শিখিয়ে-পড়িয়ে বা হুকুম দিয়ে শিল্প হয় না, শিল্পীও তৈরি হয় না। মনে করতেন শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিল্পী অবন ঠাকুর বা শকুন্তলা, ক্ষীরের পুতুল, নালক, রাজকাহিনীর মতো বইগুলির স্রষ্টা, ছবি লিখিয়ে অবন ঠাকুরকে আমরা চিনি। তুলনায় কম পরিচিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগেশ্বরী অধ্যাপক, শিল্পজ্ঞানী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্য, দেশ-বিদেশের শিল্পদর্শনের চর্চা করে ১৯২১-২৯ সময়কালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ত্রিশটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। সেই বক্তৃতার লিখিত প্রবন্ধরূপ বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী শিল্পের অমৃতআধার। ভারত শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর গ্রন্থ। একুশ শতকে শিল্প এবং শিল্পীকে যখন জনগণের আদালতে হাজিরা দিতে হয়, তখন শিল্পগুরুর শরণাপন্ন হতে হয় বইকি! শিল্প কী? শিল্পী কে? শিল্প-ভাষা, শিল্পরুচি, শিল্পবোধ নিয়ে সহজ মজলিশি ভাষায় বিস্তৃত আলোচনা রেখে গিয়েছেন ভারতশিল্পের ষড়ঙ্গ থেকে শিল্পায়ন বা সহজ চিত্রশিক্ষা বইগুলিতে।
তর্কবিতর্ক বা টানাপড়েন শিল্পের জন্য স্বাস্থ্যকর। অভিজ্ঞতা এবং তর্কের সংঘাতে জন্মায় আধুনিক মন, যা শিল্পমুক্তির ভাবনা আনে। কথায় বলে, আর্ট করেন আর্টিস্ট। অবনীন্দ্রনাথ অনুসারে, শিল্পীদের একটা বড় অংশ চোখের দেখাকে এড়িয়ে, মনের দেখাটুকু ছবিতে প্রকাশ করেন। শিল্পীর ভিতরের অপরিমিতি (ইনফিনিটি) এবং স্বাতন্ত্র্য (ইন্ডিভিজুয়ালিটি) এ ক্ষেত্রে প্রধান। অন্য অংশ ‘যেমন খুশি আঁকো’তে বিশ্বাসী নন। যা দেখছেন, হুবহু তাকে ছবিতে প্রকাশ করেন। তবে, স্বাধীন প্রকাশেই শিল্পের সার্থকতা। অবনীন্দ্রনাথ ফুরফুরে গদ্যে গল্প করে বুঝিয়ে দিয়েছেন সে কথা। পুরীতে রাজ-আদেশে বিমলাদেবীর বাহন শার্দূল (বাঘ) গড়লেন ভাস্কর। অনেকটা শ্বেতপাথরের সিংহের মতো। রাজার পছন্দ হল না। পণ্ডিত শাস্ত্র মিলিয়ে বিধান দিলেন মুখ হবে বেড়ালের মতো, চোখ হবে ভাঁটার মতো, থাবাখানা ঘোড়ার মতো! নানা মুনির নানা মত শুনতে গিয়ে শিল্পী কোনও আকার ঠিকমতো দাঁড় করাতে পারলেন না, বরং ঘরে ফিরে দেখলেন, নিজের ছোট্ট মেয়েটি মন থেকে চমৎকার বাঘ এঁকেছে। মন থেকে করা যে কোনও সৃষ্টি যেমন স্বাধীন তেমন সম্পূর্ণ। অবনীন্দ্রনাথ শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। কারণ, সাধারণের দেখা আর শিল্পীর দেখায় তফাত আছে। উদাহরণে বলছেন, নিত্য কত লোক গোলদিঘিতে বেড়াতে যায়। তাদের যদি প্রশ্ন করি সেখানকার রেলিং ত্রিশূলের মতো না বল্লমের মতো, ক’জন উত্তর দিতে পারবে সন্দেহ! একমাত্র শিল্পীর চোখ সব সময় নোট নিতে নিতে চলে। একমাত্র শিল্পীর চোখ, অর্জুনের মতো নির্ভুল স্থির লক্ষ্য অর্জন করে। এই কারণেই শিল্পীর দেখাকে আমরা সাধারণের দেখা দিয়ে মেলাতে চাইলে আসলে খাটো করা হয় শিল্পকে।
কতকগুলি অনিবার্য প্রশ্ন আসে। অবনীন্দ্রনাথ নিজে মাস্টার ছিলেন এবং নন্দলালদের মতো শিষ্য তৈরি করে গিয়েছিলেন। শিল্প সংক্রান্ত লেখাপত্রে ছবি আঁকার প্রাথমিক পাঠ, তুলির রকমফের থেকে রঙের ঘূর্ণি, বস্তুর রূপভেদ, মান পরিমাণ, ভাব, লাবণ্য বিষয়ে শিক্ষামূলক দিকের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা হলে শুরুর কথাটা তো অনেকটাই স্ববিরোধী! আসলে কোথাও নিজের আত্মদর্শনের (ছবি আঁকার বিদেশি প্রশিক্ষণ নিলেও দেশজ শিকড় অনুসন্ধান করে শিল্পের নতুন পথ করে নিয়েছিলেন) সমর্থন খুঁজেছিলেন শিল্পীর নিজস্বতার মধ্যে। শিল্পের মুক্তির মধ্যে। শান্তিনিকেতনে ছাত্রদের শেখাতেন, খাঁচা খুলে খরগোশকে ছেড়ে দাও। যেই না সে লাফিয়ে এক ছুট্টে পালাবে, ঠিক তখনই ওর মুক্তির ভঙ্গিটি মনে ধরে নিয়ে খাতায় ছবি এঁকে নাও।
তা হলে, শিল্প কি সাধারণের জন্য নয়? অবনীন্দ্রনাথের শিল্পতত্ত্ব শিল্প-ভাষার সর্বজনীনতার কথা বলে। যেমন, কাক বললে সবাই না বুঝতেও পারে! কিন্তু ছবি এঁকে দেখালে সবাই বুঝবে। সেই কবেকার বাংলার ব্রতে, পিটালির চিরুনি এঁকে ছড়া কাটা হত, “আমরা পূজা করি পিটালির চিরুনি/ আমাগো হয় যেন সোনার চিরুনি।” মেয়েদের কামনার ভাষা হয়ে উঠত চিত্রিত আলপনাগুলি। আর একটি বিষয় হল অবনীন্দ্র নন্দনতত্ত্ব বলে শিল্পী, শিল্প এবং রসিকের কথা। শিল্পী সৃষ্টি করে আনন্দ পান। রসিক সেই সৃষ্টির মর্ম উদ্ধার করে আনন্দ নেন। তবে, বিষয়টা বহু ক্ষেত্রে আপেক্ষিক৷ আর্টিস্টের সৌন্দর্যের ধারণা পূর্ণচন্দ্রের মতো পরিপূর্ণ, কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। সাধারণ মনের আদর্শ ইচ্ছে আর শিল্পীর ইচ্ছের মিল না হতেই পারে। বিশেষত ছবির ক্ষেত্রে সাধারণের বোঝাপড়া অনেকটাই বিষয়ভিত্তিক। জানাশোনা বিষয়ের বাইরে তাদের মিলতে অসুবিধা হয়। ছবি দেখতে শেখা অনেকটাই ধারাবাহিক অভ্যাস-নির্ভর এবং বিজ্ঞানসম্মত। তবে এটাও ঠিক, শিল্পজগৎ কারিগরি নিয়ে যত আন্দোলন করেছে তার সিকিভাগ আসেনি শিল্পসত্তার জন্য। যে কারণে আর্ট অনেক সময় সাধারণের নাগালের বাইরে থেকে গিয়েছে। অবশ্য নিজের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে অন্যের অস্তিত্বকে বোঝার মতো সময়, ইচ্ছা এবং মানসিক প্রসারতা থাকলে তা অনেক সহজ হয়।
১৮৭১-এর ৭ অগস্ট অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন। এই সময়ের কানেও তিনি প্রাসঙ্গিক শিল্পকথা কয়ে যান। বলে যান, সুন্দরের সঙ্গে আমাদের সকলের স্বতন্ত্র ঘরকন্না।