Economist

সংবিধানের পরিপন্থী ব্যবস্থা

কৃষি আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার বিচারের ভারও আদালতের বদলে নিজেদের হাতে নিয়ে নিতে চাইছেএই রাজ্যে একটা পরিবেশ আছে, যেখানে সামাজিক রক্ষণশীলতা উত্তর ভারতের তুলনায় অনেক কম। ফলে, বাঙালি মধ্যবিত্ত বুঝতেই পারছে না যে, বিজেপি এলে সামাজিক ক্ষেত্রে ঠিক কতখানি বিপদ হবে।

Advertisement

অর্থনীতিবিদ অমিত ভাদুড়ি

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:১২
Share:

প্র: কৃষকদের যে আন্দোলন চলছে, ইতিমধ্যেই তার জোর কমছে বলে শোনা যাচ্ছে।

Advertisement

অমিত ভাদুড়ি: শোনা যে যাচ্ছে, সেটা কার কথা শোনা যাচ্ছে? মূলধারার মিডিয়া বলছে। কেন, সেই আলোচনায় ঢুকব না। কিন্তু, আন্দোলনের যে সব খবর আমি বিভিন্ন প্রত্যক্ষ সূত্র থেকে পাচ্ছি, সেগুলো সম্পূর্ণ অন্য কথা বলছে। নভেম্বরের শেষে যখন আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল, তখন সেটা মূলত পঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকদের ছিল। অর্থাৎ, আন্দোলনটা ঘনীভূত ছিল এক জায়গায়। এখন সেই আন্দোলনের চরিত্রটা বদলে গিয়েছে। মহারাষ্ট্র থেকে কৃষকদের একটা বড় দল হাজার কিলোমিটার পার করে আন্দোলনে যোগ দিতে আসছে। রাজস্থানের কৃষকরা যোগ দিচ্ছেন, উত্তরপ্রদেশের কৃষকরাও আগের চেয়ে বেশি আসছেন। যাঁরা কাছাকাছি অঞ্চলে থাকেন, তাঁরা দিনের বেলায় আসছেন, রাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। এই খবরগুলো দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ঠিক ভাবে পৌঁছচ্ছে না।

প্র: পশ্চিমবঙ্গে কৃষক আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। কিন্তু, এখন যে আন্দোলন চলছে, এই রাজ্যে তার আঁচ লাগছে না কেন?

Advertisement

উ: পশ্চিমবঙ্গের কৃষক আন্দোলন— সেটা তেভাগাই হোক, নকশালবাড়িই হোক বা বর্গা আন্দোলনই হোক— তার মূল চরিত্র ছিল জমির মালিকানা-কেন্দ্রিক। অর্থাৎ, জমির মালিকের বিরুদ্ধে, জমিদারদের বিরুদ্ধে, কৃষিজীবী মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। জমিতে উৎপন্ন ফসলের অধিকার কার কতখানি, সেটা নিয়েই মূল বিবাদের সূত্রপাত। পঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকরা এখন যে আন্দোলন করছেন, চরিত্রগত ভাবে তেমন কৃষি আন্দোলন এ দেশে আগে কেউ দেখেনি। পশ্চিমবঙ্গে যে ফসল উৎপন্ন হয়, কৃষকরা সেটা মূলত মহাজন, জোতদারদের কাছে বিক্রি করেন। এই রাজ্যে মান্ডি নেই। ফলে, পঞ্জাবে এখন প্রত্যক্ষ যে সমস্যা, সেটা বাংলায় নেই।

অন্য ভাবে ভেবে দেখলে অবশ্য, পঞ্জাব হরিয়ানাতেও সমস্যাটা শেষ অবধি ফসলের অধিকারের। কৃষিতে কর্পোরেট পুঁজি এলে কৃষক তাঁর জমিতে কোন ফসল ফলাবেন, সেটা কার কাছে কত দামে বিক্রি করবেন, এই সিদ্ধান্তগুলোর অধিকার শেষ অবধি কৃষকের থাকবে না বলেই আশঙ্কা। অর্থাৎ, জমির মালিকানা যারই হোক, ফসলের মালিকানা কার্যত কৃষকের থাকবে না।

প্র: তা হলে কি এই আন্দোলনকে মূলত সম্পন্ন বড় চাষিদের আন্দোলন হিসেবেই দেখা প্রয়োজন?

উ: সেটা অতি-সরলীকরণ হবে। এই আন্দোলন তো শুধু বড় চাষিরা করছেন না। ছোট চাষিরাও করছেন, ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকরাও করছেন। তাঁদের সবার আলাদা আলাদা কারণ আছে আন্দোলনে নামার। ছোট চাষিরা উদ্বিগ্ন, মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থা উঠে গেলে তাঁরা ফসলের দামই পাবেন না। ভূমিহীন কৃষকরা ভাবছেন, সরকার ফসল না কিনলে গণবণ্টন ব্যবস্থাও থাকবে না। তাঁদের পেটে টান পড়বে।

প্র: সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে যে, কৃষকদের আন্দোলন করার অধিকার আছে। আদালতের এই অবস্থানের সঙ্গে নাগরিকত্ব আইন সংক্রান্ত প্রতিবাদের সময়কার আদালতের অবস্থানের মধ্যে কোনও ফারাক দেখতে পান কি?

উ: আদালত তখন জানিয়েছিল যে অনন্ত কাল রাস্তা বন্ধ করে রেখে প্রতিবাদ চালাতে দেওয়া যায় না। এক অর্থে, সেই নির্দেশ আন্দোলনের বিপক্ষেই গিয়েছিল। কিন্তু, দুটো ঘটনায় যে ফারাক আছে, সেটাও অনস্বীকার্য। এই ক্ষেত্রে কিন্তু আন্দোলনকারী কৃষকরা রাস্তা আটকাননি। তাঁরা যাতে দিল্লিতে ঢুকতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে সরকার রাস্তা কেটেছে, আটকেছে। কাজেই, এখানে রাস্তা বন্ধ করে জনজীবনে ব্যাঘাত ঘটানোয় কেউ যদি দায়ী হয়, তবে তা সরকার। আইনি প্রশ্নে ঢুকছি না, কিন্তু দেশের শীর্ষ আদালত যে কৃষকদের আন্দোলনের অধিকারকে স্বীকার করেছে, সেটা সুসংবাদ।

প্রশ্ন হল, আদালত যদি স্বীকৃতি দেয়ও, বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকারগুলো কি তা মান্য করছে? উত্তরপ্রদেশের দুটো জায়গা, চন্দৌসি আর সিংপুর থেকে খবর পেলাম, সেখানে নাকি পুলিশ বলেছে, কোনও কৃষক যদি আন্দোলনে যোগ দেন, তবে তাঁর পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা হবে। কারও জরিমানা করার অধিকার তো পুলিশের নেই। কেউ আইন ভাঙলে পুলিশ তাকে আদালতে পেশ করতে পারে, আদালত শাস্তি বিধান করবে। এ ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ সরকার এমন কোনও আইন করেছে বলেও শুনিনি। বিজেপি আদালতকে এড়িয়ে প্রশাসনের হাতেই বিচারের ভার তুলে দিতে চাইছে, এটা তারই একটা উদাহরণ।

প্র: আপনি কথাপ্রসঙ্গে বলছিলেন, নতুন কৃষি আইনে দেশের সাংবিধানিক চরিত্র ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সেটা কি এই জায়গা থেকেই?

উ: এক দিক থেকে নয়, দেশের সাংবিধানিক চরিত্র ক্ষুণ্ণ হচ্ছে দু’দিক থেকে— নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকারের দিক থেকে, এবং রাজ্যের অধিকারের দিক থেকে। প্রথমে ব্যক্তিগত অধিকারের কথা বলি। ভারতের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে অধিকার দিয়েছে, কোনও বিষয়ে কোনও বিবাদ বা মতানৈক্য হলে আমরা আদালতের শরণাপন্ন হতে পারি ন্যায়বিচার প্রার্থনা করে। নতুন কৃষি আইনে বলা হয়েছে, কৃষিক্ষেত্রের বিবাদ নিয়ে আদালতে যাওয়া যাবে না। যেতে হবে সরকার-নির্দিষ্ট কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে। জেলাশাসকের কাছে। সরকারের বিরুদ্ধে, অথবা সরকার-ঘনিষ্ঠ কোনও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে সরকারের তৈরি করা প্রতিষ্ঠানের কাছে গেলে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে কি না, সেই তর্কের মধ্যে যদি না-ও ঢুকি, যে দায়িত্ব স্পষ্টতই আদালতের, সরকার সেটা কেড়ে নিতে চাইছে। আদালতের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে নাগরিককে বঞ্চিত করছে। জেলাশাসক তো বিচারের অধিকারী নন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের হাতেই বিবাদ-নিষ্পত্তির ভার তুলে দিচ্ছে।

এবং, এই প্রবণতা যে শুধু কৃষিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নয়। এটা একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করা হচ্ছে যে, আদালতের বদলে সরকার বা শাসনবিভাগ বিচারের দায়িত্ব নিতে পারে। এর পর হয়তো বিভিন্ন দেওয়ানি বিবাদে বলা হবে যে, সরকারই বিচার করবে। গণতন্ত্রে সেটা হবে অতি অগ্রহণযোগ্য। কলকারখানায় কোনও বিবাদে, অথবা ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদে যদি সরকার, বা সরকারি প্রতিষ্ঠান যদি বিচারের অধিকারী হয়, সেটাও খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে।

অন্য দিকে, কৃষি ও জমি, দুটোই রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়। কেন্দ্রের নয়। নভেম্বরের আগে অবধি কেন্দ্রীয় সরকার বলছিল যে, কৃষি ক্ষেত্রে কোনও সংস্কার করা হলে তা রাজ্য সরকারের মারফতই করা হবে। কিন্তু এই আইন করে পুরোটাই কেন্দ্র নিজের অধিকারে নিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করল। এটাও দেশের সাংবিধানিক চরিত্রের বিরোধী। বিভিন্ন অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য ইতিমধ্যেই এটা নিয়ে আপত্তি করছে— কেরল, রাজস্থান, পঞ্জাব।

প্র: বিজেপি কি কৃষিতে একটা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে, যেখানে কৃষকরা প্রত্যক্ষ ভাবে প্রশাসনের তাঁবে থাকবেন?

উ: বিজেপির একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। তারা সামাজিক ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক, সনাতন বর্ণব্যবস্থায় বিশ্বাসী; কিন্তু ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে কর্পোরেটপন্থী—তারা মনে করে, ব্যবসায়ীদের লাভের সুযোগ করে দিলে তাঁরাই দেশকে বৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবেন। এটা ফ্যাসিস্ট মানসিকতার নির্ভুল চিহ্ন। গোটা দুনিয়াতেই ফ্যাসিস্টরা এই সামাজিক রক্ষণশীলতা আর কর্পোরেটপন্থার দ্বিত্ব বজায় রেখে চলে।

পশ্চিমবঙ্গে এখন অনেকেই বিজেপির দিকে ঝুঁকছেন। তাঁরা আসলে বিজেপির এই চেহারার সঙ্গে পরিচিত নন। বিভিন্ন কারণে এই রাজ্যে একটা পরিবেশ আছে, যেখানে সামাজিক রক্ষণশীলতা— জাতপাতের বিচার ইত্যাদি— উত্তর ভারতের তুলনায় অনেক কম। ফলে, বাঙালি মধ্যবিত্ত বুঝতেই পারছেন না যে, বিজেপি এলে সামাজিক ক্ষেত্রে ঠিক কতখানি বিপদ হবে। এবং, হাতে গোনা কয়েক জন পুঁজিপতির হাতে দেশের আর্থিক লাগাম চলে গেলে কী মুশকিলে পড়তে হবে।

সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement