আরিফ ও নাজিয়া, মৃত্য়ু হয়েছে তাদেরই এক সন্তানের। ছবি: পিটিআই
রাত্রিতে ঘুমাইয়া সকালে আর ওঠে নাই মহম্মদ জহান। মায়ের সহিত চার মাসের শিশুটিও রাত কাটাইতেছিল শাহিন বাগে, প্রবল শীতে। সম্ভবত ঠান্ডা লাগিয়া তাহার মৃত্যু হইয়াছে। মা নাজিয়া জানাইয়াছেন, তাঁহার অন্য দুই সন্তান, তথা সকল শিশুর সুরক্ষার কথা ভাবিয়া তিনি অবস্থান চালাইবেন। এই দৃঢ়তা প্রশংসনীয়। সাম্প্রদায়িক বিভেদ রুখিতে প্রতিবাদের প্রয়োজনও অনস্বীকার্য। তাহা সত্ত্বেও ওই শিশুর মৃত্যু কিছু প্রশ্ন তুলিয়া দেয়। শিশুর স্বাস্থ্য ও পরিচর্যার ভার যাঁহার উপর ন্যস্ত, সেই অভিভাবকেরা কি কোনও কারণে সন্তানের সুরক্ষাকে লঘু করিয়া দেখিতে পারেন? জীবনের অধিকার সকল মৌলিক অধিকারের প্রথম ও প্রধান, শিশুর ক্ষেত্রে সেই অধিকার রক্ষার দায়িত্ব অভিভাবকদেরই। সামাজিক আন্দোলন, ধর্মীয় বিধিপালন বা জীবিকা অর্জন, কোনও কারণেই অভিভাবক এমন সিদ্ধান্ত কেন লইবেন, যাহাতে শিশুর স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়? কেহ বলিতে পারেন, সন্তানের জীবন বিপন্ন হইবে, তাহা নাজিয়া নিশ্চয়ই বুঝিতে পারেন নাই। তাঁহাকে দোষারোপ কি সঙ্গত? প্রশ্নটি দোষী খুঁজিবার নহে। দিল্লির প্রবল শীতে উন্মুক্ত স্থানে রাত্রিযাপন যে শিশুর জন্য ভাল নহে, তাহার স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হইতে পারে, ইহা আন্দাজ করা কঠিন নহে। তাহার মা সম্ভবত সন্তানের ঝুঁকি বুঝিয়াও, প্রতিবাদ করিবার কর্তব্যকে অগ্রাধিকার দিয়াছিলেন। দিল্লির শাহিন বাগ, লখনউ-এর ঘণ্টাঘর, কলিকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে এমন অনেক মহিলা এই বিবেচনাতেই সন্তান-সহ রাত জাগিতেছেন। চার মাসের মহম্মদ জহানের মতো আরও কত শিশু প্রাণের ঝুঁকির সম্মুখীন, কে বলিতে পারে?
অন্য প্রতিবাদীরা কেন তাঁহাদের নিষেধ করিতেছেন না? প্রবল শীতে শিশুর স্বার্থ বিঘ্নিত হইবার যথেষ্ট কারণ আছে, তাঁহারা জানেন। তাঁহারা তবু আপত্তি করিতেছেন না। কারণ একাধিক। একটি কারণ এই যে, ভারতের পরিবারে শিশু-পরিচর্যার দায় প্রায় একক ভাবে মায়ের। যৌথ পরিবার ভাঙিবার ফলে তাহা আরওই সত্য। মহম্মদ জহানের পিতামাতা কাজের খোঁজে উত্তরপ্রদেশের বরেলী ছাড়িয়া দিল্লিতে বাস করিতেছেন। এমন অগণিত পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারে মা যেখানেই থাকেন, শিশুসন্তানকে সঙ্গে রাখিতে বাধ্য হন। প্রবল গরমে, তীব্র শীতে জীবিকা অর্জনের তাগিদে মা বাহিরে কাজ করিলে শিশুটিও সেইখানে থাকে। খাদান কিংবা ইটভাটার অসহনীয় পরিবেশে বহু শিশু বাড়িয়া ওঠে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে মা থাকিলে শিশুটিও থাকিবে, এমন ভাবিতে সকলে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে। ইহাকে ‘সমস্যা’ বলিয়া দেখিতে লোকে ভুলিয়াছে। কর্মরতা মায়ের শিশুর জন্য ‘ক্রেশ’ খুলিবার সরকারি পরিকল্পনা রহিয়া গিয়াছে প্রধানত কাগজেই।
অপর একটি তিক্ত সত্য এই যে, শিশুর মর্যাদা এ দেশে সামান্যই। বাবা-মা শিশুসন্তানকে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করিতে কিংবা অকালে বিবাহ দিতে দ্বিধা করেন না। শিশুর কিসে ক্ষতি হইবে, তাহা জানিয়াও অভিভাবক কিংবা প্রতিবেশী তাহা হইতে শিশুকে নিবৃত্ত করে না, প্রতিবাদও করে না। সরকারি কর্তারাও শিশু অধিকারের লঙ্ঘন দেখিয়া চক্ষু বুজিয়া থাকেন। ফলে শিশুর প্রাণসংশয় দেখিয়াও পরিজন-প্রতিবেশী উচ্চবাচ্য করেন না। কেবল অজ্ঞানতা নহে, অবজ্ঞাও রহিয়াছে ইহার মধ্যে। শিশুর জন্য বড়দের কর্তব্য লইয়া ভাবা জরুরি।