সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রাম পঞ্চায়েত। আগে প্রধান ছিলেন বিজেপির, দলবদলের পর এখন তিনি তৃণমূলের। তাঁর পঞ্চায়েতের উদ্যোগে দলে দলে মানুষ ভোটার কার্ডের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণের জন্য ছুটছেন। বিভিন্ন বেসরকারি কেন্দ্রে এই কাজ চলছে। মানুষ লাইন দিয়ে সকাল থেকে নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত ফর্ম ভর্তি করাচ্ছেন এবং বেসরকারি কেন্দ্রগুলো এর জন্য কারও কাছ থেকে ৫০, কারও কাছ থেকে ১০০ করে টাকা নিচ্ছে। মানুষের মনে কী ভাবে যেন একটা ভয় ঢুকেছে যে, এই আধার এবং ভোটার সংযুক্তির কাজটা না হলে, তাঁর ভোটাধিকার চলে যাবে, তিনি তাঁর নাগরিকত্ব হারাবেন। এমন আরও উদাহরণ হয়তো দেশের এবং রাজ্যের নানান প্রান্তে পাওয়া যাবে, কিন্তু কেউ একটা সাধারণ প্রশ্ন করছেন না, একটি ভোটার কার্ডের সঙ্গে যেমন নাগরিকত্বের প্রশ্নটি জড়িত, আধারের সঙ্গে কখনওই নাগরিকত্বের বিষয়টি সংযুক্ত নয়।
তার পর গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েই বলতে শুরু করেন, প্রতিটি মানুষকেই একটি ডিজিটাল পরিচয়পত্র তৈরি করতে হবে এবং আধার দিয়েই এই ডিজিটাল পরিচয়পত্রের কাজ চালানো সম্ভব হবে। সরকারি সুযোগসুবিধা পেতে, গ্যাসের ভর্তুকি, পেনশন বা রেশন পেতে আধারের সঙ্গে সেই সংক্রান্ত নথির সংযুক্তিকরণ করতে হবে। এই আইন যেমন সরকারি ক্ষেত্রে বলবৎ হয়, তেমনই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কিংবা ব্যক্তিরাও তাঁদের গ্রাহকদের থেকে আধার চাইতে থাকেন। মোবাইল সংস্থাগুলি ক্রমশ বলতে থাকে যে, আধার সংযোগ না করালে, গ্রাহকদের ফোনের যোগাযোগ বন্ধ করা হবে। ইতিমধ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে রুজু হওয়া মামলার শুনানি শুরু হয়। যাঁরা এই মামলা করেছিলেন, তাঁদের পক্ষের আইনজীবীরা সওয়াল করেন, এই আধারের কারণে বহু মানুষ বাদ যাচ্ছেন। ভুয়ো উপভোক্তা ধরতে গিয়ে আসল উপভোক্তারাই সমস্যায় পড়ছেন নানান ভাবে। হাতের আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে বা প্রযুক্তিগত ত্রুটিতে বহু মানুষ বাদ পড়ছেন। শুনানি চলাকালীন সাংবিধানিক বেঞ্চের অন্যতম বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছিলেন, আধারের কারণে তাঁর নিজের মায়ের পেনশন পেতেও অসুবিধা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ কিন্তু সরকারি সুযোগ সুবিধা পেতে গেলে আধার লাগবে— সেই রায়ই দেয়। শুধু বলে, কোনও বেসরকারি ক্ষেত্র বা সংস্থা নির্দিষ্ট প্রয়োজন ছাড়া আধার চাইতে পারবে না।
রায়ের পরে, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলেন, কোনও কিছুর সঙ্গে আধার সংযোগের প্রয়োজন নেই। তিনি তাঁর মোবাইলের ফোনের সঙ্গে আধার সংযোগ করাননি এবং করাবেনও না, তাও বলেন। কিন্তু তার পরে যখন তিনি স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার-সহ বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে আসেন, সেই সমস্ত কিছুর জন্য মোবাইলের সঙ্গে আধারের সংযোগ করানোর কথা বলা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে যখন ‘এক দেশ এক রেশন’ প্রকল্প আনা হয়, তখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাথমিক ভাবে তার বিরোধিতা করলেও, পরে উপভোক্তাদের রেশনকার্ডের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব আনা হয়। বলা হয়, রেশন পেতে গেলে আধার সংযোগ বাধ্যতামূলক। অথচ, এর ফলে বাংলার নানান প্রান্তে বহু মানুষ যে রেশন পাচ্ছেন না, সেই খবর কি তাঁর কাছে আছে? যদিও তিনি তার পরে বলেন যে, বাংলার মানুষের সুবিধার্থে তিনি ‘দুয়ারে রেশন’ নিয়ে আসছেন, কিন্তু তার জন্যেও যে আধার লাগবে, তা তিনি বলেননি। বাংলার বিভিন্ন জায়গায়, রেশন ডিলারদের উপরে যে উপভোক্তারা চড়াও হচ্ছেন রোজ, বায়োমেট্রিক্স না মেলার জন্য, বা প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে রেশন না পেয়ে, সে খবর কি তিনি রাখেন?
যে দিন সংসদে আধার এবং ভোটার কার্ডের সংযুক্তিকরণের বিল নিয়ে আসে কেন্দ্রীয় সরকার, তাদের যুক্তি ছিল বহু মানুষের একাধিক ভোটার কার্ড আছে, বহু ভুয়ো ভোটার কার্ড আছে, সে দিন কিন্তু এই তৃণমূলের তরফ থেকে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়েছিল সংসদে। বলা হয়েছিল, এই আইনের ফলে অনেকে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। অনেক সাংসদ সে দিন তেলঙ্গানার উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ২০১৮ সালের সেই রাজ্যের নির্বাচনে যখন একটি পাইলট-প্রজেক্ট হিসেবে এই আধার এবং ভোটারের সংযোগ করানোর প্রক্রিয়া নেওয়া হয়, তার পরে দেখা গিয়েছিল যে, প্রায় ২২ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছিল। দেখা যায়, মূলত মুসলমান মানুষজনের নামই বাদ পড়েছিল। সেই নির্বাচনের সময়ে সমাজমাধ্যমে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছিল, ‘আমার ভোট কোথায়?’ পরে তথ্য জানার অধিকার আইনে জানা যায়, আধার এবং ভোটার সংযোগ করানোর প্রক্রিয়ায় কোনও একটি প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে এই ঘটনা ঘটে। তেলঙ্গানা রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার অবধি এই ভুল স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিভিন্ন রাজ্যে যখন বহু মানুষ এই আধারের কারণে রেশন থেকে সরকারি সুবিধা থেকে বাদ পড়ছেন, খবর পাওয়া যাচ্ছিল তখন সমাজকর্মী এবং অর্থনীতিবিদরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যে মানুষেরা আসল উপভোক্তা তাঁদের চিহ্নিতকরণের জন্য সরকারি তরফে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেওয়াটাই পরীক্ষিত পদ্ধতি। তার বদলে প্রযুক্তির সাহায্য নিলে আসল মানুষেরা বাদ পড়তে পারেন। প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন এখনও বলে চলেছে যে, আধার এবং ভোটার কার্ড সংযুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক নয়।
যখন প্রথম আধার আনা হয়েছিল ইউপিএ সরকারের আমলে, তখন বলা হয়েছিল, যাঁদের কোনও পরিচয়পত্র নেই, মূলত তাঁদের একটি পরিচয়পত্র হবে আধার। যাঁরা এক দিন সংসদে দাঁড়িয়ে ভুয়ো ভোটারের তালিকা ছুড়ে মেরেছিলেন, তাঁদের কি দায়িত্ব নয়, ভুয়ো ভোটার ধরার সঠিক পদ্ধতির জন্য সওয়াল করার? কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা করার অর্থ, সেই সরকারের ত্রুটি বিচ্যুতি দেখিয়ে সঠিক দিকনির্দেশ করা। সেইটাই আসল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাহাত্ম্য। শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করার থেকে তো সেটাই ভাল?