কলকাতায় বণিকসভার অধিবেশনে শিল্পপতিদের উদ্দেশে চটজাত দ্রব্যের ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাতে চটশিল্পের মালিকেরা কতটা উৎসাহিত হয়েছেন, বোঝা গেল না। তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যথেষ্ট চটের বস্তা উৎপাদন করা যাবে না। শ্রমিক নেই, পাটের উৎপাদন কম। সঙ্কটের চেনা গল্প।
চট এ রাজ্যের প্রধান শ্রমনিবিড় শিল্প। যত উৎপাদন হবে, সরকার সবটা কিনতে তৈরি। আন্তর্জাতিক বাজারেও চাহিদা আছে। গত কয়েক বছরে শ্রমিকসংখ্যা কমলেও উৎপাদন বেড়েছে। তা হলে সঙ্কট কোথায়? আসলে, চটশিল্পে কল্পিত কাহিনি ঘুরে বেড়ায়, যা মূলত শ্রমিকসঙ্কটের গল্প। শিল্পের স্বার্থেই দেখা প্রয়োজন, শ্রমিকেরা শিল্পের পথে ঠিক কোথায়, কতখানি বাধা তৈরি করছেন।
চটকল পশ্চিমবঙ্গের এমন এক শ্রমনিবিড় শিল্প, যেখানে স্থায়ী, অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক প্রায় আড়াই লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। স্থায়ী শ্রমিক এখন কমে গিয়েছে, মাসিক বা দৈনিক মজুরিও বাড়েনি। এক জন অতি দক্ষ স্থায়ী শ্রমিকের বেতন দৈনিক ৫৩৭ টাকা, অদক্ষ শ্রমিকের বেতন ৩৭০ টাকা থেকে শুরু, আধাদক্ষ ও দক্ষ শ্রমিকদের বেতন দৈনিক ৫০০ টাকার মধ্যে, যেখানে অনেক রাজ্যেই অস্থায়ী শ্রমিকের বেতনই দৈনিক ৬০০ টাকার বেশি। অথচ, শ্রমের ন্যায্যমূল্য ধরেই কেন্দ্র পাটের দর ধার্য করে।
প্রতিটি চটকলে এখন কমপক্ষে ১০-১১ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে অনেক শ্রমিকই মাসে ২৬ দিন কাজ করতে পারেন না। তা সত্ত্বেও লকডাউন শুরু হতেই চটকল মালিকেরা শ্রমিক নিয়োগের শর্ত আরও শিথিল করার এবং কাজের সময় আরও বাড়ানোর সুপারিশ করেন সরকারের কাছে। যেন শ্রমিকেরা অতিরিক্ত সুবিধা পাচ্ছেন। বাস্তব তার উল্টো। লকডাউন পর্বে চটকলগুলো শ্রমিকদের বেতন মেটায়নি, বকেয়া মজুরিও দেয়নি অনেকে। বাধ্য হয়ে চুক্তি-শ্রমিকদের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নিজেদের গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। অনেক স্থায়ী শ্রমিকও।
শ্রমিকের অপ্রাপ্তির ছবির এটা অংশমাত্র। বামফ্রন্ট সরকার চটকলে অস্থিরতার কারণ খুঁজতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব সৌরীন রায়ের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করেছিল। দু’দশক আগের কমিশনের রিপোর্ট বলে, ২০ হাজার শ্রমিকের গ্র্যাচুইটি বাকি, বকেয়া অর্থের পরিমাণ তখনই ৬০০ কোটি টাকা। আজ চটকলগুলিতে অন্তত পঞ্চাশ হাজার শ্রমিকের গ্র্যাচুইটি বাকি, টাকার অঙ্ক হাজার কোটির কম হবে না। বহু শ্রমিক গ্র্যাচুইটি না পেয়ে মারা গিয়েছেন, পরিবারও টাকা পায়নি। সম্পূর্ণ গ্র্যাচুইটি পেয়েছেন এমন শ্রমিক হাতেগোনা। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা জমা না দেওয়ায় তাঁরা পেনশন থেকে বঞ্চিত।
কী করে ন্যূনতম সুবিধা না দিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে চটকলগুলি? ৭৭টি চটকলের মধ্যে গোটা চব্বিশ বাদ দিলে প্রায় কোনওটিরই নির্দিষ্ট মালিকানা নেই। আছে ঠিকা নেওয়া ইজারাদার, কোর্টের মাধ্যমে দখল নেওয়া ম্যানেজমেন্ট, লাইসেন্সপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তি। এঁরা শিল্পপতি নন, দীর্ঘমেয়াদি লাভ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। শিল্পের সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক কম, তাঁদের লক্ষ্য কম খরচে বেশি লাভ। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে সম্পর্কের জোরে আইন উপেক্ষা করলেও সরকার নির্বিকার।
চটশিল্প আদৌ অলাভজনক কি না এবং তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সঙ্কটাপন্ন বলে দেখানো হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছে কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রক। কিন্তু চটশিল্প কী করে লাভজনক হতে পারত, সে কথাও ভাবা প্রয়োজন। গত চার দশকে উৎপাদন পদ্ধতির কৃৎকৌশলগত উন্নয়ন হয়নি, কারণ ইজারাদার ও লাইসেন্সপ্রাপ্তদের অনীহা। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী চটকল আধুনিকীকরণের জন্য ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। সে টাকা হয় খরচ হয়নি, নতুবা হিসেব দাখিল হয়নি অডিটে। বার বার বিভিন্ন কমিশন বা কমিটির রিপোর্টে চটশিল্পে কালো টাকার এক মাফিয়া অর্থনীতি ও দুষ্টচক্রের সমান্তরাল অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। শিল্পের অভ্যন্তরে অস্থিরতা ও অব্যবস্থার উৎস এটাই। আইন না মানাই চটশিল্পের আইন।
এখন কারখানা খোলা জরুরি, কিন্তু পুরোদমে উৎপাদন চালু করার মতো শ্রমিক হাজির নেই। বকেয়া বেতনের নিশ্চয়তা না থাকলে শ্রমিকদের কাজে ফেরাও অনিশ্চিত। কেরল, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে দিনমজুরি করলেও যে টাকা মেলে, চটকলে দক্ষ শ্রমিকেরাও তা পান না।
যথেষ্ট উৎপাদন না হওয়ায় চটের বস্তার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চটকলগুলিকে উৎপাদন বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছে জুট কমিশনারের দফতর, এখনই তিন লক্ষ বেল বস্তা দিতে হবে (এক বেলে ৫০০ বস্তা)। এ বছর রবি মরশুমে চটের বস্তার রেকর্ড চাহিদা। এই সুবিধাজনক পরিস্থিতিতেও চটশিল্পের মালিকদের হেলদোল নেই। শিল্পসম্পর্ক রক্ষাতেও গুরুত্ব নেই। চটের বস্তার উৎপাদন কম হলে কেন্দ্রীয় সরকার ফের সিন্থেটিক বস্তার দিকে এগোবে। এখনই শ্রমিক-মালিক আলোচনার মাধ্যমে চটকলগুলিতে পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন চালু করা দরকার।