ঘুম থেকে উঠে টিভি খুলতেই দেখছি, কাশ্মীরী পণ্ডিতেরা জম্মুতে আন্দোলনে নেমেছেন। তেলঙ্গনায় আবার কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলন। আবার গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন নিয়ে গুরুঙ্গ দিল্লি এসে হুমকি দিচ্ছেন।
এ দিকে দিল্লিতে বসে আমরা অখণ্ড ভারতের জয়গান গেয়েই চলেছি বছরের পর বছর। প্রজাতন্ত্র দিবস এল বলে। বোট ক্লাব-ইন্ডিয়া গেট এলাকায় কুচকাওয়াজের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে।
এ এক রহস্যময়তা। ভারতীয় সভ্যতার কি বিশেষ কোনও মূলস্রোত আছে? জাতীয় সংহতির ধারণা কি আধুনিক ভারতের মূলস্রোত থেকে তার প্রাণরস আহরণ করে? এ সবই বিতর্কের বিষয়। বিতর্ক চলছে এবং চলবে। আসলে জাতীয় সংহতি বলতে যেন আমরা কখনওই এমন ভারতে না থাকি যে ছোট ছোট সংস্কৃতির প্রবাহ এক বৃহৎ ভারত নামক সংস্কৃতির সাগরে এসে বিলীন হয়ে যাবে।
আসলে ভারতের প্রজাতন্ত্র ও অখণ্ড গণতন্ত্র বোধহয় বহুত্ববাদী যুক্তরাষ্ট্রীয় সংহতি। সমাজবিজ্ঞানী নির্মলচন্দ্র বসু শিমলার ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ-এ জাতীয় সংহতি নিয়ে ১৯৬৬-র জুন মাসে ছ’টি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতাগুলি ১৯৬৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ছিল, প্রবলেমস অফ ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ভারতে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠেনি। এখানে ছোট-বড় নানা রাজ্য ছিল, কিন্তু কোনও একটা স্থায়ী রাষ্ট্র ছিল না। সর্বভারতীয় সংস্কৃতির ঐক্যের একটা ধারণা ছিল কিন্তু রাষ্ট্রীয় ঐক্য ছিল না। আধুনিক যুগে ব্রিটিশদের প্রবর্তনে এ দেশে ধনতন্ত্রের বিকাশের সূত্রপাত হলেও পুঁজিবাদের বিকাশও এ দেশে সুষম ভাবে হয়নি। সমাজের নানা স্তরে এই অসম অর্থনৈতিক বিকাশের ফলে তা জাতীয় সংহতির বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বভারতীয় চেতনা আর আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য ও প্রতিষ্ঠা কামনার সংঘাত ক্রমশ বেড়েছে।
ভারতে দ্বিতীয় সমস্যা হল হিন্দু ও মুসলমান সম্পর্কের সংঘাত ও সমস্যা। তৃতীয় বাধা হল জাতি বা বর্ণের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি। চতুর্থত, জাতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে আঞ্চলিক অর্থনীতির স্বশাসনের ভারসাম্যের অভাবও এক বড় সমস্যা। পঞ্চমত, নগরকেন্দ্রিক জীবনযাপনের সঙ্গে গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিভিত্তিক জীবনধারার প্রভেদেও সংহতি বিপন্ন হচ্ছে।
প্রভেদ বা পার্থক্য কিন্তু বিরোধ নয়। এই পার্থক্যগুলি অনেক সময়ে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক কারণে খুব বড় হয়ে ওঠে। অধ্যাপক সজল বসু ১৯৯২ সালে রিজিওনাল মুভমেন্টস: পলিটিকস অফ ল্যাঙ্গুয়েজ, এথনিসিটি-আইডেন্টিটি নামক গ্রন্থে নানা ধরনের আঞ্চলিক আন্দোলনের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পরিধি নিয়ে আলোচনা করেন। দ্রাবিঢ়স্থান, আজাদ পঞ্জাব, পঞ্জাবিসুবা, ঝাড়খণ্ড, বঙ্গাল খেদা, মুক্ত নাগাল্যান্ড, মিজো ইউনিয়ন, তেলঙ্গানা, মুলকি, উত্তরাখণ্ড, শিবসেনা, গোর্খাল্যান্ড, বড়োল্যান্ড— এ ধরনের আঞ্চলিক আন্দোলনগুলি নিয়ে সজলবাবু আলোচনা করেন। এ হেন বিবিধ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তা হলে অখণ্ড ভারতের জাতীয়তাবাদের চরিত্রটা কী হবে? আশিস নন্দী একেই বলেছিলেন, ইল্লেজিটিমেসি অফ ন্যাশনালিজম (অক্সফোর্ড-১৯৯৪)।
আসলে স্বাধিকারের পরিধি সীমিত হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্র, রাজনীতি, গোষ্ঠী সংহতি, শ্রেণি-সংগঠন— সব কিছু মিলিয়ে এই পরিণতি। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, আঞ্চলিক স্বাধিকারকে যদি আমরা মর্যাদা না দিই, যদি ভাবি অখণ্ড রাজনীতির দাওয়াই আমাদের ভিন্নতাকে অখণ্ডতার স্টিমরোলার দিয়ে সমান করে দেবে তা হলে সেটা মস্ত বড় ভুল হয়ে যাবে।
ভাষা, সংস্কৃতি, জাতিগোষ্ঠী, বর্ণ সামাজিকতা, এই সবের স্বকীয় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। রাষ্ট্রনীতি বা রাজনীতির শর্ত দিয়ে এর উপর বিধিনিষেধ আরাপ চলবে না। সমষ্টির চাপিয়ে দেওয়া গুণ দিয়ে মানবিক গুণের স্বকীয়তা অর্জন অসম্ভব।