রক্তরাঙানো: পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজ়ি আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষর করছেন ভারতের সেনা জেনারেল অরোরার কাছে, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ষোলো ডিসেম্বরের আগে-পরে প্রতি বারই নানা রকম বিজয়োৎসবের ছবি এবং খবর দেখা যায় টিভিতে। মোবাইল এবং সোশ্যাল মিডিয়াতেও ইদানীং বিপুল ভাবে উল্লিখিত হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয় এবং আত্মসমর্পণের ইতিকথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় সৈন্যের আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটেছিল একাত্তর সালের ওই তারিখে, যখন তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে অস্ত্র নামিয়ে রাখেন। এই দিনটিকে ভারতের শৌর্যের ইতিহাসে একটি স্বর্ণাভ দিন বলে মনে করা হয়ে থাকে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ‘স্বর্ণিম বিজয় দিবস’ বলে দীর্ঘ টুইট করছেন। কিন্তু কথা হল ওই বিজয়ের ভিতরে কত গ্যালন রক্ত আর বেদনা মিশে ছিল? আজও যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তাতে কতখানি উল্লাস সম্ভব ওই জয় নিয়ে?
জীবনের নানা পর্যায়ে কিছু বন্ধু পেয়েছি যারা পাকিস্তানের নাগরিক। একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে গিয়ে প্রায় পনেরো দিন চিনে ছিলাম, তখন জ়ুবেদ নামে একটি ছেলে প্রায় সাত দিন আমার রুমমেট ছিল। প্রায়শই সে মজা করে বলত যে, ভারত আর পাকিস্তানের দুই প্রতিনিধিকে ইচ্ছে করে একঘরে রেখেছে চিনা কর্তৃপক্ষ, যাতে ঝগড়া লাগে।
না, ঝগড়া লাগেনি। বরং রীতিমতো চমকে দেওয়া সব ঘটনার কথা বলে জ়ুবেদ আমার সম্ভ্রম আদায় করে নিত। তার মধ্যে প্রধান একটি কথা ছিল এই যে, ভারত কেন ওই তিরানব্বই হাজার সৈন্যকে সসম্মানে মুক্তি দিল? ওই সৈন্যদের একটা বড় অংশ যে চূড়ান্ত নৃশংসতা চালিয়েছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তার জন্য কোনও শাস্তিই তো যথেষ্ট নয়। এক জন সৈন্য সীমান্তে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী দেশের সৈন্যকে আঘাত করছে সেটা এক কথা। কিন্তু যুদ্ধের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক না থাকা অসংখ্য নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা, অগুনতি নারীকে ধর্ষণের পর মেরে ফেলার নারকীয়তায় যুক্ত বিপুল সংখ্যক লোক যদি ‘ট্র্যাজিক হিরো’র মর্যাদা নিয়ে নিজেদের উৎসভূমিতে ফেরে তবে সেই ভূখণ্ডের অবস্থা যে কী ভয়াবহ হয়, বিগত পঞ্চাশ বছরের পাকিস্তান তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ।
হুসেন হাক্কানির বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি গ্রন্থে এই কথারই অনুরণন শুনতে পাই যেন। হাক্কানির চমৎকার বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে দেয়, পাকিস্তানে ক্ষমতা সেনাবাহিনী আর আইএসআই’এর হাতে কুক্ষিগত হওয়ার ফলে, পাকিস্তানের সঙ্গে যে-কোনও দেশের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানও ব্যর্থ হতে বাধ্য। এর কারণ পাকিস্তান যদি কোনও দেশে পাঁচ জন তবলচিও পাঠায় তবে সেই তবলচিদের নির্বাচন করবে সেনা এবং আইএসআই। এই বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে ‘জেহাদ উইদাউট বর্ডারস’। এখানে হাক্কানি দেখান, অন্য দেশের সৈন্যবাহিনী যেখানে সন্ত্রাস দমনের কাজ করে সেখানে, পাকিস্তান নিজের দেশে সন্ত্রাস দমন (আমেরিকার চাপে) এবং অন্যত্র সন্ত্রাস রফতানির দ্বৈত ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করে যাচ্ছে বিগত চল্লিশ বছর। ভারতের শরীরে ‘থাউজ়্যান্ড কাটস্’-এর বহুল প্রচারিত স্ট্র্যাটেজি সেই চিত্রনাট্যেরই অংশ। এর সঙ্গে আছে আজও বাংলাদেশকে পদ্মা-মেঘনা বিধৌত ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে চিনতে অনিচ্ছুক থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর অবসেশনকে জিইয়ে রাখা। আত্মবিস্মৃত অনেকে হয়তো ভুলে গেছেন যে পাকিস্তানের হাতে কোন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন, কিন্তু পাকিস্তানের ‘মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্ট’ ভোলেনি যে তিরিশ লাখ বাঙালির (হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে) প্রাণ তারা কেড়ে নিয়েছে।
আর একটি কথাও আছে। ‘লাশের পাহাড়ের উপর পাকিস্তান বানাব’ হুঙ্কার দেওয়া অনেকেরই ছেলে-মেয়ে থেকে গিয়েছিল খণ্ডিত ভারতে; স্বয়ং জিন্নার মেয়েই তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। একটি বিরাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে জিন্না সাহেবের নাতিপুতিরা দিব্যি আছেন এই ভারতেই, তবে খামোকা কেন এবং কাদের জন্য একটি নতুন দেশ দরকার হল? ভারত অখণ্ড থাকলে প্রধানমন্ত্রী তো নেহরু কিংবা পটেলই হতেন, (পরবর্তী কালে ভোটে জিতে জিন্না নিজেও হতে পারতেন) সাভারকর কখনওই নন। তা হলে ভারত ভেঙে ভাগ করার জন্য এত ‘ডাইরেক্ট’ এবং ‘ইনডাইরেক্ট’ অ্যাকশন কেন? এই প্রশ্নের কিছু উত্তর হয়তো ভেঙ্কট ধুলিপালার ক্রিয়েটিং আ নিউ মেদিনার পৃষ্ঠায় পাওয়া যাবে, যেখানে স্বাধীনতা এবং দেশভাগের পূর্ববর্তী দশক জুড়ে দেওবন্দ তথা সেই সময়ের বেশ কিছু সংবাদপত্র এবং জিন্নার নিজস্ব ‘হোম স্টাডি সার্কল’-এর প্রোপাগান্ডার অনুপুঙ্খ আলোচনা রয়েছে। বিশদে না গিয়েও, এটুকু বলা যায় যে, সলমন রুশদি বললেও ‘ইনসাফিশিয়েন্টলি ইম্যাজিনড’ রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করেনি, পাকিস্তানের উৎপত্তির পিছনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তথা স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নের সবটাই শরিয়ত-নিয়ন্ত্রিত কোনও রাষ্ট্রের স্বপ্ন নয়, গণতান্ত্রিক কল্যাণকামী একটি রাষ্ট্রের কল্পনাও মিশে ছিল তাতে। কিন্তু খুব দ্রুত পাকিস্তান নিজের দ্বৈত সত্তার গণতান্ত্রিক দিকটি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে একটি নৃশংস সন্ত্রাসী ব্যবস্থার ধারক হয়ে উঠল, যাকে ‘রাষ্ট্র’ বলা চলে না আর, ‘রোগ স্টেট’ বলা যেতে পারে।
কাশ্মীরের ইতিহাস ১৯৪৭ সালে শুরু হয়নি। পাণিনি তাঁর ব্যাকরণ কাশ্মীরে বসেই লিখেছিলেন; ললিতাদিত্য থেকে অভিনবগুপ্ত কাশ্মীরেরই মানুষ ছিলেন, কাশ্মীরের কথা শেখ আবদুল্লা এবং হরি সিংহ দিয়ে আরম্ভ করার কথা নয়। কিন্তু আইএসআই নিয়ন্ত্রিত পাক-শাসক যে আজ বহু বছর ঠিক সেটাই করে আসছেন। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে বড়দিনের সময় শ্রীনগরের পবিত্র ধর্মস্থান থেকে পুণ্য স্মারক চুরির খবর ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তার মধ্যেই এই ‘গুজব’ নিয়ে অপপ্রচার করে পাক মিডিয়া। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একশ্রেণির খবরের কাগজও সেই অপপ্রচার ছাপতে থাকে। রাজাকার ও খান সেনাদের যৌথ সক্রিয়তায় প্রায় গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে নির্বিচারে সংখ্যালঘু হত্যা এবং ধর্ষণ আরম্ভ হয়। ফলত ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে ক্ষুধার্ত, রক্তাক্ত মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে, বাংলারই পূর্বাঞ্চল থেকে বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে এসে দাঁড়ান, অথচ তৎকালীন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের প্রতি চরম ঔদাসীন্য দেখায়। বিভিন্ন স্টেশন থেকে তাঁদের দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরের কাহিনি অনেকেরই জানা।
কাশ্মীরকে ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তানে পৈশাচিকতাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পাক কর্তৃপক্ষ। তারই বিবরণ আমরা পাই মুনতাসীর মামুন-এর ১৯৭১: গণহত্যা ও নির্যাতন নামক বইটিতে। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যায় নিহত মানুষের সংখ্যা তিরিশ লাখ বলে বলা হয়। ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। মামুনের মতে, যে-হেতু চিন, সৌদি আরব এবং সর্বোপরি আমেরিকা পাকিস্তানের এই নির্বিচার বাঙালি খুনকে সমর্থন করে, পাশ্চাত্যের গণহত্যা বিষয়ক গ্রন্থগুলোতে একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টা অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই চুকনগরে পাকিস্তানি সৈন্যদের কনভয় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এক দিনে প্রায় দশ হাজার মানুষকে হত্যা করলেও জেনোসাইডের ইতিহাসে তা তেমন ভাবে আলোচিতই নয়।
পাক সেনা অফিসার কর্নেল নাদের আলি লিখেছেন, তাঁকে আদেশ দেওয়া হয়, “...হত্যা করো এবং কোনও হিন্দু যেন বাদ না যায়।” আবার একই ভাবে সত্য, মামুনের ভাষায়, “ইসলামের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত মুসলমান কর্তৃক এত মুসলমান নিধনের ঘটনা নেই... যেমনটা হয়েছিল ১৯৭১-এ।”
এর পরও পাকিস্তানের শাসকরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে শান্তি এবং মানবাধিকারের কথা বলার নির্লজ্জতা দেখিয়ে থাকেন। তার কারণ হয়তো এই যে ‘ভিক্টিমস কান্ট ফরগেট, কালপ্রিটস কান্ট রিমেমবার’ কথাটাকে পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্ট শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আর তার ভিকটিম কেবল ভারত কিংবা বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও। তাঁদের ক্রমাগত এই আফিম গিলিয়ে আসা হচ্ছে যে, আয়তন এবং জনসংখ্যায় অনেক ছোট হলেও পাকিস্তানকে সামরিক ভাবে ভারতের সমান হতেই হবে।
এই আবহে বিজয় দিবসকে বেদনা-দিবস হিসেবেই পালন করা উচিত। পশ্চাতে যে আছে সে যে অহরহ ‘পশ্চাতে টানিছে’ তা ভুলে গেলে মূল্য আমাদেরই চোকাতে হবে।