গ্রেফতারের পরে ভারভারা রাও। মঙ্গলবার হায়দরাবাদে। ছবি: পিটিআই।
সব অভিযোগই প্রমাণসাপেক্ষ। ভারতের বিচার-দর্শন বলিবে, অভিযোগ প্রমাণ না হওয়া অবধি অভিযুক্ত নিরপরাধ হিসাবেই গণ্য, কিন্তু সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা, ভারাভারা রাও, অরুণ ফেরেরা বা ভার্নন গঞ্জালভেস শেষ অবধি নিরপরাধ প্রমাণিত হইবেন, এমন কথা ধরিয়া লওয়ারও কোনও প্রয়োজন নাই। তাঁহারা মাওবাদী কি না, ভীমা-কোরেগাঁওয়ের ঘটনায় তাঁহাদের যোগ ছিল কি না, অথবা তাঁহারা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন কি না— সমস্ত প্রশ্নই, বিধিবদ্ধ ভাবে, তদন্তসাপেক্ষ। এক্ষণে শুধু একটিমাত্র প্রশ্ন বিবেচ্য। যে দ্রুততায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দল পাঠাইয়া পাঁচ বুদ্ধিজীবী-মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেফতার করিল পুণে পুলিশ, যে ভঙ্গিতে আরও বহু বাড়িতে খানাতল্লাশি হইল, তাহা কি শুধুই ‘তদন্তের স্বার্থে’? না কি গূঢ়তর উদ্দেশ্যে? শুধু এই কয়েক জনের মনেই নহে, দেশের যে কোনও প্রান্তে বসিয়া যাঁহারা কেন্দ্রীয় সরকারের; বা আরও স্পষ্ট ভাষায় বলিলে, নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা করিতেছেন, তাঁহাদের প্রত্যেকের মনে ভয় ঢুকাইয়া দেওয়ার জন্যই কি এই অভিযান? বুঝাইয়া দেওয়া যে, ঘোষণা হউক বা না হউক, জরুরি অবস্থা জারি হইয়াছে, সরকারের বিরোধিতা করিলে তাহার জন্য বিপুল মূল্য চুকাইতে হইবে? সন্দেহটি দৃঢ়তর হইতেছে গ্রেফতারির ধরনে। গৌতম নওলাখাকে কেন গ্রেফতার করা হইল, তাহার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পুলিশের নিকট ছিল না। সন্দেহ হইতেই পারে যে যাঁহারা এই গ্রেফতারির হুকুম দিয়াছিলেন, তাঁহারা পুলিশকে অভিযোগ ইত্যাদি বুঝাইয়া বলিবার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। অথবা ভাবেনই নাই যে তাহার প্রয়োজন আছে।
শাসক দলের সমালোচনা করিলে প্রত্যাঘাতের চরিত্র কী, গত চার বৎসরে ভারত তাহা বুঝিয়াছে। বুঝিয়াছে হাড়ে হাড়ে, এবং বিভিন্ন উপলক্ষে। প্রশ্নবাচী ছাত্রই হউন, বা সত্যান্বেষী সাংবাদিক, রাষ্ট্রযন্ত্র সমালোচনা সহ্য করে নাই। কেহ দেশদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার হইয়াছেন তো কাহারও বাড়িতে ভোররাত্রে হানা দিয়াছে আয়কর দফতর বা সিবিআই। মঙ্গলবার গ্রেফতার হওয়া পাঁচ জনের কর্মক্ষেত্র পৃথক, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর আমলের গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে তাঁহারা সমান সরব। তাঁহাদের গ্রেফতারির ঘটনাটি এই জমানার দমননীতির ছকে খাপে খাপে বসিয়া যায়। কেহ বলিতেই পারেন, সরকারের সমালোচকদের জন্য এই জমানায় দুইটি পথ খোলা— হয় ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ আততায়ীর বুলেটে প্রাণ হারাইবেন, অথবা দেশদ্রোহ বা অন্য গুরুতর অভিযোগে পুলিশ ধরিয়া লইয়া যাইবে। কাহার ভবিতব্য কোনটি, অলক্ষ্যে বসিয়া হয়তো কেহ বা কাহারা স্থির করিতেছেন।
যে তৎপরতায় পুলিশ আসিয়া ভারাভারা রাওদের গ্রেফতার করিল, বহু ক্ষেত্রেই তাহার কণামাত্রেরও সন্ধান পাওয়া যায় না। এম এম কালবুর্গি বা গৌরী লঙ্কেশদের হত্যাকাণ্ডের পর ভূরিপরিমাণ সময় কাটিয়া যায়, তদন্ত তিলপরিমাণ অগ্রসর হয় না। দেশ জুড়িয়া একের পর এক গোসন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়া যায়, পুলিশ নড়িয়া বসে না। দলিতদের উপর অত্যাচার হয়, হাসপাতালে শিশুরা মরিতে থাকে, ভুয়া খবর ছড়াইয়া খুচরা দাঙ্গা লাগাইয়া দেওয়া যায়, কিন্তু প্রশাসন রা কাড়ে না। সেই পুলিশ, সেই প্রশাসনই যখন একই সঙ্গে বহু শহরে অভিযান চালাইয়া সুপরিচিত মানবাধিকার কর্মী-বুদ্ধিজীবীদের তুলিয়া লইয়া যায়, তখন তাহাকে নিছক রুটিন কর্তব্যপালন ভাবিবার বিন্দুমাত্র কারণ আছে কি? ফ্যাসিবাদের চরিত্রলক্ষণগুলি ভারতের গায়ে এমন স্পষ্ট ভাবে ফুটিয়া উঠিতেছে যে ভুল করিবার উপায়মাত্র নাই। প্রতিবাদী স্বরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট ও কঠোর সাবধানবাণী আশা দেয়, কিন্তু এই বাণী যে সর্বোচ্চ আদালতকে উচ্চারণ করিতে হইতেছে, তাহা ভয়েরই কথা।