ছবি পিটিআই।
রাজস্থানের চলৎ-চিত্রটি নূতন, কিন্তু চিত্রনাট্যের কাঠামোখানি সুপরিচিত। কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে যাহা ঘটিয়াছে, জয়পুরের কুনাট্যে তাহার ছায়া ঘনঘোর। ঘটনাবলি হুবহু এক নহে। চলচ্চিত্রে, সিরিয়ালে বা যাত্রাপালাতেও কোনও মডেল সফল হইলে ক্রমাগত তাহার অনুসরণ দেখা যায়, কিন্তু ‘স্টোরিলাইন’ অবিকল এক থাকে না। সচিন পাইলটের ‘বিদ্রোহ’ যদি ক্রমশ বিবর্ণ দেখায় এবং ভারতীয় জনতা পার্টির আশামুকুরেও সেই বিবর্ণতা প্রতিবিম্বিত হয়, তবে তাহাও রাজস্থানের রাজনীতির নিজস্ব বাস্তব বলিয়াই বুঝিতে হইবে। সেই বাস্তবের প্রথম এবং প্রধান সত্য: বিধানসভার অঙ্ক মিলাইবার জন্য পাইলটের ঝুলিতে আপাতত যথেষ্ট রসদ নাই। ভারতীয় রাজনীতির হাটে অঙ্ক রাতারাতি বদলাইতে পারে, বিশেষত এই জমানায়। কিন্তু এখানেই রাজস্থান রাজনীতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা— অশোক গহলৌত। এই মুখ্যমন্ত্রী কেবল অভিজ্ঞতায় প্রবীণ নহেন, কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলায় অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করিবার বিচক্ষণতা তাঁহার আছে। অতীতে তাহার প্রমাণ মিলিয়াছে, এই পর্বেও মিলিতেছে। তিনি শেষরক্ষা করিতে পারিবেন কি না, তাহা ভবিষ্যৎই বলিবে, কিন্তু প্রথমে বোঝাপড়ার চেষ্টা এবং পরে কঠোর অনুশাসন— তাঁহার পদক্ষেপগুলি যে এ-অবধি কার্যকর, সচিন পাইলট নিঃসন্দেহে তাহা অনুভব করিতেছেন।
অনিবার্য প্রশ্ন: তিনি নিজেকে এত দূর অবধি ঠেলিয়া দিলেন কেন? নৈতিকতার প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক, এই মহান দেশের রাজনীতির পালায় ক্ষমতাই একমাত্র সত্য। রাজ্য রাজনীতিতে ক্ষমতার দৌড়ে সচিন বরাবরই অগ্রবর্তী থাকিতে ব্যগ্র। গত নির্বাচনের পরেও সেই ব্যগ্রতা প্রকট ছিল। তাঁহাকে যুগপৎ উপমুখ্যমন্ত্রী এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির আসনে রাখিয়া দলের হাইকমান্ড সেই দাবিকে প্রভূত গুরুত্বও দিয়াছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী, হয়তো অগত্যা, তাহা মানিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু গত কয়েক দিনে পাইলট যে ভাবে নিজেকে চালনা করিয়াছেন, তাহাতে এমন অনুমানই স্বাভাবিক যে— তিনি আর দ্বিতীয় স্থানে থাকিতে রাজি নহেন, তাঁহার প্রকৃত লক্ষ্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আসন। ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাজনীতিতে আদৌ অস্বাভাবিক নহে, কিন্তু সামর্থ্য তথা সম্ভাবনার সহিত সেই আকাঙ্ক্ষার সাযুজ্য থাকা আবশ্যক। সচিন পাইলট নির্বোধ নহেন, তিনি নিশ্চয়ই জানেন, তাঁহার সামর্থ্য সীমিত।
এখানেই এই নাটকের তৃতীয় মাত্রা। অর্থাৎ বিজেপি। গহলৌত-পাইলট সংঘাতের কথা প্রকাশ পাইবার পরেই কেন্দ্রীয় শাসক দলের প্রতিনিধিদের কণ্ঠে শোনা গিয়াছিল: সচিন পাইলটের জন্য আমাদের দরজা খোলা, যে আমাদের আদর্শ মানে, আমরা তাহাকেই স্বাগত জানাই। এই দলের আদর্শের কথা শুনিলে কুট্টির ঘোড়া আজ আর হাসিবে বলিয়া মনে হয় না, কারণ কথাটি বহুব্যবহারে জীর্ণ হইয়াছে। কিন্তু নেপথ্যে কী ঘটিতেছে বা ঘটিতে পারে, তাহা বোধ করি পরিষ্কার। ইতিমধ্যে নেপথ্যকাহিনির নানা পর্ব উন্মোচিত হইতেছে। বিজেপি-শাসিত হরিয়ানার হোটেলে পাইলট-অনুগামী বিধায়কদের অবস্থান, ঘোড়া কেনাবেচার পরিকল্পনা সম্পর্কিত কথোপকথনের ‘রেকর্ড’, বিভিন্ন মাপের নেতাদের আচরণ, সব মিলাইয়া ষড়যন্ত্রের পরিচিত লক্ষণগুলি অতিমাত্রায় প্রকট। বস্তুত, তাহাতে অবাক হইবার কিছুমাত্র কারণ নাই, রাজস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে কংগ্রেসকে গদিচ্যুত করিবার সুযোগ নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহেরা ছাড়িয়া দিবেন, এমন কথা কোনও সচেতন নাগরিক ভাবিবেনই বা কেন? সুতরাং কংগ্রেসের সামনে আবারও একটি কঠিন পরীক্ষা। আশা করা যায়, দলনেতারা অনেক দিনই বুঝিয়া গিয়াছেন যে, নির্বাচনে জয়ী হইয়া সরকার গড়িবার পাঁচসালা পরীক্ষা আর যথেষ্ট নহে, সরকার বাঁচাইয়া রাখিবার ধারাবাহিক পরীক্ষা দিয়াই চলিতে হইবে।