ওজনের যন্ত্রে পয়সা ফেলিয়া দিলে একটি টিকিট বাহির হইয়া আসিত, তাহার এক পৃষ্ঠে ওজন এবং অপর পৃষ্ঠে ভবিষ্যদ্বাণী লিখা। দুইটিই ভুল হইবার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু টিকিটটি হাতে পাইতে মজা লাগিত। ইদানীং এমন একটি যন্ত্র লইয়া হইহই ঘটিতেছে, যাহাতে পয়সা না ফেলিলেও, চাহিলেই পাওয়া যাইবে একটি টাটকা ছোটগল্প। গল্পগুলি তিনটি ভাগে বিভক্ত: এক মিনিট, তিন মিনিট ও পাঁচ মিনিট। পড়িবার সম্ভাব্য সময় ধরিয়া সংখ্যাগুলি নির্ণীত। কাহারও যদি বাস স্টপে দাঁড়াইয়া থাকিতে থাকিতে মনে হয়, এক মিনিটের একটি গল্প পড়িলে মন্দ হয় না, এই যন্ত্রের বোতাম টিপিয়া, একটি গল্প বাহির করিয়া লইবেন। যন্ত্রের উদ্ভাবক ও প্রতিষ্ঠাতা ‘শর্ট এডিশন’ প্রকাশনা সংস্থা, ফ্রান্সে তাহারা ২০১৫ সালের অক্টোবর হইতে এই যন্ত্র বসাইতেছে। প্রকল্পটির বৈশিষ্ট্য হইল, এইখানে খ্যাত সাহিত্যিকের লেখা পড়া যাইবে না। এই সংস্থা অনলাইন গল্প চাহিয়া থাকে, অখ্যাতদের, নূতনদের। সেই গল্পগুলি তাহাদের ‘অ্যাপ’ হইতে পড়িয়া জনতা যেগুলিকে ভোট দিয়া সর্বাধিক ভাল বলেন, সেইগুলিকে কাহিনি-বিতরণী যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, গল্প পড়িব, এবং এক সম্পূর্ণ অচেনা লেখকের অজানা গল্প পড়িব, ইহাই উত্তেজনার উপাদান। ১৫০-এর উপর এমন যন্ত্র বিশ্ব জুড়িয়া বসানো হইয়াছে। আমেরিকায় এমন যন্ত্র প্রথম বসানো হয় সান ফ্রান্সিসকো-য়, বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা-র নিজস্ব কাফেতে। গত বৎসর আমেরিকায় ত্রিশটির উপর যন্ত্র বসিয়াছে, গত মাসেই চারটি শহরের সরকারি গ্রন্থাগারে এইগুলি বসানোর কথা পাকা হইয়াছে। ফিলাডেলফিয়ার সরকারি গ্রন্থাগারের এক কর্তা উল্লসিত হইয়া বলিয়াছেন, ‘‘যাহা কিছু পুরাতন ছিল, সকলই এই বার নূতন হইয়া যাইতেছে!’’
হোয়াটসঅ্যাপে কিছু কার্টুন ঘুরিতেছে, কোনওটিতে বহু মানুষ একটি বইকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছে, চোখেমুখে আতঙ্ক, বিস্ময়, এক জন একটি লাঠি লইয়া সন্তর্পণে বইটি স্পর্শ করিতেছে। আর একটিতে, মাতা তাঁহার স্তম্ভিত শিশুসন্তানকে বই দেখাইয়া বলিতেছেন, ইহা খুলিতে কোনও পাসওয়ার্ড লাগিবে না। আর একটিতে এক শিশু তাহার মাতাকে বলিতেছে, কোনও মাউস বা কি-বোর্ড নাই? তবে পৃষ্ঠাগুলি উল্টাইব কেমন করিয়া? বক্তব্য পরিষ্কার, মানবসভ্যতা হইতে বই লুপ্ত হইতেছে। এই সিদ্ধান্ত বাহিয়াই, নূতন অভ্যাসে দীক্ষিত মানুষদের, সাহিত্যে উৎসাহী করিয়া তুলিতে গল্প-বিতরণী যন্ত্রের প্রচলন। বিনামূল্যে পাইতেছে বলিয়া মানুষ যদি সময় কাটাইবার জন্য গল্প পড়ে, পুরাতন নেশা নূতন আঙ্গিকে ফিরিয়া আসিতে পারে, ইহা হইল আশা। অর্থাৎ, গল্প মানুষের জীবনে পুনঃপ্রবেশ করিতে চাহিয়া গলবস্ত্র হইয়া বলিতেছে, আমাকে ভোগ করিয়া ফেলিতে অধিক সময় খরচ হইবে না, এক মিনিট বা তিন মিনিটের জন্য আমাকে গ্রহণ করিয়া কৃতার্থ করো। এই সপ্তাহেই কলিকাতায় আয়োজিত হইয়াছিল এক ‘ডিজিটাল স্টোরিটেলিং’ কর্মশালা, তাহাতেও অংশীদের বলা ছিল, তাঁহাদের সৃষ্ট ছবিগুলি যেন তিন মিনিট সময় অতিক্রম না করে।
সন্দেহ নাই, মানুষের নিকট প্রযুক্তি আনিয়া দিয়াছে এক অভূতপূর্ব সুযোগ— বিনোদনের সকল উপকরণ একই মুহূর্তে তাহার নিকট মজুত। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সে ভিডিয়ো-ক্রীড়া হইতে আড্ডাখানা, সিনেমা হইতে সঙ্গীত, রসিকতা হইতে সংবাদে লাফাইতেছে। এই জোগান-সম্ভাবনা তাহার চাহিদাকেও নবনির্মাণ করিয়াছে। সে সকল উপকরণই চাহিতেছে কম দৈর্ঘ্যের, যাহাতে উহা ভোগ করিয়াই দ্রুত চলিয়া যাইতে পারে নূতন আনন্দের সন্ধানে। তাই সকল শিল্পই স্বল্প দৈর্ঘ্যের বাধ্যতা লইয়া আসিতেছে। বাজারবশ্যতা, বা যুগের সহিত তাল মিলাইয়া চলা সকল কিছুরই টিকিয়া থাকিবার আবশ্যিক শর্ত। কিন্তু সেই শর্ত মানিতে যাইয়া সাহিত্যের মৌলিক শর্তই লঙ্ঘিত হইয়া যাইতেছে কি না, ভাবিয়া দেখা আবশ্যক। মানুষকে এক মিনিটের গল্প পড়িতে প্রণোদিত করিলে সে কি ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর প্রতি আদৌ উৎসাহী হইবে কোনও দিন? কাহিনি যাহাতে গড় পাঠকের পাঁচ মিনিটের পাঠ-সময় অতিক্রম না করে, নূতন গল্পলেখক কি তাহা ভাবিয়া নাতিদীর্ঘ পরিসরে তাঁহার বক্তব্য ও শৈলীকে জোর করিয়া ঠুসিয়া দিবেন? মহাভারত কি টুইটারের শর্ত মানিয়া ছাঁটিয়া লওয়া হইবে? বিতর্কের বিষয়। এবং সেই বিতর্ক তিন মিনিটে শেষ হইবে না, হলফ করিয়া বলা যায়।
যৎকিঞ্চিৎ
মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট ছিল, রামায়ণের যুগে আন্ডারগ্রাউন্ড শহর ছিল (সীতা এসকালেটরে চড়ে নেমে গিয়েছিলেন), গণেশের যুগে প্লাস্টিক সার্জারি ছিল, অর্জুনের ব্যক্তিগত মিসাইল ছিল, এ সব আমরা সকলেই জানি। শুধু রথের চাকা বসে গেলে তোলার যন্ত্র, আর রাজা অন্ধ হলে চোখ সারানোর কৌশল, এ ছাড়া সবই ছিল। কিন্তু এখন তার কোনও প্রমাণ ফসিল অবশেষ চিহ্ন পাওয়া যায় না কেন? উত্তর সহজ, পাকিস্তান গুম করে দিয়েছে। তা হলে কি সে যুগে পাকিস্তানও ছিল!