স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচার এক নহে। স্বাস্থ্য ও পরিবেশ নষ্ট করিয়া আমোদ করিবার যে ইচ্ছা, তাহা দ্বিতীয়টির নমুনা। দীপাবলিতে বাজির বিক্রয় নিষিদ্ধ করিয়া সেই বার্তাই দিতে চাহিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। বাজি ফাটাইলে বায়ু দূষিত হয়, তাই দীপাবলিতে বাজিকে অবাধ ছাড়পত্র দিয়া নাগরিক স্বাস্থ্যহানির পথ মুক্ত করিয়া দিতে শীর্ষ আদালত নৈতিক ভাবে অসমর্থ। লক্ষণীয়, বিচারপতিরা বাজির উপর নিষেধাজ্ঞাকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য চাপাইয়া দেন নাই। বরং তাহাকে একটি পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা বলিয়াই দেখাইয়াছেন। তাঁহাদের বক্তব্য, বাজির ব্যবহার কম করিয়া বায়ুদূষণ কতটা কমে, এ বৎসর তাহা দেখা যাইতে পারে। ফলাফল দেখিয়া ভবিষ্যতে বাজির ব্যবহার বিষয়ে সিদ্ধান্ত লওয়া হইবে। এই পরীক্ষণমূলক সতর্কতা বিজ্ঞান-ভিত্তিক এবং নৈতিক। দিল্লির অধিবাসীরা জানেন, দীপাবলির পর বাতাসে দূষণের জন্য শ্বাসকষ্ট কী ভােব বাড়িয়া যায়, বিশেষত শিশুদের শ্বাসনালী সংকীর্ণ হওয়ায় তাহারা কতখানি কষ্ট পায়। পরিবেশবিদ এবং চিকিৎসক সমাজ এ বিষয়ে বারংবার সতর্ক করিয়াছেন। শীতের মুখে এই সময়টিতে রাজধানীতে হাওয়ায় স্রোত থাকে সামান্য, আরও নানা কারণে দূষণ বাড়িয়া যায়। গত কয়েক বৎসর এই সময়ে বায়ুদূষণ এমন আকার ধারণ করিয়াছে যে জনজীবন বিপর্যস্ত হইয়াছে। প্রতিবেশী চিনের রাজধানী বেজিং-এ বায়ুদূষণ এমন ভয়ানক আকার ধারণ করিয়াছে, যে বৎসরের কয়েকটি দিন দৃশ্যমানতা শূন্যে পৌঁছায়, জনজীবন সম্পূর্ণ স্তব্ধ হইয়া যায়, তাহাও সর্বজনবিদিত। তজ্জনিত ক্ষতি কত বিপুল, তাহা আন্দাজ করা কঠিন নহে। দিল্লি নিশ্চয়ই সেই বিন্দুতে পৌঁছাইবার আগে রাশ টানিতে চাহিবে। সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যকে সেই আলোতেই দেখিতে হইবে।
দিল্লির নাগরিক সমাজের এক বিরাট অংশ এই বক্তব্যে কেন ক্ষুব্ধ, বুঝিতে অসুবিধা হয় না। বিনোদনের স্বাধীনতাকে মৌলিক স্বাধীনতা ভাবিতেই সকলে অভ্যস্ত হইয়াছে, সেই বিনোদনের দাম যতই পড়ুক না কেন। সুতরাং, নাগরিকের শ্বাসগ্রহণের স্বাধীনতা নয়, নাগরিকের বিনোদনের স্বাধীনতায় সুপ্রিম কোর্ট কেন হস্তক্ষেপ করিতেছে, ইহাই প্রশ্ন। জনপ্রিয় লেখক এমনকী ইহার মধ্যে হিন্দুবিরোধী ‘মেকি ধর্মনিরপেক্ষতা’র আভাসও খঁুজিয়া পাইতেছেন। তাঁহারা মোটেই ভাবিবেন না যে, বিষয়টিকে আদালত অবধি পৌঁছাইতে হইল কেন? আইন কিংবা সরকারি বিজ্ঞপ্তিতেই যদি দূষণকারী বাজি বন্ধ হইত, তাহা হইলে আদালতকে মাথা গলাইতে হইত না। নাগরিক সংগঠনগুলি যদি উদ্যোগ লইত, পুলিশ যদি কর্তব্য করিত, অভিভাবকরা যদি শিশুদের জন্য মন্দ বাজি ক্রয় না করিতেন, তাহা হইলেও আদালতকে নিষেধাজ্ঞা শুনাইতে হইত না। জনস্বার্থের প্রশ্নে জনপ্রতিনিধিরা সর্বাংশে নিষ্ক্রিয় থাকিবে, আর আদালত অতি-সক্রিয় হইবে, ইহাই সাম্প্রতিক ভারতের দস্তুর।
সংশয় একটাই। কাজ হইবে কি? কলিকাতায় বহু পূর্বেই শব্দদূষণ প্রতিরোধের জন্য কালীপূজায় শব্দবাজির উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়াছিল আদালত। কিন্তু তাহা ক্রমশ শিথিল হইয়াছে, শব্দবাজির দৌরাত্ম্য আজও দূর হয় নাই, বেআইনি বাজি কারখানায় রাজ্য ছাইয়া গিয়াছে বাজিতে অবাধে বিষাক্ত পদার্থ মিশিতেছে। রাজধানীতেও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ ব্যর্থ হইতেছে। পঞ্জাব ও হরিয়ানায় চাষিরা এ বৎসরও শস্যের অবশিষ্ট ভাগ তুলিয়া ফেলিবার নির্দেশ অমান্য করিয়াছেন। তাঁহাদের দাবি, ধানের গোড়া তুলিবার বিপুল খরচ তাঁহারা বহন করিতে অক্ষম, তাই ফসলের অবশিষ্ট অংশে আগুন ধরানো হইতেছে। ধোঁয়ায় শহরগুলির শ্বাস রুদ্ধ হইতেছে। পরিবহণ এবং শিল্পজনিত বায়ুদূষণ। প্রশাসনের কর্তাদের বিজ্ঞপ্তি, পরিবেশ আদালতগুলির নির্দেশ কম নাই। কিন্তু সেগুলি কার্যকর হয় না।