রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক নিয়ে স্পষ্টতার এই অভাব অবাঞ্ছিত

সব রাজ্যেরই বিরোধী দল বা রাজ্য সরকারের কোনও ব্যবস্থায় ক্ষুব্ধ কোনও কর্মরত বা বসবাসকারী কোনও গোষ্ঠী তাঁদের ক্ষোভ জানাতে অনেক সময়ই রাজ্যপালের কাছে যান এই ভুল ধারণা থেকে যে রাজ্যপাল রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৯ ০১:৩৯
Share:

সুবিবেচক: প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ

প্রতি দিন রাজ্যপালকে নিয়ে খবর হলে বুঝে নিতে হয় রাজ্যে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে। পশ্চিমবঙ্গে আপাতত কোনও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নেই যে, তার ফলে রাজ্যপালকে প্রতি দিনের খবর হতে হয়। রাজ্যপাল স্পষ্ট ভাষাতেই প্রতি দিন জানাচ্ছেন যে, রাজ্য সরকার তাঁর কোনও ইচ্ছা বা আদেশ বা অনুরোধকে মূল্য দিচ্ছে না বা ‘মর্যাদা’ দিচ্ছে না। এই লেখাটি যখন লিখছি ১৫ নভেম্বর, সকালে, খবর পড়ছি— রাজ্যপাল ফরাক্কায় যাওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের মুখ্যসচিবের কাছে হেলিকপ্টার চেয়েছিলেন, উত্তর না পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন। সেখান থেকেও কোনও উত্তর পাননি। জওহরলাল নেহরুর জন্মদিনে তাঁর মূর্তিতে মালা দেওয়ার অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল জানান যে, তিনি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে যেতে চান, সেখানকার অবস্থা জানতে ও বুঝতে। মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, ‘‘কেউ কেউ আছেন, যাঁরা বিজেপির মুখপাত্রের মতো আচরণ করছেন।’’ রাজ্যের রাজ্যপালের আচরণ নিয়ে যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেন, তা হলে একটা ঘনায়মান বিপদ সম্পর্কে বাধ্যত সচেতন হতেই হয়। এমন বিপন্নতার কারণ রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক নিয়ে স্পষ্টতার অভাব।

Advertisement

সব রাজ্যেরই বিরোধী দল বা রাজ্য সরকারের কোনও ব্যবস্থায় ক্ষুব্ধ কোনও কর্মরত বা বসবাসকারী কোনও গোষ্ঠী তাঁদের ক্ষোভ জানাতে অনেক সময়ই রাজ্যপালের কাছে যান এই ভুল ধারণা থেকে যে রাজ্যপাল রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। কিন্তু সাংবিধানিক প্রধান বলে কোনও পদ হয় কি? রাষ্ট্রপতিও কি সাংবিধানিক প্রধান? ‘রাষ্ট্রপতি’ রাষ্ট্রের প্রতীক এক পদ। রাষ্ট্রকে যখন আকার দিতে হয় তখন রাষ্ট্রপতি বলে এক ব্যক্তির প্রয়োজন হয়। তিনি আমাদের সৈন্যবাহিনীরও প্রধান। সে প্রাধান্যও প্রতীকী। রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনীকে কি কোনও আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারেন? বা কোনও সামরিক অভিযান থেকে বিরত করতে পারেন? নির্বাচিত মন্ত্রিসভার গৃহীত সিদ্ধান্তের বাইরে তাঁর এক আঙুলও পা ফেলার জায়গা নেই। জওহরলাল নেহরু যখন প্রধানমন্ত্রী ও রাজেন্দ্রপ্রসাদ রাষ্ট্রপতি তখন হিন্দু কোড বিল নিয়ে তাঁদের ভিন্ন মত খুব গোপন ছিল না। নেহরু তাঁকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, পার্লামেন্টের ও মন্ত্রিসভার গৃহীত সিদ্ধান্তের বাইরে তাঁর মতের ভিন্নতা রাষ্ট্রপতি, এমনকি প্রকাশ করতেও পারেন না।

রাজেন্দ্রপ্রসাদ কম বড় নেতা ছিলেন না ও তাঁর পাণ্ডিত্যও ছিল সর্বস্বীকৃত। তাঁর ‘ইন্ডিয়া ডিভাইডেড’ বইটি আজকাল খুব উল্লিখিত হয় না। এই গ্রন্থটি এমন এক জন বিদ্বানের লেখা, যাঁর দুই পা ডোবানো ছিল মাটিতে। রাজেন্দ্রপ্রসাদ সংসদীয় গণতন্ত্রের অর্থ জানতেন না, তা নয়। তিনি হয়তো চাইছিলেন— এখনই হিন্দু কোড বিলের মতো আইনের দরকার কী! নেহরু ভাবছিলেন, হিন্দুত্ব যেন বেলাগাম হয়ে না ওঠে। রাজেন্দ্রপ্রসাদ কোনও মতপার্থক্য জানাননি।

Advertisement

নেহরুর সঙ্গে রাধাকৃষ্ণনের এক বার মতপার্থক্যের চাইতেও গভীরতর মতভেদ ঘটেছিল। রটনা আছে, রাধাকৃষ্ণন কমান্ডার-ইন-চিফ’এর অধিকার প্রয়োগ করতে ইচ্ছুক বা সচেষ্ট ছিলেন। সৈন্যাধ্যক্ষদের অবিচল আনুগত্য ছিল নেহরুর প্রতি। রাষ্ট্রীয় এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনই উপস্থিত। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে রাষ্ট্রপতির যিনি এডিকং, তিনি এসে প্রধানমন্ত্রীকে জানান, ‘রাষ্ট্রপতি এখন চলে যাচ্ছেন।’ এটা একটা কেতা যে, রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী বিদায় জানাবেন। নেহরু সেই সেনাপতিকে বললেন, ‘ইউ আর হিজ় অফিসার অন ডিউটি, নট মি।’ বলেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতিকে বিদায় দিতে চললেন।

রাজীব গাঁধীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি সর্দার জৈল সিংহের বিবাদ বেশ পাকিয়ে উঠেছিল। দিল্লিতে তখন যাঁরা সব খবর রাখেন, তাঁরা জানতেন রাষ্ট্রপতি ভবনে পঞ্জাবের কিছু কিছু ভিন্দ্রানওয়ালে-পন্থী কখনওসখনও রাত্রিবাসও করে। রাজীব অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্বশীল অফিসারদের দিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ-প্রস্থানের ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন। পার্লামেন্টে পাশ করা এক আইন সর্দার জৈল সিংহ এক বার ফেরত পাঠান। এই পর্যন্ত তাঁর অধিকার ছিল। সেটা আবার তাঁর কাছে ফিরে আসে অসংশোধিত। সর্দার জৈল সিংহ সই করতে বাধ্য ছিলেন।

এই যখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংসদের বা মন্ত্রিসভার বা প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক, সংবিধান-অনুযায়ী, তখন এক জন রাজ্যপাল সেই রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কোন সম্পর্কে বাঁধা? রাষ্ট্রপতিও কিন্তু নির্বাচিত পদাধিকারী, রাজ্যপাল তো তা নন।

রাজ্যপাল তা হলে কী ও কে? প্রথমত তিনি কোনও অবস্থাতেই ‘সাংবিধানিক প্রধান’ নন। সংবিধানের ১৫৫ ধারা অনুযায়ী ‘একটি রাজ্যের রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাঁর স্বাক্ষর ও মুদ্রাঙ্কিত অভিপত্র দ্বারা নিযুক্ত হবেন।’ (ড. অনিল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ, সুপ্রিম কোর্ট স্বীকৃত)। এর সাদামাটা বাংলা, তিনি অ্যাপয়েন্ট লেটার

দিয়ে নিযুক্ত এক জন সরকারি কর্মী। সমস্ত সরকারি ও গেজেটেড অফিসারও তা-ই। রাজ্যপালকে একটা সংবিধানে বেঁধে দেওয়া গতে শপথ

পড়ান সেই রাজ্যের হাইকোর্টের প্রধান বিচারক বা তাঁর অনুপস্থিতে সেই হাইকোর্টের প্রবীণতম বিচারক। এমন এক জনকে কি রাজ্যের ‘অভিভাবক’ বলা চলে?

সংবিধানে এও লেখা আছে যে, রাজ্যপালের ওপর ‘রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতা ন্যস্ত হবে এবং এই সংবিধান অনুসরণে হয় তিনি সরাসরি ভাবে অথবা তাঁর অধীন আধিকারিকবৃন্দের মাধ্যমে তিনি সেটি ব্যবহার করবেন’ (১৫৪ সংখ্যক ধারা)। এর মানে কী? মানে কি তিনি প্রশাসনিক প্রধান?

মানে হল— তাঁর নামে প্রশাসন চলবে। ‘হয় তিনি সরাসরি ভাবে’ এই শর্তের অর্থ যখন নির্বাচিত সরকারের বদলে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর প্রশাসনের দায়িত্ব আসবে, অর্থাৎ তারও নাম প্রেসিডেন্ট’স রুল, যেমন এখন মহারাষ্ট্রে চলছে বা জম্মু-কাশ্মীরে চলছে। রাজ্য মন্ত্রিসভার বাইরে রাজ্যপালের নিজস্ব ক্ষমতা ‘কোন-কোন স্থলে ক্ষমাসমূহ ইত্যাদি করার এবং দণ্ডাদেশ নিলম্বিত রাখার ও পরিহার করার বা লঘু করার’ ক্ষমতা (১৬১ সংখ্যক ধারা। এটাও তো কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কথামতো করতে হয়।)

আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে (‘অভিমানের আতিশয্য, ৮-১১) বলা হয়েছে, ‘‘ঘটনা হইল, তাঁহার পদটি আলঙ্কারিক। এই রাজ্যে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সাংবিধানিক প্রতিনিধি। ...কিন্তু সেই সেতু নিত্যব্যবহার্য নহে, অলঙ্কার।’’ এই ব্যাখ্যাও যথাযথ নয়। বস্তুত ব্রিটিশ আমলে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন জারির পরও সেগুলি ছিল প্রাদেশিক গভর্নরদের অধীন। সেই ধারাগুলি অবিকল আমাদের সংবিধানে এসে গিয়েছে। তখন একটা রীতি ছিল প্রদেশের গভর্নররা পনেরো দিনে এক বার ভাইসরয়কে একেবারে ব্যক্তিগত চিঠি লিখতেন, প্রদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। সেই চিঠিগুলি প্রথম নামে সম্বোধন করে লেখা হত ও সরকারি নথির অন্তর্ভুক্ত হত না। তাতে অনেক গোপন খবর থাকত। আমি ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ বইটি লেখার সময় লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিসের লাইব্রেরিতে বাংলার গভর্নরদের ভাইসরয়কে লেখা এই চিঠিগুলির খবর পাই ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে ব্যবহার করি। আমার ধারণা, এই প্রথা এখনও চালু আছে। এই চিঠিগুলি রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালকে ‘বিজেপির মুখপাত্র’ বলেছেন, তা সর্বাংশে সত্য। সব রাজ্যপালই কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের লোক। কেন্দ্রের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপরাজনীতির অভিজ্ঞতাই বেশি,

সাংবিধানিক অভিজ্ঞতার চাইতে। মহারাষ্ট্রের ব্যাপারে উনি মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিলেন, ‘আমরা তো ওদের এত দিন সময় দিলাম— ওরা সরকার করতে পারল না।’ তাড়াতাড়ি সংশোধন করে বলেন, ‘মানে, রাজ্যপাল’।

রাজ্যপাল রাজ্য সরকারের অনুমোদনহীন কোনও কর্মসূচি তৈরি করতে পারেন না। আর, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনমতো কর্মসূচি তাঁকে বাধ্যত পালন করতে হয়। যেমন ধর্মবীর, রাজভবন থেকে একটা চিঠি পাঠিয়ে ’৬৭-র নির্বাচিত অজয় মুখোপাধ্যায়ের সরকারকে খারিজ করে আশু ঘোষের সরকার বানিয়েছিলেন। জগদীপ ধনখড়ের বয়স জানি না। ৫২ বছর আগের এই ঘটনা তিনি না-ও জানতে পারেন। আমরা জানি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement