Durga Puja 2020

নামভূমিকায়

শুম্ভ-নিশুম্ভ, রক্তবীজ, মহিষাসুর সবাইকে বধ করে পৃথিবীর বিপদসংহারের পরে, ভারতীয় সংস্কৃতির মহিমায় স্বামীসোহাগিনিতে রূপান্তরিত হয়ে যান স্বয়ং দেবী দুর্গা দুর্গতিনাশিনীর বৈশিষ্ট্য আরও অনেক। তাঁর পুজোয় বৈদিক যজ্ঞ আর বামাচারী তন্ত্র একাকার। বেদ সৃষ্টির আগে থেকে ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত, পবিত্র। আর তন্ত্র মদ, মাংস, শ্মশান, শবদেহ ও ‘অপবিত্র’ সব কিছুর কারবারি।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২০ ০০:৩৫
Share:

প্রতীকী চিত্র।

অদ্যই শেষ রজনী। আগামী কাল সকাল সাড়ে এগারোটার মধ্যে নীলকণ্ঠ পাখি কৈলাস পর্বতে উড়ে গিয়ে খবর দেবে, পুত্রকন্যা-সহ দেবী পার্বতী স্বামীগৃহে ফিরছেন। বিকেলে সিঁদুরখেলা, করজোড়ে অভিবাদন যা-ই হোক, পঞ্জিকামতে বেলা ১১টা ৩১ মিনিট অবধি দশমী। পতিগৃহে দুর্গাকে ফিরতেই হবে। মহাকবি কালিদাস তাঁর রঘুবংশম-এর শুরুতেই জানাচ্ছেন, ‘বাগর্থাবিব সম্পক্তৌ বাগর্থ-প্রতিপত্তয়ে/ জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী-পরমেশ্বরৌ।’ মানে, পার্বতী এবং পরমেশ্বরের মধ্যে শব্দ ও অর্থের মতো নিত্যসম্বন্ধ। আমি তাঁদের বন্দনা করছি। দুর্গা তথা উমা যে মহেশ্বরের প্রাণপ্রিয়া সে আমরা জানি। তাঁর কাছেই তো আমরা রূপের, যুদ্ধে জয়লাভের ও শত্রুবিনাশের প্রার্থনা জানাই—রূপং দেহি, জয়ং দেহি, দ্বিষো জহি।

Advertisement

ভারতীয় সংস্কৃতির চমৎকারিত্ব এখানেই—যে দেবী শুম্ভ-নিশুম্ভ থেকে রক্তবীজ, মহিষাসুর সবাইকে বধ করে পৃথিবীকে বিপন্মুক্ত করবেন, তাঁর রূপান্তর ঘটিয়ে স্বামীসোহাগিনি করে তোলায়। আসলে তো তিনি বিন্ধ্য পর্বতের অরণ্যে বনচারী ও অন্তেবাসী জনজাতিদের পূজিত দেবী—বিন্ধ্যবাসিনী।বিন্ধ্য পর্বতে তিনি পৌঁছেছিলেন এই রকম নবমীর রাতে। তার আগে বিষ্ণুর নিদ্রিত চোখে। তিনিই তো নিদ্রা। প্রাণিকুলকে ওই সময়ে মোহের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে দেন। সেই নিদ্রারই অন্য নাম রাত্রি। দেবীর প্রসাদে জীবন থেকে সভ্যতা সবই স্তব্ধ হয়ে যায়। অতঃপর নতুন করে তৈরি হয় জীবন ও সৃষ্টির মোহ, মায়া। দেবীর আর এক নাম তাই মহামায়া।

নিদ্রা বা মহামায়া কী করলেন? হরিবংশ জানাচ্ছে, তিনি বন্দিনি দেবকীর চোখে গভীর ঘুম এনে দেন। বিষ্ণু তখন দেবকীর গর্ভে দানবভ্রূণ সংস্থাপিত করেন। শিশু জন্মায়, কংস সেই সদ্যোজাত দানবশিশুদের ধ্বংস করেন। সপ্তম শিশুটি সংস্থাপিত হল রোহিণীর গর্ভে— বলরাম। অতঃপর অষ্টম গর্ভের গল্প সকলের জানা। কারারক্ষীদের চোখে নিদ্রা এল, বাসুদেব কারাগার থেকে বেরিয়ে প্রবল ঝড়জলে সদ্যোজাত শিশুটিকে রেখে এলেন গোকুলে যশোদার কাছে। আর মহামায়া তখন এলেন দেবকীর সন্তানরূপে। কংস সেই শিশুকন্যাকে তুলে আছাড় মারতে গেল, বাচ্চা মেয়েটি আকাশে উড়ে গেল। সে তখন পূর্ণ যুবতী, এক হাতে ত্রিশূল, আর এক হাতে তরবারি, ঠোঁটে পানপাত্র। আকাশ থেকেই তার ঘোষণা, ‘তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।’ অতঃপর বিষ্ণু নিদ্রাকে জানালেন, বিন্ধ্য পর্বতে তুমি অধিষ্ঠান করবে। সেখানেই শুম্ভ, নিশুম্ভ দুই দানবকে বধ করবে। এখনও উত্তরপ্রদেশের গোকুলে শিশু কৃষ্ণের মন্দিরে ঢোকার আগে প্রবেশতোরণের পাশে মহামায়াকে দর্শন করতে হয়। লোকে হরিবংশ পড়লে জানত, যে দেশে বছর বছর কন্যাভ্রূণ হত্যা হয়, সেখানে মহামায়া থাকেন না।

Advertisement

মহামায়া তা হলে কোথায় থাকেন? মিথ জানাচ্ছে, তিনি এই মর্তধামে বেছে নিয়েছেন উত্তরপ্রদেশে দলিত ও জনজাতি-অধ্যুষিত বিন্ধ্যারণ্য। সেটিই তাঁর প্রথম পীঠস্থান। বৃহন্ননন্দিকেশ্বর পুরাণ অনুযায়ী আজ নবমীর রাতে দেবীপুজোর মন্ত্র, ‘বিন্ধ্যস্থাং বিন্ধ্যনিলয়াং দিব্যস্থানবাসিনীম্’। বিন্ধ্য পর্বতের এই দেবীর খ্যাতি ব্যাপ্ত হয়েছিল সুদূর কাশ্মীরেও। কলহন তাঁর রাজতরঙ্গিনী-তে জানাচ্ছেন, বিন্ধ্যাচলের অরণ্যে ভ্রামরী দেবীর অধিষ্ঠান। দুর্গোৎসবের প্রাবল্যে বাঙালি ভুলে গিয়েছে, দেবীর অন্য নাম ভ্রামরী। অবশ্য কলিকালে এক নাথযোগীর শাসনে বিন্ধ্যাচল-সমন্বিত সারা উত্তরপ্রদেশে যে দলিত মেয়েরা একের পর এক ধর্ষিত হবেন, আমাদের পূর্বসূরিরা ভাবতে পারেননি।

পূর্বজরা আরও অনেক কিছুই ভাবতে পারেননি। ব্রাহ্মণ্যবাদী সমুদ্রগুপ্তের আমলে ভুলুন্দা নামে এক সামন্ত দু’টি মাতৃমন্দির স্থাপন করেন। এই মাতৃদেবীরাই সাম্রাজ্যের প্রান্তে অরণ্যঘেরা জনজাতি রাজ্য রক্ষা করেন। বলা নিষ্প্রয়োজন, গুপ্ত রাজাদের এ নিয়ে আপত্তি ছিল না। দুর্গার ইতিহাসই বুঝিয়ে দেয় ব্রাহ্মণ্যবাদ আর আজকের হিন্দুত্ববাদে ঢের তফাত।

দুর্গতিনাশিনীর বৈশিষ্ট্য আরও অনেক। তাঁর পুজোয় বৈদিক যজ্ঞ আর বামাচারী তন্ত্র একাকার। বেদ সৃষ্টির আগে থেকে ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত, পবিত্র। আর তন্ত্র মদ, মাংস, শ্মশান, শবদেহ ও ‘অপবিত্র’ সব কিছুর কারবারি। অসুরবধের পর দেবীর মাথায় রাজছত্র ধরছেন বৈদিক ইন্দ্র। আবার দেবীকে অঞ্জলিদানের আগে আজও কোশাকুশি ও নানা উপচার শুদ্ধ করার ‘ভূতশুদ্ধি’, নিজেকে শুদ্ধ করার যে ‘ন্যাস’, তা একেবারে তান্ত্রিক পদ্ধতি। শুধু বেদ আর তন্ত্র নয়, আগামী কাল যে কোলাকুলি-প্রথা, তার অন্য নাম শবরোৎসব। চার দিনের পুজো শেষে দেবীকে জলে বিসর্জনের পদ্ধতিটি এসেছে কামরূপ বা অসম থেকে। যাঁরা শুধু নবরাত্রি ও দশেরায় রাবণবধের ব্যাখ্যাটিই একমেবাদ্বিতীয়ম্ বলে ভাবেন, তাঁরা আসলে দুর্গার এই বহু-পরিচিতিটি খেয়াল রাখেন না। অথচ, এখানেই দুর্গার প্রকৃত মাতৃমূর্তি। শবর থেকে রাজকাহিনি, কৃষ্ণের বোন থেকে শিবের বৌ, কামরূপ থেকে কুলু, সবই তাঁর অঙ্গাঙ্গি। এক দেশ, এক দেবী, এক বিধানের স্বকপোলকল্পনা মাতৃপুজোয় নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement