ডিসেম্বর মাসে কেক কেন জয়নগরের মোয়ার যমজ ভাই হয়ে যায়? আর সেই মোয়া কেন জন্ম নেয় শেওড়াফুলি বা উত্তরপাড়ায়? বাঙালির শীত এমনই। ক্যালেন্ডার ডিসেম্বর ছুঁলে আর থার্মোমিটারের ধার ধারে না। লন্ড্রি বা আলমারি থেকে বেরিয়ে পড়ে গরম জামাকাপড়। উল উঠে যাওয়া ফুলস্লিভ বা দামি ওভারকোট, ওমটা একই রকম। বাঙালি শীতের উষ্ণতাকে শরীর-মনে মাখতে জানে। তবে আমাদের শীতকে বুঝতে গেলে তাকাতে হবে টিফিনবেলার স্কুলমাঠে। পৌষ-মাঘের রোদকে যেন আরও সোনালি করে তোলে লাল, নীল, সবুজ, গোলাপি ফুল। মাঠ না থাকলে ইট-বালি ভরা ছোট্ট মুক্তাঞ্চল। কিংবা বাঁধানো উঠোন, ছাদ। মুক্তির স্বাদ আর উদ্দামতায় খামতি হয় না। উত্তুরে হাওয়া সেই কিশলয়দের কাঁপিয়ে দিতে পারে না। বরং জাল ছেঁড়া র্যাকেট, তালি মারা ফুটবল, ইটে গড়া উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে বলে, “আমায় খেলতে নিবি?”
শীত বাঙালির ঘেমো, ক্লান্ত, দাবদাহক্লিষ্ট জীবনে পুনরুজ্জীবনের জাদুকাঠি। আবার ‘হওয়া না-হওয়ার গল্প’-এ কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন বলেন ‘এখন তার মাথার সব চুল সাদা, হাতের পাঁচ আঙুলে মাঘের শীত’, তখন শীত আমাদের আলিঙ্গন করে পরম মৃত্যুময়তায়। সেই মৃত্যুময়তাই এখন ঠান্ডা আলোর অভিশাপ নিয়ে দখল করেছে দুপুরের স্কুলপ্রাঙ্গণ। যেখানে ধুলোর মেঘে প্রাণের প্লাবন ওঠার কথা ছিল, ঘাসের উপর ছড়িয়ে পড়ার কথা ছিল কমলালেবুর খোসার, সেখানে এখন মরা দুপুর। পাঁচিলের পাশে পাতা ঝরে যাওয়া গাছে বসে সভ্যতার জঞ্জাল খোঁজে কাক। খাঁ-খাঁ করা শূন্য ক্লাসঘরের সারি, শুনশান বারান্দা, ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়া বেঞ্চ। ব্ল্যাকবোর্ডে বহু মাস আগে আঁকা ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র বা দুষ্টু ছাত্রছাত্রীর নাম হয়তো এখনও আবছা হরফে সেই সব হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা লিখে রেখেছে, যখন ক্ষুধিত পাষাণ জেগে উঠত প্রার্থনার ঘণ্টায়, বেঞ্চের উপর ঠাসাঠাসি বসত প্রাণবান শৈশব, বারান্দায় কান ধরে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে শাস্তিকে খুব একচোট শাস্তি দিত বেপরোয়া কৈশোর। সে দিন সময়ের চুল অকাল অসুখে সাদা হয়ে যায়নি।
ঘড়ির কাঁটার ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যে মানুষের সারি দেখা যায়। এঁরা অভিভাবক, হাতে নানা মাপের থলি। চাল, ছোলা, আলু কিংবা স্যানিটাইজ়ার, ডায়েরি, নতুন বই— ঝোলায় জমা হয় অনেক কিছুই। সেগুলো বাড়ি ফিরলে ডায়েরিতে লেখা হবে অনলাইন ক্লাসের হিসেব। আর ফুটন্ত ভাত অভাবের ঘরে ‘অমৃত’ হয়ে ‘টিকে থাকা’-কে নিশ্চয়তা দেবে। পেন্ডুলামটা যদি পাগলের মতো দুলতে দুলতে বলে, “বেঁচে থাকার কী হবে?” কারও কাছে উত্তর নেই।
শীতের অপরাহ্ণ বড় বিষাদের। ছাদের কার্নিশে আরও একটা কর্মহীন পাপের দিন শেষ হবে বলে এসে দাঁড়ায়। শুকোতে দেওয়া জামাকাপড়ের সঙ্গে সমাগত সন্ধের আবছা আলোয় দোলে তিন পরতের কাপড়ের টুকরো। দিনের শেষ তো এমন হওয়ার কথা ছিল না! আপাদমস্তক সাবান-ঘষা শরীরে ঘরে ফেরার উদ্দীপনা কোথায়? সদলবল পিকনিক বা শিক্ষামূলক ভ্রমণে যাওয়ার মেজাজ কই? মুখোশে যে মুখ ঢেকেছে, তার কাছে উদাত্ত হাসি, নলেন গুড় কিংবা পিঠেপুলি— কোনও কিছুরই স্বাদ নেই।
তবু নদীর ধারে খানিকটা খোলা আকাশ থেকেই যায়। দুপুর রোদে জনশূন্য উপকূলে দাঁড়িয়ে মুখোশ খুলে ফেলার মধ্যে থাকে প্রাণের আমেজ। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই মনের সেতু নির্মাণ করে পার্ক-বাগান-জঙ্গল ছুঁয়ে আসা। বড়দিনের বেড়ানোর হারানো সুর আর বাজে না। প্রকৃতি আর মানুষের মাঝখানে স্বার্থপর দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ভাইরাস। সর্বত্র সে কোভিড-হরফে লিখে রেখেছে: ‘অনধিকার প্রবেশ দণ্ডনীয়’। যেন বন্ধুর সঙ্গে টিফিন ভাগ করায়, নদীর ঘাটে বসে প্রাণ খুলে হাসায়, বইমেলায় গিয়ে এক হাতে বইয়ের প্যাকেট ঝুলিয়ে অন্য হাতে এগরোলে কামড় দেওয়ায় আমাদের অধিকার নেই। যেন জ্যৈষ্ঠের দাবানলে ঝলসে যাওয়া সমস্ত মুহূর্তের দামে শীতের একটা ঝলমলে সকালকে সংক্রমণ, মিউটেশন, মৃত্যুর খবরের কালো মেঘে না ঢাকলেই করোনার চলছিল না!
গির্জার ঘড়িতে মধ্যযামের বিষণ্ণ ঘণ্টাধ্বনি। জন্মদিনেও রাজার রাজা মুখোশ খুলে তাঁর চিরন্তন ভালবাসার হাসিটি হাসতে পারেন না। পাটিসাপ্টার প্রাচ্য-সুবাস কেক, পেস্ট্রির প্রতীচ্য-সঙ্গ পাওয়ার আশায় উচ্ছল হয়ে উঠতে পারে না। শীতের মনখারাপের সন্ধের সংক্রমণে সকলেই বিষাদের শিকার। স্কুলমাঠের গেটের ধারে পাতাহীন কৃষ্ণচূড়া গাছের মনখারাপ, ক্লাসঘরে বোর্ডের নীচে পড়ে থাকা চকের টুকরোগুলোর মনখারাপ, বারান্দার কোণে ভাঙা টিউবওয়েলের মনখারাপ। ফার্স্ট বেঞ্চের গম্ভীর, চশমা পরা বালিকাটি অথবা লাস্ট বেঞ্চের দুষ্টু কিশোর, যে ক্লাস চলাকালীন কাগজের প্লেন বানাত, তাদের মনও ভাল আছে কি? তাদের তো এখন স্পোর্টসের হিটের জন্য মাঠে চুন দিয়ে ট্র্যাক আঁকার কথা, মা-বাবার সঙ্গে ‘ব্যোমকেশ’-এর ছবি দেখতে যাওয়ার কথা! সারা বছরের অপেক্ষারও আজ খুব মনখারাপ! এমনকি, ভ্যাকসিনের খবরেও তেমন আনন্দ নেই। কবে তা পাওয়া যাবে? পেলেই কি কোভিড-দাসত্ব থেকে পুরোপুরি মুক্তি?
রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো এক দিন হঠাৎ ঘুম থেকে কোনও শিশু হয়তো শুনবে, “আর কত ঘুমাবি? উঠে পড়! স্কুলে যেতে হবে না? ফুলহাতা সোয়েটারটা পরবি কিন্তু। আজ বেশ ঠান্ডা পড়েছে।” পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর কবিতা এই মুহূর্তে আর কী হতে পারে? তা আবৃত্তি করার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণচূড়া গাছের শুকিয়ে যাওয়া শাখা-প্রশাখায় রঙের নদী বইবে। ক্লাসঘরের জানালাগুলো হাটখোলা হয়ে রোদ্দুরকে বলবে: “চলে এসো!” বেঞ্চগুলোর ধুলো উধাও হয়ে গিয়ে ফুটবে শিশু-কিশোর ফুল। স্মার্টফোন আর ট্যাবের কাঁধে হাত রেখে বলব, “তোমরা বিপদে সহায় হয়েছিলে। ধন্যবাদ। বইখাতার পাশে থেকো কিন্তু!”
শীত তো বসন্তের মুখবন্ধও বটে। গ্লাভস খুলে ফেলে সময় কি এক বার কলম হাতে তুলে নিতে পারবে? পরের শীতে স্কুলমাঠে ছোটাছুটি দেখবেন বলে অপেক্ষায় আছেন বেথলেহেমের ভালবাসার রাজপুত্র থেকে অজ পাড়াগাঁয়ের প্যারাবোলা স্যর— সকলেই। ভাইরাস, এ বার ভ্যানিশ হও দেখি! ঘণ্টা পড়ে গিয়েছে! নতুন ক্লাস শুরু হবে।