কোন খবর সত্যি, আর কোনটা মিথ্যে, নিজেদেরই বুঝতে হবে
Deepfake

এসে গেল ডিপফেকের দিন

সাতসকালে মেসেজটি পেয়ে একটু চমকেই উঠেছিলাম। ‘দিল্লি নির্বাচনে বিজেপি প্রথম ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করল।’ ভারতে রাজনৈতিক প্রচারে এই প্রযুক্তির ব্যবহার এর আগে কখনও হয়নি।

Advertisement

সম্বিত পাল

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২০ ০০:৩৬
Share:

ছবি: সংগৃহীত

সাতসকালে মেসেজটি পেয়ে একটু চমকেই উঠেছিলাম। ‘দিল্লি নির্বাচনে বিজেপি প্রথম ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করল।’ ভারতে রাজনৈতিক প্রচারে এই প্রযুক্তির ব্যবহার এর আগে কখনও হয়নি। দিল্লি বিজেপি তাদের রাজ্য সভাপতি মনোজ তিওয়ারির একটি ভিডিয়ো তৈরি করেছিল। তাতে দেখা যাচ্ছে, মনোজ হরিয়ানভি ও ইংরেজিতে দিল্লির ভোটারদের কাছে ভোট চাইছেন। মনোজ নিজে হরিয়ানভিতে কথা বলেন না। ওই ভিডিয়োটিতে তাঁর ঠোঁট নড়া, গলার শব্দ ও মুখের অভিব্যক্তি প্রযুক্তির সাহায্যে বসানো হয়েছে। ভিডিয়োটিতে তাঁর মুখ আসল হলেও কণ্ঠ ও ঠোঁট নড়া ‘ফেক’ বা নকল। পরিভাষায় ডিপফেক। কিন্তু দেখে মনে হবে না যে এটি নকল।

Advertisement

‘ডিপ লার্নিং’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে ‘ফেক’ ভিডিয়ো তৈরি করা হচ্ছে সেটাই ‘ডিপফেক’। এই প্রযুক্তি ব্যক্তির মুখের অভিব্যক্তি খুব খুঁটিয়ে পড়ে ফেলতে পারে। গলার আওয়াজ বুঝে নিতে পারে। তার পর সেই বিশ্লেষণের ফসল অন্যের মুখের উপর বসিয়ে দিতে পারে। বছরখানেক আগে ফেসবুকে ‘ফেসঅ্যাপ’ বলে একটি অ্যাপ খুব জনপ্রিয় হয়। আপনাকে বার্ধক্যে কেমন লাগবে, তা কয়েক মুহূর্তে দেখিয়ে দিচ্ছিল অ্যাপটি। বলিরেখা, পাতলা কাঁচা-পাকা চুল বা গোঁফ নিয়ে ফুটে উঠছিল আপনার বুড়ো বয়সের কাল্পনিক ছবি। ছবিটি আপনারই। কিন্তু নকল। এই ডিপ লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আপনার ছবি থেকে মুখের সমস্ত রেখা, অভিব্যক্তি নিমেষে পড়ে নিচ্ছিল ‘ফেসঅ্যাপ’, বানিয়ে দিচ্ছিল নকল ছবি। হলিউডে শার্লক হোমস-খ্যাত পিটার কুসিং বা অলিভার রিডের মতো অভিনেতা মারা যাওয়ার পর এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁদের অসম্পূর্ণ সিনেমা শেষ করা হয়েছে। নীল ছবিতে বা পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে এই প্রযুক্তির আকছার ব্যবহার হচ্ছে। সেলেব্রিটিদের মুখ ও কণ্ঠস্বর হুবহু বসে যাচ্ছে অন্য কারও শরীরে। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এক ডিপফেক ভিডিয়ো সাড়া ফেলেছিল। ফেসবুকের প্রধান মার্ক জ়াকারবার্গও শিকার হয়েছেন ডিপফেকের। শিকার হয়েছিলেন ভারতীয় সাংবাদিক রানা আইয়ুবও। গত বছর জুন মাসে একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়, যাতে দেখা যাচ্ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ নরেন্দ্র মোদী, শিবসেনা ও বজরং দলের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। হাতে তরোয়াল। ভিডিয়োটি আগরার বলে দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু ভিডিয়োটি আসলে ছিল বিহারের গোপালগঞ্জের, ২০১৪ সালে তোলা, আর তার পিছনের শব্দ ২০১৭ সালে রাজস্থানের উদয়পুরের একটি প্রতিবাদ মিছিলের। দু’টিকে জুড়ে ভিডিয়োটি ভাইরাল করা হয়েছিল। ভারতে রাজনৈতিক দলের প্রচারে সরাসরি ডিপফেকের ব্যবহার এই প্রথম।

মনোজ তিওয়ারির ভিডিয়োটির খবর সংবাদমাধ্যমে আসতেই দিল্লি বিজেপির আইটি সেলের মুখপাত্র নীলকান্ত বক্সি দাবি করেছেন, এটি আমজনতার জন্য ব্যবহার করা হয়নি— মণ্ডল স্তর পর্যন্ত দলের ৫৮০০টি অভ্যন্তরীণ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এটি পরীক্ষা করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। তাও প্রচারের শেষ দিনে। খুব পরিকল্পনা করে নাকি এটি বানানো হয়নি। যদিও, তাঁর কথার সম্পূর্ণ উল্টো খবরও সংবাদমাধ্যমে এসেছে।

Advertisement

৫৮০০ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সদস্যসংখ্যা কম নয়। কত জন এটিকে মনোজ তিওয়ারির সত্যিকারের গলা ও কথা বলে ভেবেছেন, তার হিসেব নেই। এক বিশেষ গোষ্ঠীর দিকে নজর রেখে ভিডিয়োটি বানানো হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে কত জন ‘মনোজ তিওয়ারি আমাদের ভাষা জানেন’ ভেবে আহ্লাদিত হলেন ও ‘কমল’-এ বোতাম টিপেছিলেন, তার হিসেবও নেই। এই মুহূর্তে অবশ্য তার চেয়েও বড় প্রশ্ন: তবে কি ভারতীয় রাজনীতিতে এ বার ‘ডিপফেক’-এর বহুল ব্যবহার শুরু হয়ে যাবে?

ভুয়ো খবরের ধাক্কায় দাঙ্গা হচ্ছে, বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে মানুষে মানুষে। মেরুকরণ তীব্র হচ্ছে। এর মধ্যে ব্যাপক হারে নকল ভিডিয়ো আসলের মতো করে তৈরি হতে থাকলে কেলেঙ্কারি! এমনিতেই আসল আর নকল খবর বা ছবির ফারাক সাধারণ মানুষ করতে পারেন না। ডিপফেক ভিডিয়ো বোঝা আরও কঠিন। এমন যদি ভেবে থাকেন এই প্রযুক্তি শুধু বড় রাজনৈতিক দলগুলি ব্যবহার করতে পারে বা বড় প্রযুক্তি কোম্পানি এই ভিডিয়ো বানাতে পারে, তবে ভুল ভাবছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে যিনি একটু প্রযুক্তির চর্চা করেন, তিনি বিভিন্ন অ্যাপের সাহায্যে ডিপফেক ভিডিয়ো বানিয়ে ফেলতে পারেন।

ফেসবুক খুললে আপনার ওয়ালে কী দেখবেন, সেটা বহুলাংশে নির্ভর করে ‘অ্যালগোরিদম’-এর ওপর। সাধারণত, আপনি যে রকম কথা লেখেন, যে ছবি বা খবর শেয়ার করেন, ফেসবুকও আপনাকে তেমন লেখা, খবর বা ছবিই দেখাতে থাকে। ফলে, উল্টো দিকে কোন ধরনের আলোচনা হচ্ছে, তার হদিস আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সচরাচর পাই না। ওই ছোট বৃত্তেই ঘুরপাক খেতে থাকি ও সেটাকেই বৃহত্তর সমাজ ভেবে ভুল করি। আর হোয়াটসঅ্যাপের মতো ‘বদ্ধ সামাজিক মাধ্যম’ হলে তো আর কথাই নেই। এ থেকেই মেরুকরণ তীব্র হয়। মানুষ ‘কুয়োর ব্যাঙ’ হয়ে যায়। ফেক নিউজ় রমরমিয়ে চলে। এমআইটির ডেভিড র‌্যান্ড ও কানাডার ইউনিভার্সিটি অব রেগিনা-র গর্ডন পেনিকুকের মতো গবেষকেরা বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক ব্যবহারে মগজ অলস হয়ে যাচ্ছে। মানুষ আর চিন্তাভাবনা, যুক্তি তর্ক দিয়ে কোনও খবরের বা বার্তার বিচার করতে চাইছে না। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে আমজনতার বিশ্লেষণী মগজাস্ত্রে শান দেওয়া খুব জরুরি। নয়তো শুধু অক্ষর, ছবি ও কিছু অপ্রাসঙ্গিক ভিডিয়োর মাধ্যমে যে ভাবে ভুয়ো খবর আমাদের দুনিয়াকে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে, ডিপফেকের ব্যবহার তাকে চরম নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাবে।

এই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য আইন হতেই পারে। সংবাদমাধ্যম আরও দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করতেই পারে। কিন্তু আমজনতার জন্য একটা বড় মাপের ডিজিটাল মিডিয়া সাক্ষরতা অভিযান খুব দরকারি। শুধুমাত্র কম্পিউটার বা স্মার্টফোন ব্যবহার, ডিজিটাল মাধ্যমে টাকা পয়সা লেনদেন করতে জানা মানেই ‘ডিজিটাল সাক্ষরতা’ নয়। ডিজিটাল মাধ্যমে তথ্য কী ভাবে পেতে হয়, তা কী ভাবে বিশ্লেষণ করে বুঝতে হয়, সেটার সব দিক পর্যালোচনা করে কী ভাবে ডিজিটাল মাধ্যমে একটি বার্তা তৈরি করতে হয়— এই পুরো প্রক্রিয়া সম্বন্ধে কেউ যদি প্রশিক্ষিত হন, তবেই তাঁকে ‘ডিজিটাল সাক্ষর’ বলা চলে। অর্থাৎ হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এলে তা খুলে দেখা, বার্তাটি কী ভাবে তৈরি হয়েছে তা বোঝা, তার পর্যালোচনা করা, সেটি ঠিক না ভুল, না আধা ঠিক, তা নিয়ে ভাবা, সেই অনুযায়ী একটি নতুন মেসেজ তৈরির প্রশিক্ষণ। ডিজিটাল বার্তা কী ভাবে তৈরি হয়, সেটা জানাও ডিজিটাল সাক্ষরতার উদ্দেশ্য।

নর্থ-ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ল-এর অধ্যাপক জেসিকা সিলভি ও উড্রো হার্টজগ লিখছেন, এখন মানুষের বিশ্লেষণী মনকে জাগিয়ে তুলতে হবে। যাঁরা সংবাদ পড়ছেন বা দেখছেন, তাঁদের আরও কৌতূহলী করে তুলতে হবে। ডিজিটাল সংবাদের গ্রাহকেরা যেন নিজেদের মধ্যে আরও গভীর সমন্বয় গড়ে তুলে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালান। আরও ভাবনাচিন্তা করেন। কোনও খবরের বা তথ্যের ব্যাপারে আর একটু সন্দিহান হন। সত্যতা যাচাই করার ব্যাপারে সবাই মিলে উদ্যোগী হন। আর এই ব্যাপারে শিক্ষার মাধ্যমেই ডিজিটাল যুগের বিপদকে মোকাবিলা করা সম্ভব।

মিডিয়া সাক্ষরতার ব্যাপারে বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু উদ্যোগ ভারতে করা হয়েছে কখনও কখনও। কোনও প্রকল্পই বেশি দূর এগোয়নি। ভারতে ভাষার ও শিক্ষার স্তরের বিভিন্নতা সেই সব উদ্যোগে বাধার সৃষ্টি করেছে। মিডিয়া সাক্ষরতার অঙ্গ হিসেবেই ডিজিটাল সাক্ষরতাকে দেখা দরকার, তা হওয়া উচিত বিভিন্ন স্তরে। সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ খুবই জরুরি। কোন খবর বেছে নিতে হবে বা কী ভাবে পরখ করে নিতে হবে, তা শেখা কর্তব্য। অনেক সংবাদমাধ্যম নিজেদের ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ টিম বানিয়েছে। কেউ কেউ স্বাধীন ভাবে ভুয়ো খবরের সত্যতা যাচাই করছেন, তার জন্য আলাদা ওয়েবসাইট বানিয়েছেন। কিন্তু এঁরা দিনে ১০০টি ভুয়ো খবরের সত্যতা যাচাই করতে করতে এক লক্ষ ভুয়ো খবর আমজনতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ভুয়ো খবরের সংখ্যা ও গতিবেগ এবং রাজনৈতিক ও অন্যান্য দুরভিসন্ধির সঙ্গে সংবাদমাধ্যম পাল্লা দিতে পারবে না।

তাই সংবাদ যাঁরা পড়ছেন বা সোশ্যাল মিডিয়া যাঁরা ব্যবহার করছেন, সেখানকার খবর শেয়ার করছেন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে, তাঁদের কাছে ডিজিটাল সাক্ষরতাকে নিয়ে যাওয়া আশু কর্তব্য। আশির দশকে যে ভাবে পাড়ায় পাড়ায় সাক্ষরতা অভিযান চলেছিল, সে ভাবেই স্কুলে, কলেজে, ক্লাবে ডিজিটাল সাক্ষরতা অভিযান শুরু হোক। আমজনতা বুঝুক আসল ও নকল তথ্য, ভিডিয়ো, ছবির ফারাক। ভাবতে শুরু করুক তারা।

ভারতীয় জনসঞ্চার সংস্থান, ঢেঙ্কানল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement