যারা চলে যাবে দূরে
Coronavirus Lockdown

অনলাইন লেখাপড়া হলে ক্লাসরুমের সাম্য হারিয়ে যাবে

নীতিনির্ধারকরা যখন অনলাইন লেখাপড়ার কথা বললেন, তাঁরা নিশ্চয় অন্তত এক বার ভেবেছিলেন, কত জন ছেলেমেয়ের বাড়িতে ইন্টারনেট আছে?‘ফাঁকা করার মতো টাকা অ্যাকাউন্টে থাকলে তো!’

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২০ ০০:১৭
Share:

প্রতীকী ছবি

সবাই শুনতে পাচ্ছিস?’ প্রায় আধঘণ্টা ধস্তাধস্তির পর শিবুদা ক্যামেরা, স্পিকার সব চালু করতে পেরে প্রশ্ন করলেন। গোপালের চায়ের দোকান বন্ধ, অতএব আড্ডাও বন্ধ ছিল এত দিন। নাছোড়বান্দা তপেশ শিবুদাকে শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে পেরেছে জ়ুমে আড্ডা মারার জন্য।

Advertisement

‘স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, শিবুদা,’ উত্তর দিল তপেশ। ‘শুধু শুধু এত দিন রাজি হচ্ছিলেন না। নির্ঘাত ভাবছিলেন, অ্যাপের ফাঁক গলে ম্যালওয়্যার ঢুকে পড়বে, আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেবে!’

‘ফাঁকা করার মতো টাকা অ্যাকাউন্টে থাকলে তো!’ শিবুদা হাসেন। ‘টাকা জমানোর অভ্যেসটা করতে পারলে আজ আর ভাবনা থাকত? অবিশ্যি, ভাবনা আমার এখনও নেই।’

Advertisement

‘তা হলে আপত্তিটা কোথায়? এখন তো ভিডিয়ো কনফারেন্সই ভরসা— দেখছেন না ইউনিভার্সিটির ক্লাস অবধি অনলাইন হচ্ছে?’ সূর্য বলল।

‘পুরো প্যারাডাইম শিফট হয়ে গেল— আপনি এখনও অতীত আঁকড়ে বসে!’ টিপ্পনি কাটল শিশির।

‘অতীত নয়, যেটাকে আঁকড়ে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছি, তার নাম জাস্টিস। ন্যায্যতা।’ গম্ভীর হয়ে উত্তর দেন শিবুদা। ‘তোদের সঙ্গে অনলাইন আড্ডার কথা বলছি না, বুঝতেই পারছিস— গোপালের দোকানে গিয়ে না বসলে আমার আড্ডা মারার মুড আসে না— আমি বলছি এই অনলাইন লেখাপড়া নিয়ে নতুন হিড়িকটার কথা। কাগজে দেখলাম, ইউজিসি রাজি হয়ে গেছে সব ইউনিভার্সিটিতে অন্তত ৪০ শতাংশ লেখাপড়া অনলাইনে করতে দিতে। তোরা দেখছিস পড়াশোনার ধরন পাল্টে যাচ্ছে। আমি কী দেখছি জানিস? আরও একটা সম্পদের সমবণ্টনের দিন ফুরলো।’

মেঘ না চাইতেই জল! অনলাইন আড্ডায় এসেও শিবুদা পুরনো মেজাজে— শিশিরের কথার খেই ধরে নিয়েছেন তিনি। তপেশরা গুছিয়ে বসে কম্পিউটারের সামনে।

‘একটা কথা ভেবে দ্যাখ,’ শিবুদা বলতে থাকেন, ‘শিক্ষার সুযোগ নিয়ে বৈষম্য প্রচুর— রিজ়ার্ভেশন করে যেটুকু কমেছে, তা কোনও মতেই যথেষ্ট নয়— কিন্তু, ক্লাসরুমে এক বার ঢুকতে পারলে একটা সাম্য ছিল। বণ্টনের ন্যায্যতা ছিল। জ্ঞান তো একটা মস্ত সম্পদ, একেবারে অর্থনীতির অর্থেই— ক্লাসরুমে শিক্ষক সেই সম্পদ বণ্টন করেন। এত দিন, মানে আমাদের চেনাপরিচিত ক্লাসরুমে সেই বণ্টনের মধ্যে কোনও অসাম্য থাকা সম্ভব ছিল না। শিক্ষক যেটা বলছেন, সেটা সবার জন্য সমান ভাবে বলছেন— ক্লাসে হাজির থাকলে সেই সম্পদের সমান ভাগ পাওয়া থেকে কেউ কাউকে আটকাতে পারত না। পড়াশোনাকে ক্লাসরুম থেকে বার করে এনে অনলাইন করে দিলে কোন ছাত্র তার কতটা ভাগ পাবে, সেটা আরও অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাবেই। তুই কোথায় থাকিস, সেখানে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি কেমন, তোর বাড়িতে ভাল ব্যন্ডউইডথ-এর কানেকশন নেওয়ার মতো পয়সা তোর আছে কি না, ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন আছে কি না— হাজার রকম জিনিস এসে পড়ছে মাঝখানে।

‘মানে, শিক্ষক যদি বণ্টনে বৈষম্য না-ও চান, সেটা ঠেকানোর উপায় তাঁর হাতে নেই। তুই এই জ্ঞান নামক সম্পদটার কতখানি ভাগ পাবি, সেটা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে মূলত তোর আর্থিক অবস্থার ওপর— যদি ভাল কানেকশন নেওয়ার, ভাল ডিভাইস কেনার টাকা তোর না থাকে, তা হলে এই সম্পদের ভাগও কম পাবি তুই। অর্থাৎ, ক্লাসরুমের বাইরের পৃথিবীটা সাধারণত যে অন্যায্য নিয়মে চলে, অনলাইন লেখাপড়ার দৌলতে সেই অন্যায্যতা ক্লাসরুমেও ঢুকে পড়ল। প্যারাডাইম শিফট-এর কথা বলছিলি না শিশির? এটা হল আসল প্যারাডাইম শিফট— দ্য লাস্ট ব্যাস্টিয়ন ইজ় ফলিং।’

তপেশরা স্তম্ভিত। অনলাইন ক্লাসের পক্ষে-বিপক্ষে হরেক তর্ক চলছে, কিন্তু শিবুদা একেবারে অন্য জায়গা থেকে ধরলেন কথাটা। খানিক ক্ষণ চুপ করে থাকার পর সূর্য বলল, ‘এই মোক্ষম আপত্তিটা কেউ করল না, শিবুদা?’

‘কেউ আপত্তি করছে না, সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে,’ শিবুদা উত্তর দিলেন। ‘যাদবপুরের সুরঞ্জনবাবু গোড়া থেকে বলছেন, অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। সে দিন দেখলাম জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রীরা হোয়াটসঅ্যাপে জোর প্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু, খুব বেশি লোক আপত্তি করছে না— তার চেয়েও বড় কথা, যাঁরা নীতি স্থির করেন, তাঁরা এর মধ্যে আপত্তিজনক কিছু দেখছেন না— সেটা ঠিক। প্রশ্ন হল, যে অন্যায্যতা এই রকম প্রকট, সেটাও কর্তাদের চোখে পড়ে না কেন?’

‘অনলাইন লেখাপড়ার মধ্যে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ব্যাপার আছে— তাই আর কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না,’ শিবুদার প্রশ্নের উত্তর দেয় তপেশ।

‘কথাটা ভুল বলিসনি, তবে পুরোপুরি ঠিকও নয়,’ বললেন শিবুদা। ‘এই ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড-প্রীতি জিনিসটার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে পুরো গল্পে। পল স্লোভিক, বারুচ ফিশহফ্-রা একটা পেপার লিখেছিলেন— বোধ হয় ১৯৭৮ সালে। একটা মোক্ষম কনসেপ্টের কথা বলেছিলেন তাঁরা— অ্যাফেক্ট হিউরিস্টিক। কোন জিনিসটা কতখানি বিপজ্জনক, সেটা নির্ধারণ করার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয় যে বিবেচনাটা, সেটা হল, জিনিসটাকে আমি পছন্দ করি কি না। আমাদের শিশির যেমন চুপিচুপি মোদীকে পছন্দ করে, আর সূর্য ঘোর অপছন্দ করে। মোদীর যে কোনও সিদ্ধান্তই— নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করছিস ভেবে দেখতে আরম্ভ করলেও— শিশিরের কাছে যতখানি গ্রহণযোগ্য হবে, সূর্যর কাছে হবে তার চেয়ে ঢের কম। এটা সেই সিদ্ধান্তটার দোষ-গুণ নয়, মোদীকে পছন্দ-অপছন্দের ফলাফল।’

‘সোজাসুজি গালি দিন না মশাই, খামখা মোদীভক্ত বলছেন কেন?’ আপত্তি করে শিশির।

‘আহা, ওটা কথার কথা,’ মুচকি হাসেন শিবুদা। ‘আসল কথাটা হল, যাঁরা নীতি স্থির করেন, তাঁদের যদি ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড-প্রীতি থাকে, তবে যে জিনিসের গায়ে প্রথম বিশ্বের গন্ধ, সেটার বিপজ্জনক দিকগুলো তাঁদের চোখে পড়বে কম। অ্যাফেক্ট হিউরিস্টিকের ফল। কিন্তু প্রশ্ন হল, দেশের সিংহভাগ ছেলেমেয়ের বাড়িতে যে ইন্টারনেট কানেকশন নেই, এই কথাটা গুলিয়ে যায় কী করে? আজকেই কাগজে দেখলুম, দেশের বারো আনা বাড়িতে এখনও ব্রডব্যান্ড কানেকশন নেই। সেটা চোখে পড়ছে না কেন?’

সবাই চুপ। কম্পিউটার স্ক্রিনে শিবুদার পিছনে তাঁর একটা বইয়ের আলমারি দেখা যাচ্ছে। তপেশ ভাবছিল, চেনাশোনার মধ্যে আর কারও এত বিচিত্র বিষয়ে এই পরিমাণ আগ্রহ কখনও দেখেনি সে।

‘বলতে পারলি না তো?’ নীরবতা ভাঙেন শিবুদা। প্রশ্নের উত্তর যে তিনিই দেবেন, এটা অবশ্য প্রশ্ন করার সময়ই জানতেন। ‘এর উত্তর দিয়েছিলেন আমার গুরু, ড্যানিয়েল কানেম্যান। অ্যামস্ টর্স্কির সঙ্গে মাঝেমধ্যেই একটা আলোচনা করতেন কানেম্যান— কোনও ঘটনার প্রবাবিলিটি, মানে সেটা ঘটার সম্ভাবনা, কী, সেটা সাধারণ মানুষ স্থির করে কী করে? সামান্য স্ট্যাটিস্টিক্স যে পড়েছে, সে-ই জানে, প্রবাবিলিটি হিসেব করতে হলে বেশ খানিকটা তথ্যের প্রয়োজন হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের হাতে সেই তথ্য থাকে না। তা হলে?

‘শেষ অবধি তাঁরা বুঝলেন, ব্যাপারটা হিউরিস্টিক প্রশ্নের খেলা। অর্থাৎ, যেহেতু আসল প্রশ্নটার উত্তর জানা নেই, ফলে আমরা একটা অন্য— কিন্তু আসল প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত— প্রশ্নের উত্তর খুঁজি, এবং সেটাকেই সেই মূল প্রশ্নের উত্তর বলে চালাই। শুধু প্রবাবিলিটির ক্ষেত্রেই নয়, সব ক্ষেত্রে। যেমন ধর, তোকে যদি প্রশ্ন করি যে নিজের জীবন নিয়ে তুই কতটা খুশি, সেটার ঠিকঠাক উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন। তার বদলে তুই যে প্রশ্নটার উত্তর দিবি— নিজের অজান্তেই প্রশ্নটাকে পাল্টে নিবি তুই— সেটা হল, এখন তোর মন কেমন আছে? যদি ভাল থাকে, বলবি যে জীবন নিয়ে তুই বেশ খুশি। মেজাজ খারাপ থাকলে উত্তরও পাল্টে যাবে।’

‘আমি বুঝতে পেরেছি ব্যাপারটা,’ শিবুদার কথার মধ্যেই বলে উঠল শিশির। ‘আমার বউ সমানে বলে চলেছে যে আমার কোভিড হওয়ার চান্স নাইনটি পারসেন্ট। আসলে বোধ হয় মনে মনে চাইছে কোভিড হোক আমার!’

‘তুই কিন্তু বাড়িতে!’ মনে করিয়ে দেয় তপেশ। তখনই শিশিরের বউ ঋতুপর্ণার গলাও শোনা যায় পিছন থেকে, ‘সব শুনছি। তোমার হচ্ছে, দাঁড়াও!’

‘আমি পালাব এ বার, তার আগে গল্পটা শেষ করে যাই,’ বললেন শিবুদা। ‘এতগুলো কথা কেন বললাম, জানিস? কারণ, আমাদের নীতিনির্ধারকরা যখন অনলাইন লেখাপড়ার কথা বললেন, তাঁরা নিশ্চয় অন্তত এক বার ভেবেছিলেন, কত জন ছেলেমেয়ের বাড়িতে ইন্টারনেট আছে? কিন্তু এই কঠিন প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার বদলে তাঁদের মন খুঁজে নিয়েছিল একটা সহজ প্রশ্ন— আমার চেনাশোনা কত জন ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে ব্রডব্যান্ড আছে, কত জনের ল্যাপটপ আছে? বুঝতেই পারছিস, বড়কর্তাদের দেখদেখতার মধ্যে সবার বাড়িতেই এই সামান্য জিনিসগুলো আছে। ফলে, তাঁরা গোড়ার প্রশ্নের উত্তরটা পেয়ে গেলেন।

‘কথাটা হল, সামান্য পরিসংখ্যান দেখলেই যে প্রশ্নের ঠিক উত্তর পাওয়া যায়, তার জন্যও মনের ওপর ভরসা করা কেন? ওটাই মনের মাহাত্ম্য। মন এমন নিশ্চিত ভাবে উত্তর দিয়ে দেয় যে আলাদা করে উত্তর খোঁজার কথাও মনে পড়ে না আর। বিশেষত এই রকম গোলমেলে সময়ে, যখন একের পর এক সিদ্ধান্ত করে যেতে হচ্ছে। যাক গে, এ বার উঠি।’

‘এত তাড়া কিসের মশাই, বাড়িতেই তো থাকবেন।’ সূর্য বাধা দেয়।

‘বাড়িতে আছি বলেই। এখানে গোপাল কোথায় যে মুখের সামনে চায়ের কাপ ধরবে? নিজেকেই তো বানিয়ে নিতে হবে।’ লগ আউট করলেন শিবুদা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement