মাতৃভাষায় শিক্ষা ও সাঁওতাল সমাজ

আরও একটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কেটে গেল। অথচ পরিতাপের বিষয় এটাই যে, ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আজও নিজের ভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগ থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। লিখলেন পার্থপ্রতিম রায়।আরও একটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কেটে গেল। অথচ পরিতাপের বিষয় এটাই যে, ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আজও নিজের ভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগ থেকে অনেকটাই বঞ্চিত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯ ০১:২২
Share:

সাঁওতালি ভাষায় পড়াশোনার জন্য আন্দোলন। নিজস্ব চিত্র

সমাজ বা জাতির বিকাশের জন্য প্রয়োজন সর্বজনীন শিক্ষার পরিবেশ। সকলের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ। ভারতের জনসংখ্যার এক শতাংশ অর্থাৎ, এক কোটিরও বেশি সাঁওতাল অধিবাসী। তাঁরা সাঁওতাল ভাষায় কথা বলেন। এই ভাষা ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন ভাষা। ভাষাবিজ্ঞানী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন— “কোল ভাষা হচ্ছে ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন ভাষা। দ্রাবিড়, আর্য আর তিব্বতি চিনা বা মঙ্গল জাতির লোক ভারতে আসবার আগেও কোল ভাষায় (অর্থাৎ কিনা আধুনিক কোল ভাষার অতি প্রাচীন রূপের) প্রচার এদেশে ছিল।…কোল গোষ্ঠীর ভাষা হচ্ছে সাঁওতাল, মুরান্ডি, হো, কুরকু, শবর প্রবর প্রভৃতি।’’

Advertisement

আরও একটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কেটে গেল। অথচ পরিতাপের বিষয় এটাই যে, ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আজও নিজের ভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগ থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুদ্ধসম’—রবীন্দ্রনাথের এই সর্বজনস্বীকৃত অতি সহজ কথাটা এঁদের ক্ষেত্রে এখনও সর্বজনীন রূপ পায়নি। অথচ শিক্ষাবিদেরা বারবার বলে থাকেন, এক জন শিশুকে তার মাতৃভাষায় শিক্ষা দিতে না-পারলে তার কাছে পড়াশোনাটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

সাঁওতাল জাতিকে লিপি বিতর্ক থেকে বের করে আনার জন্য এবং সাঁওতালি ভাষার শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য সাঁওতাল পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু ১৯২৫ সালে সাঁওতালি ভাষার জন্য উপযুক্ত ও স্বতন্ত্র বর্ণমালা প্রবর্তন করেন, যা অলচিকি নামে পরিচিত। বর্তমানে একে সাঁওতালি বর্ণমালা বলা হচ্ছে। ১৯৩২-’৩৩ সালে তিনি কাপড়ে এই লিপি লেখেন এবং ১৯৩৮ সালে কাঠে টাইপ করে মুদ্রণ আকার দেন। ১৯৪৬ সালে অলচিকির আধুনিক রূপ মুদ্রিত হয়। কিন্তু এই লিপির আশানুরূপ প্রচার বা প্রসার হয়নি। ১৯৭৯ সালে বামফ্রন্ট সরকার অলচিকি লিপিকে নীতিগত সমর্থন জানায়। ভিন্ন ভিন্ন লিপি দিয়ে সাঁওতালি চর্চার বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টাগুলির গুরুত্ব কমে। ২০০৩ সালে সংসদে সাঁওতালি ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাষা চালু হওয়ার কথা। হয়েছেও।

Advertisement

সংবিধানের ৩৫০ অনুচ্ছেদে প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষা ব্যবহার প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে। বলা হয়েছে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারের জন্য রাজ্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্যোগী হওয়ার কথা। সাঁওতালি ভাষার ক্ষেত্রেও এই কথা বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য। সংবিধানেরই ৪৫ তম অনুচ্ছেদ অনুসারে রাজ্য আইন প্রণয়ন করে এক বা একাধিক ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষার মর্যাদা দিতে পারে। সাঁওতালি ভাষাও এই স্বীকৃতি পেতে পারে। ২০১১ সালে আমাদের রাজ্যে সাঁওতালিকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। যদিও আক্ষেপ এটাই যে, সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ১৬ বছর পরেও সাঁওতালি ভাষা শিক্ষার সঠিক পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি দেশে। আজও শিক্ষক চেয়ে কিংবা পাঠ্যবই এবং সাঁওতালি বিষয় চালুর দাবি জানিয়ে সাঁওতালি পড়ুয়াদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকদেরও আন্দোলন করতে হয়। এ রাজ্যে জঙ্গলমহলের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে সাঁওতালি সম্প্রদায়ের সংখ্যা বেশি। সেখানেও সাঁওতালি মাধ্যমে পঠন পাঠনের ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত সমস্যার জন্য জঙ্গলমহলে সাঁওতালি পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুল ছুটের প্রবণতাও বাড়ছে।

পাশাপাশি এটাও মানতে হবে যে, রাজ্যে সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষা সচেতনতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাঁওতালি সাহিত্য এখন অনেক সমৃদ্ধ। সাঁওতালিতে এখন অনেক বই, পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। পশ্চিম মেদিনীপুর-সহ কিছু কিছু জায়গায় পুরোদস্তুর সাঁওতালি বইমেলাও হচ্ছে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও সাহিত্যচর্চা বাড়ছে। প্রতি বছর সাঁওতালি প্রথম ভাষা হিসাবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সামগ্রিক প্রভাবে শিক্ষার অধিকার, উপযোগিতা, সুযোগ সুবিধা,শিক্ষার ব্যক্তি ও সমাজকল্যাণকর ভূমিকা, জীবনের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক বিষয়ে এই সমাজ অধিক সচেতন হয় উঠছে। ফলে মাতৃভাষায় পঠনপাঠনের সুযোগের বিষয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা স্বাভাবিক এবং সুস্থ সামাজিক অগ্রগতির লক্ষণ। সর্বাঙ্গীন সমাজ বিকাশের স্বার্থে ভাবনার উত্তরণ বিশেষ ভাবে কাম্য। রবীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে যথার্থ বলেছেন, “শিক্ষার অভসেচন ক্রিয়া সমাজের উপরের স্তরকেই দুই এক ইঞ্চি মাত্র ভিজিয়ে দেবে আর নীচের স্তর পরম্পরা নিত্য নীরস কাঠিন্যে সুদূর প্রসারিত মরুময়তাকে ক্ষীণ আবরণে ঢাকা দিয়ে রাখবে এমন চিত্তঘাতী সুগভীর মুর্খতাকে কোনো সভ্য সমাজ অলসভাবে মেনে নেয়নি।”

২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে বীরভূম জেলার মোট জনসংখ্যা ৩৫,০২,৪০৪। এর মধ্যে ৬ থেকে ৮ বছর বয়সের ছেলেমেয়ে মোট জনসংখ্যার ১২.৮১ শতাংশ। অন্য দিকে, তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬.৯২ শতাংশ বা ২,৪২,৪৮৪ জন। এই তফসিলি জনজাতিভুক্ত মানুষের ৬০ শতাংশের অধিক সাঁওতাল জাতিভুক্ত। জেলার ১৯টি ব্লকের মধ্যে খয়রাশোল, দুবরাজপুর, রাজনগর ও সিউড়ি ব্লকে সাঁওতাল সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ মোট তফসিলি জনজাতিভুক্ত সংখ্যার ৭০ শতাংশের বেশি। সুতরাং জেলার সামগ্রিক বিকাশের স্বার্থে সাঁওতালদের নিজস্ব লিপির মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এর সঙ্গে সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে নতুন স্কুল স্থাপন, সাঁওতালি ভাষা জানা শিক্ষক নিয়োগ, বর্তমান কর্মরত শিক্ষকদের সাঁওতালি ভাষা, সংস্কৃতি ও পরম্পরা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে । প্রয়োজন মাতৃভাষা তথা সাঁওতালি ভাষায় শিক্ষাদানের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং গৌরবময় সাঁওতাল জীবন-দর্শন ও ইতিহাস গাঁথা তুলে ধরা। অন্যথায় পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর সেই বিখ্যাত গাথার প্রতিফলন বংশ পরম্পরা চলতে থাকবে।

‘‘আছে তোমার বর্ণমালা

আছে তোমার ভাষা

আছে তোমার ধর্ম ,

জীবনেরই আশা

হারিয়ে গেলে ভাষা

তোমার হারিয়ে গেলে বর্ণ

নিজেই তুমি হারিয়ে যাবে

হারিয়ে গেলে ধর্ম ।।”

সুখের কথা সম্প্রতি রাজ্যের সাঁওতাল অধ্যুষিত অন্যান্য জেলার সঙ্গে বীরভূমেও আটটি নির্বাচিত প্রাথমিক স্কুলে অলচিকি লিপিতে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে। মহম্মদবাজার, সাঁইথিয়া, ইলামবাজার ও খয়রাশোল ব্লকে এই স্কুলগুলি অবস্থিত। এই সব এলাকায় পড়ুয়াদের ৯৫ শতাংশের অধিক আদিবাসী। সমগ্র বিষয়টি কার্যকর করার জন্য সমীক্ষার পাশাপাশি সাঁওতাল ভাষা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নীতি নির্ধারণকারী পর্ষদ গঠন করা যেতে পারে। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে অলচিকিতে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার শেষে আপার প্রাইমারি বা উচ্চ বিদ্যালয়ে পঠনপাঠন এবং পরিকাঠামো গঠনের বিষয়টিও পরষদের বিবেচনাধীন হওয়া বিধেয়।

(লেখক বিশ্বভারতীর উপ-গ্রন্থাগারিক, মতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement