শারদীয়া দুর্গাপূজার সকল তিথিই কি ‘মহা’ অভিধায় যুক্ত হতে পারে? এই আলোচনার আগে বলা দরকার, এখনকার কালে বঙ্গদেশীয়রা, বিশেষত নগরবাসীগণ, বাংলা সন, মাস, তারিখ, তিথি ইত্যাদি সম্পর্কে খুবই অসচেতন। ইংরেজি সাল-মাস-তারিখেই তাঁরা অভ্যস্ত। খুব অল্পসংখ্যক বাড়িতে একাদশী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা প্রভৃতির খোঁজ রাখতে দেখা যায়। অপরাপর তিথি সম্পর্কে এটি আরও বেশি সত্য। সেগুলির ক্ষেত্রে প্রায় সকলকেই হয়তো জ্ঞানহীন বলা চলে।
এমনকি ‘মহালয়া’র বেলাতেও এটা ঘটে। দিনটি সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহাল। শুধু বেতারে ভোরের চণ্ডীপাঠ শোনার তাগিদে নয়। ওই দিন যে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে তর্পণ করতে হয়, তা-ও সবার জানা। কিন্তু তিথিটি কী? প্রশ্ন করলে ‘মহালয়া তিথি’ উত্তরও পেয়েছি। অমাবস্যা সেখানে স্থানই পায়নি!
তবে ‘মহা’ না হলেও বিশেষ কারণ বা দিনের তাগিদে কতকগুলি তিথি মনে রাখার চল আছে। যেমন জামাইষষ্ঠী, জন্মাষ্টমী, অক্ষয় তৃতীয়া, শ্রীপঞ্চমী, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, বুদ্ধ পূর্ণিমা ইত্যাদি। এই সব তৃতীয়া, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, অষ্টমী বিশেষ দিনের অনুষঙ্গেই উচ্চারিত হয়। কিছু কাল যাবৎ ধন-ত্রয়োদশী এবং রামনবমীও বঙ্গসমাজে অনেকে মনে রাখা শুরু করেছেন। আর দিন মাহাত্ম্যেই বাংলা পঞ্জিকার পয়লা বৈশাখ এবং রবীন্দ্রনাথের কৃপায় ২৫ বৈশাখ ও ২২ শ্রাবণ অনেকেরই মনে থাকে। যদিও সুবিধার্থে এক বার তবু ঝালিয়ে নিতে হয়, নববর্ষ এপ্রিলের ১৪, না ১৫? অথবা এ বার পঁচিশে বৈশাখ কি মে মাসের ৭ তারিখে পড়ল, না ৮ তারিখ!
তিথি অনুযায়ী মনে রাখার বেলায় দুর্গাপূজার দিনগুলি অনিবার্য ব্যতিক্রম। সেখানে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী ভোলার প্রশ্নই নেই। তার মধ্যেও বিশেষ করে মহাষ্টমীর অঞ্জলি। ভক্তি, আবেগ, উৎসাহ একাকার। যদিও ব্যবহারিক সুবিধার্থে সেখানেও ষষ্ঠী বা অষ্টমী কোন দিন, তা ইংরেজি ক্যালেন্ডারের তারিখেই মনে রাখা সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে।
এ বার মূল প্রসঙ্গ। দুর্গাপূজার অষ্টমী ও নবমী তিথির আগে ‘মহা’ শব্দটি যুক্ত করার সঙ্গত কারণ আছে। কিন্তু এখন চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমীতেও ‘মহা’ শব্দটি প্রযুক্ত হয়। তা যথাযথ বলে মনে হয় না। কোনও শব্দ প্রয়োগে ব্যাকরণ, অভিধান, আপ্তবাক্য প্রভৃতির সহায়তা বা সমর্থন প্রয়োজন। দুর্গাপূজার মহাষ্টমী ও মহানবমী ছাড়া অন্য তিথিগুলিতে ‘মহা’ শব্দের প্রয়োগ শাস্ত্রে দেখা যায় না।
শাস্ত্রীয় বচন অনুসারে দুর্গাপূজাকে ‘মহাপূজা’ বলা হয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণে শ্রীশ্রী চণ্ডীর দ্বাদশ অধ্যায়ে আছে, ‘শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী।’ অর্থাৎ, শারদীয়া দুর্গাপূজাই মহাপূজা হিসেবে পরিগণিত। বসন্তকালীন দুর্গাপূজাকে সেখানে ‘মহাপূজা’ বলা হয়নি। যদিও কোনও কোনও মতে, মহাপূজা মানে মহামায়ার পূজা। তাই বসন্তকালীন দুর্গোৎসব অর্থাৎ বাসন্তী পূজাও মহাপূজা। একই যুক্তিতে কালী, জগদ্ধাত্রী রূপে মহামায়ার সকল পূজাই মহাপূজা বলে গণ্য হবে।
কালিকাপুরাণে দুর্গাপূজাকে মহোৎসব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কালিকাপুরাণের ষষ্টিতম অধ্যায়ে দেখা যায়, ‘দুর্গাতন্ত্রেণ মন্ত্রেণ কুর্য্যা দুর্গা মহোৎসবম্।’ এই অধ্যায়েই আমরা দেখি, ‘আশ্বিনস্য তু শুক্লস্য ভবেদ্ যা অষ্টমী তিথিঃ। মহাষ্টমীতি সা প্রোক্তা দেব্যাঃ প্রীতিকরী পরা।।’ আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষীয় অষ্টমী তিথি দেবীর খুবই প্রীতিকরী এবং সেটি ‘মহাষ্টমী’ নামে খ্যাত।
পরের শ্লোকেই তৎপরবর্তী নবমীর উল্লেখ। যেখানে আমরা ‘মহানবমী’ পাই। ওই শ্লোকে আছে, ‘ততেঽনু নবমী যা স্যাৎ সা মহানবমীস্মৃতা। সা তিথিঃ সর্ব্বলোকানাং পূজনীয়া শিবপ্রিয়া।।’ এতে স্পষ্ট হয়, মহাষ্টমী পরবর্তী নবমী হল সর্বলোক-পূজনীয়া শিবপ্রিয়ার ‘মহানবমী’ পূজার তিথি। অতএব মহানবমী বলা সম্পূর্ণ শাস্ত্রসিদ্ধ।
কালিকাপুরাণের পঞ্চাশীতিতম অধ্যায়ে পুনরায় দেখি, ‘শরৎকালে মহাষ্টম্যাং দুর্গায়া পরিপূজনম্। নীরাজনং দশম্যান্ত কুর্যাদ্বৈ বলবৃদ্ধয়ে।’ বলবৃদ্ধির নিমিত্ত শরৎকালের মহাষ্টমীতে দুর্গার পূজা এবং দশমীতে নীরাজন কর্তব্য। আরও আছে। ‘শরৎকালে মহাষ্টম্যাং দুর্গায়াঃ পূজনে বিধি।’ অর্থাৎ অষ্টমীকে মহাষ্টমী, আর নবমীকে মহানবমী বলার উল্লেখ পাওয়া গেল। দশমী কিন্তু নয়।
বাকি রইল ষষ্ঠী ও সপ্তমী। সেখানেও একই। কালিকাপুরাণে দেখা যায়, ‘বোধয়েদ্বিল্বশাখাসু ষষ্ঠ্যাং দেবী ফলেষু চ।’ ষষ্ঠীর দিন বিল্বশাখা ও ফল দ্বারা দেবীর বোধন ও পূজা করতে হবে। এর পর বলা হচ্ছে, ‘সপ্তম্যাং বিল্বশাখাং তামাহৃত্য প্রতিপূজয়েৎ।’ সপ্তমী তিথিতে আবার দেবীর পূজা হবে। লক্ষণীয়, এখানেও মহাপূজার ষষ্ঠী ও সপ্তমী তিথি দু’টিকে ‘মহা’ বলা হচ্ছে না। পঞ্জিকাতেও দুর্গাষষ্ঠী, দুর্গাসপ্তমী লেখা থাকে। মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী নয়। একই ভাবে মহাদশমীও ভাবনার অতীত!
দুর্গাপূজার তিথিগুলিতে মাহাত্ম্য আরোপের জন্য যদি সব ক’টির সঙ্গে মহানন্দে ‘মহা’ যোগ করা হয়, তাতে হয়তো মনে বা বাচনে মহাতৃপ্তি লাভ করা যেতে পারে! তবে আসলে সেগুলি শব্দের অপব্যবহার। শাস্ত্রনির্দিষ্ট কর্মের তিথি শাস্ত্রসম্মত ভাবে উল্লেখ করাই উচিত বলে মনে হয়।