হয়েছে বারবার।
১৯৯০ সালের মাঝামাঝি আফগানিস্তানে প্রথম দফায় ক্ষমতা অধিকার করবার পরেই তালিবান শাসককুল বুঝিয়ে দিয়েছিল, তাদের লক্ষ্য এক বিশুদ্ধ ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৫০ থেকে আফগানিস্তানে যে আধুনিকতাবাদী সংস্কারের সূচনা ঘটেছিল, গোটা দেশকে তার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াই তাদের লক্ষ্য ছিল। এই উদ্দেশ্যে একগুচ্ছ বিধির প্রবর্তন করা হয়েছিল, যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য নীতিপুলিশ ব্যবস্থার উদ্ভাবন। মানুষ নিয়মিত মসজিদে হাজিরা দিচ্ছেন কি না, সেদিকেও নজর রাখা হত। মসজিদে না গেলে কারাবাস পর্যন্ত গড়াতে পারত।
এই বাহিনী পথচলতি মানুষকে যে কোনও সময়ে দাঁড় করিয়ে তার শাস্ত্রজ্ঞানের পরীক্ষা নিতে পারত। সফল না হলে হত কড়া শাস্তি। ইসলামের নামে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল বিনোদনী কার্যকলাপের উপর। জাঁকজমক কমেছিল নওরোজ উৎসবের, ইসলামে নৃত্যগীতের অনুমোদন নেই— এই দাবিতে ক্যাসেট তৈরি বা বিক্রির জন্যেও বরাদ্দ হয়েছিল বেত্রাঘাত (এমনকি কারাদণ্ড), কোপ পড়েছিল সিনেমা বা টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের উপরেও। কোনও মানুষ বা পশুপাখির প্রতিকৃতি ধর্মীয় অনুশাসনসিদ্ধ নয়, এই যুক্তিতে স্কুলের পাঠ্যবই বা ট্রাকের গা থেকে ওই ধরনের ছবি মুছে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ব্যক্তির চেহারা বা বেশভূষাও ছিল নিয়ন্ত্রণের আওতাভুক্ত। পুরুষদের চুল ছাঁটতে হত ছোট করে, দাড়ি রাখতে হত লম্বা, তার মাপও আদেশনুসারেই ঠিক করা হত। বাড়ির বাইরে বেরোতে হলে মেয়েদের জন্য চাদর বা বোরখায় শরীর ঢাকা ছিল বাধ্যতামূলক।
বস্তুত, মহিলাদের ক্ষেত্রে নিষেধের পরিধি ছিল আরও বড়। পাহারা আরও কড়া। মেয়েদের ঘরে থাকাই ছিল বিধেয়। একমাত্র পরিবারের কোনও পুরুষ (সে শিশু বা কিশোরও হতে পারে) সঙ্গে থাকলে বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার অনুমতি মিলত। এই নিষেধাজ্ঞার সূত্র ধরে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বা পরিবারের বাইরে কোনও কাজকর্মে অংশ নেওয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তালিবানি শাসনে। প্রশাসনিক কার্যকলাপ এবং বিদেশি সংস্থায় যুক্ত থাকার ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা ছিল কঠোরভাবে প্রযোজ্য, যদিও হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু ছাড় দেওয়ার কথা জানা যায়। তালিবান শাসকদের দাবি ছিল, তারা মেয়েদের শিক্ষাদানের বিরোধী নয়। কিন্ত সেই শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামি রীতিসম্মত হতে হবে।
মেয়েদের ঘরে থাকাই ছিল বিধেয়। ফাইল: ছবি
সন্দেহ নেই অপরিচিত নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশায় রাশ টানাই ছিল এই সমস্ত আয়োজনের মূল লক্ষ্য। সেই কারণে বাসে উঠেও মেয়েদের বসতে হত একেবারে পিছনের আসনে। মাঝখানে পর্দা টেনে পুরুষযাত্রীদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করা হত। এমনকি, শহরাঞ্চলে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট প্রথাগত স্নানাগার বা হামামগুলিকেও তালিবানি ফতোয়ার জেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বলা বাহুল্য, এই ধরণের বিধিনিষেধে রাতারাতি অভ্যস্ত হয়ে ওঠা আফগান মহিলাদের পক্ষে সহজ ছিল না। তার পরিণামে তালিবান যুবকদের হাতে নানা ধরণের হেনস্থার শিকার হতে হত তাঁদের। অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক নিগ্রহের ঘটনাও ঘটত। দৈহিক আঘাত খুব মারাত্মক না হলেও এর ফলে মহিলাদের মনে বড়সড় মানসিক ক্ষতের সৃষ্টি হতে থাকে তখন থেকেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘বিশ্বাসভঙ্গ’-এর অভিযোগে মহিলাকে পাথর ছুড়ে হত্যা করার ঘটনাও প্রকাশ্যে এসেছিল সে সময়ে।
এই চরমপন্থী বিধিবিধান ও শাস্তিদান পদ্ধতি স্বাভাবিক ভাবেই প্রচারমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে আফগান প্রশাসনকে সনদের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় এবং আরও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার আবেদন জানানো হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আমেরিকা এই ব্যবস্থাকে ‘মধ্যযুগীয়’ আখ্যা দেয় এবং তালিবান শাসনকে মান্যতা দিতেই অস্বীকার করে।
অপরিচিত নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশায় রাশ টানাই ছিল এই সমস্ত আয়োজনের মূল লক্ষ্য। ফাইল ছবি
কিন্তু সেই তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েও তালিবান নেতৃত্ব নির্বিকার ভাবে জানিয়ে দেন, এই অনুশাসন পর্বের একমাত্র উদ্দেশ্য আফগান বোনেদের ‘কুদৃষ্টি’ থেকে রক্ষা করা। বস্তুত, তারা দাবি করে, নারীশিক্ষার ওপর এই নিষেধাজ্ঞা সাময়িক। উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারলেই পরিস্থিতির বদল ঘটবে। কিন্ত অন্য দিকে আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে তারা আফগানিস্তানের ওপর পশ্চিমি মূল্যবোধ আরোপ করবার চেষ্টা এবং ইসলাম-বিরোধী আগ্রাসন হিসাবেই বর্ণনা করে। সেই সঙ্গে সব রকম ‘প্ররোচনা’-র মুখোমুখি দাঁড়িয়েও ‘ঈশ্বরের আদেশ পালনের অঙ্গীকার’ থেকে সরে আসতে অস্বীকার করে। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমি দেশ তথা রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে নিরবচ্ছিন্ন নিন্দাবাদ এবং অর্থনৈতিক অবরোধও এই অবস্থান থেকে তাদের বিচ্যুত করতে পারেনি।
তালিবানের এই অনড় অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গেলে তাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আটের দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত-বিরোধী প্রতিরোধ চলাকালীন বিপুল সংখ্যায় আফগান পরিবার শরণার্থী হয়ে পাকিস্তানের পশ্চিম প্রদেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছিল। তালিবান নেতৃত্বের এক বড় অংশ সেই ছিন্নমূল পরিবারবর্গেরই সন্তান। তারা এক গ্রাম্য সংস্কৃতির বাহক, আজন্ম দারিদ্র্য-লালিত এবং পেশওয়ার ও বালুচিস্তানের অতিরক্ষণশীল দেওবন্দি মাদ্রাসা ব্যবস্থায় শিক্ষিত। ফলে নাগরিক জীবন ও কৃষ্টি সম্পর্কে তাদের মধ্যে এক তীব্র বিরাগ লক্ষ্য করা যায়। আফগানিস্তানের উচ্চশিক্ষিত মার্জিতরুচি শহরবাসী এলিট সম্প্রদায়ের নিরিখে তারা নিছক ‘বহিরাগত’। পক্ষান্তরে, রীতিনীতি বা মূল্যবোধের দিক থেকে তারা অনেকটাই পুশতু জনসাধারণের প্রতিনিধিত্বকারী। যে সমাজ সম্পূর্ণ পুরুষ-প্রধান এবং মহিলাদের নিচু অবস্থানকে নিতান্ত স্বাভাবিক বলে মনে করে থাকে। সেই সমাজ কাঠামোয় নারী-পুরুষের কাজকর্মের ক্ষেত্রগুলির মধ্যে স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট বিভাজন লক্ষ্য করা যায়। আর এই বিভাজন গড়ে ওঠে নারীর এই দুর্বলতর সামাজিক অবস্থানের ধারণার ভিত্তিতে। তালিবানি আইনে মহিলাদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়, তার উৎস সন্ধান করতে হবে এইখানেই।
লক্ষ্য করার বিষয়, মহিলাদের প্রতি এই ধরনের পীড়নমূলক আচরণের সূত্রপাত কিন্ত তালিবানি শক্তির উত্থানের আগেই। নয়ের দশকের প্রথমার্ধে আফগান গৃহযুদ্ধের সময় থেকেই তা ঘটতে দেখা গিয়েছে। তা হলে এই প্রবণতা তালিবান শাসনের সঙ্গেই এত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেল কী করে? কোনও সন্দেহ নেই তালিবান আমলে আইন ও প্রশাসনের নারী-বিরোধী চরিত্র চরমে পৌঁছেছিল। কিন্ত পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, তালিবানের হাত ধরেই শহরাঞ্চলের শিক্ষিত এলিট গোষ্ঠীর জীবনে এই বৈষম্য ও উৎপীড়নের সরাসরি আমদানি ঘটেছিল। বস্তুত, প্রাক-গৃহযুদ্ধ পর্বে এই এলিট সম্প্রদায়ের মানুষের অনেকেই সরকারি প্রশাসনিক পদে চাকুরিরত ছিলেন। যে পেশায় যুক্ত হওয়ার জন্য আবার বিশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হত। রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ইঙ্গিত গৃহযুদ্ধকালেই পাওয়া গিয়েছিল। তালিবানি রাজত্বে শিক্ষাব্যবস্থাও ভেঙে পড়বার উপক্রম হয়েছিল। এই প্রেক্ষিতে নতুন শাসককুলের সঙ্গে পুরনো এলিটবর্গের সংঘাত চরমে ওঠে। উচ্চবর্গের মহিলারা তাঁদের গৃহবন্দি জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালালেও অন্দরে রক্তক্ষরণ চলতেই থাকে। তৈরি হয় মানসিক বৈকল্যের পরিস্থিতি। কিছু কিছু প্রতিবাদ সংগঠিত হলেও শাসকের দমনমূলক মনোভাবের কারণে সে ভাবে কিছুই দানা বাঁধতে পারেনি।
গত দু’দশকে আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া হামিদ কারজাই ও আশরাফ গনির নেতৃত্বে নির্বাচিত সরকারের শাসনকালে হারানো অধিকার সমূহের পুনরুদ্ধার যে অনেকাংশে সম্ভব হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আজ আবার তালিবানরাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠার সূত্র ধরে সেই অধিকারভোগের স্বাধীনতা আবারও বিপন্ন হয়ে পড়েছে এবং সে দেশের অধিবাসীদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম কেড়েছে সমগ্র বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরও। কিন্তু এই সঙ্গে এক কঠিন সত্যকেও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না যে, গণতন্ত্রের বহিরঙ্গসজ্জা বহাল থাকলেও এই দীর্ঘ সময়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমাজের প্রাগ্রসর ও পশ্চাদপদ অংশের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ সে ভাবে এগোয়নি। তার জন্য সনিষ্ঠ প্রয়াস চালানো হয়েছিল কি না, সে বিষয়টাও পরিষ্কার নয়।
সেই দূরত্বকে আশ্রয় করেই তালিবানের প্রত্যাবর্তনের পথ প্রশস্ত হয়েছে। কোনও কোনও মহল থেকে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে, তালিবানি শাসনের দ্বিতীয় পর্ব প্রথমের চেয়ে ‘পরিণত ও বাস্তববাদী’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কথাও ঠিক যে, তাদের শীর্ষনেতৃত্ব বারবার করেই দেশের মানুষের অধিকার সুরক্ষিত থাকার বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে চলেছেন। কিন্ত গত দু’এক দিনের ঘটনাপ্রবাহের দিকে চোখ রাখলে বন্দুকধারী তালিবান যোদ্ধাদের ওপর নেতৃত্বের ঠিক কতখানি প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তা বলা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে আফগানদের যে অংশ তালিবান-বিরোধী এবং যাঁদের এই মুহূর্তে দেশ ছাড়ার সুযোগ বা ইচ্ছে নেই, তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন চিহ্ন থেকেই যাচ্ছে।
(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)