বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে নির্ভুল ধারণায় উপনীত হইতে মানুষের সময় লাগিয়াছে। পুরাতন যে ধারণাটি প্রচলিত ছিল, তাহার নাম স্টেডি স্টেট থিয়োরি বা স্থিতাবস্থা তত্ত্ব। উক্ত তত্ত্বে ব্রহ্মাণ্ডের কোনও জন্ম নাই, লয় নাই, ক্ষয় নাই। তাহা অজর অমর। কোনও কিছু আপনি বিরাজমান, তাহার জন্ম কোনও মুহূর্তে হয় নাই— এবংবিধ চিন্তা মনুষ্যগণের সাধ্যের অতীত, তাহারা সব কিছুকেই জন্মিতে এবং মরিতে দেখে। তাই এই প্রকাণ্ড বিশ্বও যে কোনও মুহূর্তে জন্মলাভ করে নাই, অনন্তকাল ধরিয়া বিরাজমান, তাহা মানিয়া লইতে বিশেষজ্ঞগণের কষ্ট হইত। তথাপি বহু কাল ওই তত্ত্ব প্রচলিত মতবাদ বলিয়া গণ্য হইত। এমনকি আইনস্টাইন পর্যন্ত উক্ত মতবাদে আস্থাশীল ছিলেন। ওই তত্ত্বে অবিচল আস্থার ফলে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভুলও তিনি করিয়াছিলেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি আবিষ্কারের সময় িতনি দেখিলেন যে, ব্রহ্মাণ্ড অস্থির— হয় সঙ্কুচিত অথবা প্রসারিত হইতেছে— তখন তিনি আপন তত্ত্বের ওই রূপ তাৎপর্য অস্বীকার করিবার নিমিত্ত আবিষ্কৃত তত্ত্বকে শোধরাইবার জন্য উহার মধ্যে আর একটি জিনিস আমদানি করেন। ব্রহ্মাণ্ড যে স্থির নহে, তাহা আবিষ্কৃত হইলে আইনস্টাইন উক্ত আমদানিকে তাঁহার জীবনের ‘গ্রেটেস্ট ব্লান্ডার’ বলিয়া অভিহিত করেন। স্টেডি স্টেট থিয়োরিতে অগাধ আস্থা স্থাপন না করিলে যে আইনস্টাইন ওই ভুল করিতেন না, তাহা বলা বাহুল্য।
১৯৬০-এর দশকে স্টেডি স্টেট থিয়োরি পরিত্যক্ত হয়। পরিবর্তে গৃহীত হয় বিগ ব্যাং থিয়োরি। উক্ত থিয়োরির নামটি কিন্তু স্টেডি স্টেট থিয়োরি-র অন্যতম প্রবক্তা প্রয়াত ব্রিটিশ পদার্থবিদ স্যর ফ্রেড হয়েল কর্তৃক প্রদত্ত। বিগ ব্যাং থিয়োরি অনুযায়ী, ব্রহ্মাণ্ড অজর অমর নহে, তাহা অস্থির বা পরিবর্তনশীল। ১৩৭০ কোটি বৎসর পূর্বে কোনও এক মাহেন্দ্রক্ষণে এক মহাবিস্ফোরণে ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হইয়াছিল। হয়েল সাহেব বিবিসি-র রেডিয়ো-র এক বক্তৃতায় নূতন তত্ত্বটিকে ব্যঙ্গ করিবার নিমিত্ত উক্ত বিস্ফোরণকে বিগ ব্যাং বলিয়া অভিহিত করেন। নামকরণের কী মহিমা! নিন্দার্থে প্রযুক্ত নামেই নূতন তত্ত্বটি চালু হইয়া যায়। কী কারণে স্টেডি স্টেটের পরিবর্তে বিগ ব্যাং থিয়োরি প্রচলিত হইল? মুখ্য কারণ ইহাই যে, ব্রহ্মাণ্ড জন্মিবার কালে যে মহাবিস্ফোরণ ঘটিয়াছিল, তাহার রেশ ১৯৬০-এর দশকে বিজ্ঞানীগণ আবিষ্কার করেছিলেন। রেশ বলিতে বুঝায় তাপ। জন্মিবার পরে ব্রহ্মাণ্ড বেলুনের ন্যায় ক্রমাগত স্ফীত হইতেছে। ফলে জন্মমুহূর্তের অগ্নি আজ অনেকটা স্তিমিত। তবু, শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের অনেক নীচে হইলেও, কিঞ্চিৎ উষ্ণতা বিশ্বচরাচরে এখনও বিদ্যমান, যাহাকে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (সিএমবি) বলে। সিএমবি আবিষ্কার স্টেডি স্টেট থিয়োরি-র কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতিয়া দেয়। আমেরিকার বেল ল্যাবে দুই বিজ্ঞানী আরনো অ্যালান পেনজিয়াস এবং রবার্ট উড্রো উইলসন ১৯৭৮ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন সিএমবি শনাক্ত করিয়া।
সিএমবি আবিষ্কারের পর জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা যেন নবজন্ম লাভ করে। এই কথা সত্য বটে যে, মহাবিস্ফোরণের ওই রেশ অনেক কিছুর সন্ধান দেয়। সিএমবি বিশ্বচরাচরে সর্বত্র সমান নহে। ফলে আকাশের নানা দিকে সংবেদনশীল যন্ত্রে তাহা পরিমাপ করিলে তাহাতে কিঞ্চিৎ তারতম্য ধরা পড়ে। শুধু ব্রহ্মাণ্ডের গঠন নহে, সিএমবি-র ওই তারতম্য তাহার বিবর্তনেরও হদিশ দেয়। ব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তনের এক বড় ব্যাপার হইল জন্মিবার পর তাহার স্ফীত হইবার হার। আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাব্ল-এর নামানুসারে ওই স্ফীতির হারকে হাব্ল কনস্ট্যান্ট কহে। ব্রহ্মাণ্ডে গ্যালাক্সিগুলি একে অন্যের ক্রমশ দূরবর্তী হইতেছে, এবং ওই ক্রমবর্ধমান দূরত্বই ব্রহ্মাণ্ডকে ক্রমশ আকারে বৃহৎ করিতেছে। কী হারে ব্রহ্মাণ্ড বড় আকার ধারণ করিতেছে, তাহা জানা যায় সিএমবি-র তারতম্য শনাক্ত করিলে। ২০১৩ হইতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চিলির আটাকামা মরুভূমিতে অবস্থিত দূরবীক্ষণে জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ সিএমবি-র ওই তারতম্য অনুসন্ধান করিয়াছেন। তাঁহাদের তদন্তের ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত হইয়াছে। আর গোল বাধিয়াছে ওই ফলাফল লইয়া। দেখা যাইতেছে, সিএমবি তদন্ত অনুযায়ী ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ হার যাহা হওয়া উচিত, বাস্তবে তাহা প্রসারিত হইতেছে অনেক গুণ বেশি। অতএব, বৃহৎ সমস্যা। তথ্যের ভিত্তিতে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব সংশোধন কি জরুরি হইয়া দাঁড়াইল?