হোয়াটসঅ্যাপে এক জন লিখেছেন: ‘‘একই দিনে দুটি ঘটনা। মুর্শিদাবাদে বাস ডুবল। আর নোয়াপাড়া এবং উলুবেড়িয়ায় ডুবল গণতন্ত্র।’’ তাঁর খোঁচাটি খুব পরিষ্কার। বক্তব্যের নির্যাসও স্পষ্ট। ওই লেখক মনে করেন, মুর্শিদাবাদের খালে বাস পড়ে অত মানুষের জীবনহানি যতটা দুঃখজনক, সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষে ততটাই হতাশাব্যঞ্জক হল দুটি উপনির্বাচনে শাসকদলের কার্যত একতরফা দাপাদাপির ছবি।
সন্দেহ নেই, দুটি জায়গাতেই বিশাল জয় পেয়ে তৃণমূল তাদের সেই আধিপত্যের প্রমাণ রাখতে পেরেছে। বিজেপির কাঁটা বিঁধলেও আগামী ভোটের দিকে তাকিয়ে এটা তাদের পক্ষে আপাতত স্বস্তির কারণ। নোয়াপাড়া বিধানসভা এবং উলুবেড়িয়া লোকসভার দুই উপনির্বাচন এ-বার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল নানা কারণে। বিজেপির উত্থানের আন্দাজ নেওয়ার ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতৃত্ব দুটি জায়গাকেই সংবেদনশীল বলে মনে করেছিলেন। যেন তেন প্রকারেণ তার মোকাবিলা করা তাই ছিল দলের বড় চ্যালেঞ্জ। নোয়াপাড়া ২০১৬-র প্রবল মমতা-হাওয়াতেও তৃণমূলকে জেতায়নি। জিতেছিল কংগ্রেস। তবে রাজ্যে ক্ষয়ে যাওয়া কংগ্রেসের জায়গায় তৃণমূল-বিরোধী প্রধান শক্তি হয়ে বিজেপি যাতে এখানে উঠে না আসে, সেটা নিশ্চিত করা ছিল তৃণমূলের কাছে বেশি জরুরি। তার ওপর নোয়াপাড়ার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল সদ্য বিজেপি হওয়া মুকুল রায়ের ‘প্রভাব’-এর প্রশ্ন। ওই তল্লাট নাকি তাঁর ‘খাসতালুক’। সেখানে বিজেপি যাতে দাঁত ফোটাতে না পারে, মূল লক্ষ্য ছিল সেটাই।
কিন্তু সেটা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। বিপুল ব্যবধানে হেরে গেলেও নোয়াপাড়ায় বিজেপি দ্বিতীয়। অর্থাৎ প্রধান বিরোধী হিসেবেই স্বীকৃত। এটা তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন তাৎপর্যপূর্ণ উলুবেড়িয়ায় বিজেপির তিন লক্ষ ভোট পাওয়া। কিছু দিন আগে উলুবেড়িয়ার লাগোয়া ধুলাগড়ে এক অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর থেকেই বিজেপি ওই সব এলাকায় ভোট ভাগাভাগির নিজস্ব অঙ্ক কষতে শুরু করে। পালটা হিসাব করে এগোচ্ছিল তৃণমূলও। তখনও অবশ্য উপনির্বাচনের সম্ভাবনা ছিল না।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উপনির্বাচন এসে পড়ায় উলুবেড়িয়ায় নিজেদের ‘ক্ষমতা’ ধরে রেখে বিজেপি-কে যথাসম্ভব পিছিয়ে দিতে না পারলে আগামী দিনে অবস্থা যে কঠিন হতে পারে, তেমন আশঙ্কা তৃণমূলের অন্দরে আলোচিত হয়েছে। রণকৌশলও তৈরি করা হয়েছিল সে ভাবেই। সেটা কাজ করেছে। বিজেপি-কে লাখ পাঁচেক ভোটে হারিয়ে অনেকটাই ‘নিশ্চিন্ত’ তৃণমূল।
যদিও দু’জায়গাতেই বিরোধী দলগুলি সমস্বরে অভিযোগ তুলেছে, তাদের ভোট করতেই দেওয়া হয়নি। এজেন্ট পর্যন্ত বসানো যায়নি। আর তাঁদের অভিযোগে গুরুত্ব দেয়নি নির্বাচন কমিশনও। এই অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গে শাসকদলের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিটি ভোটেই এমনটা শোনা যায়। সিপিএম যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও বিরোধী কংগ্রেস, এবং পরবর্তী কালে তৃণমূল এটাই বলত। এখন তৃণমূল শাসকের চেয়ারে। আঙুল উঠছে তাদের দিকে।
সবই অমূলক, সে-কথা নিশ্চয় বলব না। বরং নিজস্ব অভিজ্ঞতায় আমরা অনেকেই জানি, ক্ষমতাসীনদের দাপটে ভোট কীভাবে লুট হয়। নির্বাচন পরিচালক থেকে শুরু করে আইনরক্ষকরা সবাই কীভাবে নিজ নিজ অবস্থানে কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং গণতন্ত্রের নামে প্রহসন দেখেও না দেখার ভান করেন। আর অনিবার্যভাবেই সেই সব জায়গায় ভোটের ফল যায় শাসকের পক্ষে। তারা বিপুল ব্যবধানে জেতে।
সিপিএম জমানায় যেমন কেশপুরে জিততেন নন্দরানি দল, তমলুক-হলদিয়ায় লক্ষ্মণ শেঠ, আরামবাগ লোকসভায় অনিল বসু প্রমুখ। তৃণমূলের রাজত্বে একা বিধাননগর পুরভোটই তো নির্বাচনী ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাহুবলের জয়গাথা হিসাবে। অন্য কিছু তো দূরস্থান!
এ-বার নোয়াপাড়া বা উলুবেড়িয়ায় দৃশ্যত তেমন গুরুতর কিছুই ঘটেনি। বোমা-গুলির অভিযোগ যেটুকু যা, তা-ও খুব বড়ভাবে সামনে আসেনি। তবে দুই কেন্দ্রেই কিছু বুথে বিরোধীদের এজেন্ট দেখা যায়নি। কেন? কারণ ব্যাখ্যা করে উলুবেড়িয়ায় উদয়নারায়ণপুরের একটি বুথের প্রিসাইডিং অফিসার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘এই বুথে তো সব প্রার্থীর জন্যই এজেন্টের ফর্ম পূরণ করা হয়েছিল। নিয়োগপত্রও প্রস্তুত ছিল। তিন জন ছাড়া বাকিরা আসেননি।’’ তিন জন কারা? তৃণমূল, কংগ্রেস এবং এক নির্দল। নোয়াপাড়ার পলতায় আবার সিপিএমের এজেন্টকে বুথ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগে সরব হয়েছিলেন প্রার্থী স্বয়ং। এলাকার ভারপ্রাপ্ত মাইক্রো-অবজারভার কিন্তু সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন, কোথাও এমন কিছু হয়নি, যে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ দরকার।
উদাহরণ হয়তো আরও অনেক পাওয়া যাবে। তবে হাঁড়ির একটি ভাত টেপার মতো এমন দু’একটি নমুনা সামনে রেখে অনায়াসে বলা যেতে পারে, ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোটের মোকাবিলায় বিরোধী দলগুলি কার্যকর ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সমস্যার বীজ এখানেই। সবাই জানি, সংসদীয় রাজনীতিতে ভোটে জেতার কোনও বিকল্প নেই। আর শাসকদের হাতে প্রশাসনের রাশ থাকায় তারা অনায়াসে কিছু বাড়তি সুবিধা পায়। গুজরাতে মোদীর দল, বা এই রাজ্যে মমতার— সকলের বেলাতেই এটা প্রযোজ্য।
কিন্তু শাসকদের দাপটের বিরুদ্ধে বিরোধীদেরও তো কিছু করার থাকে। তাদেরও কি উপযুক্ত ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে? সিপিএম এবং কংগ্রেস বুঝেই নিয়েছে, নিয়মরক্ষার চেয়ে বেশি কিছু করার মুরোদ তাদের আর নেই। এই অবস্থায় বিজেপি প্রধান বিরোধী হিসেবে মাথা তুলছে ঠিকই, কিন্তু ভোটের ফলে শাসকদের সঙ্গে ফারাক এখনও দুস্তর।
এর সবটাই ভোট লুটের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করলে বোধহয় অতি সরলীকরণ হয়ে যাবে। ভুললে চলবে না, উলুবেড়িয়ায় বিজেপি কিন্তু এত অভিযোগের পরেও তিন লাখ ভোট পেয়েছে। নোয়াপাড়ায় সিপিএম-কংগ্রেসের সম্মিলিত ভোট গত বিধানসভার তুলনায় ৪৫ হাজার কমেছে এবং বিজেপির ভোট বেড়েছে ১৫ হাজার।
বাম আমলের দীর্ঘ সময় জুড়ে বিরোধী দল কংগ্রেস কীভাবে নিজেদের ফুরিয়ে ফেলেছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। আবার কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরি করে বিরোধী নেত্রী মমতা নিরন্তর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কীভাবে জনগণের মান্যতা আদায় করতে পেরেছিলেন, সেটাও সবাই দেখেছেন। তাঁর সাফল্যও এসেছে সেই পথ ধরেই।
মমতা আজ ক্ষমতায়। কিন্তু গণতন্ত্রে বিরোধী পরিসর তো উবে যেতে পারে না। পরিহাস হল, বিরোধী রাজনীতিই এখন এক অদ্ভুত দিশাহীন ম্রিয়মাণতার শিকার। যে কোনও কারণেই হোক, তারা কেউই তাই এখনও জনমনে মান্যতার সেই স্তর ছুঁতে পারছে না। শাসকরা তার ‘সদ্ব্যবহার’ করবেই। অবস্থা যতক্ষণ না বদলাবে, কান্না বৃথা!
মাঠে নেমে খেলতে না পেরে প্রতিপক্ষ আমাকে ল্যাং মেরেছে বললে দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। দুঃখের বিষয়, এটাই এখন পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের অবয়ব। নোয়াপাড়া ও উলুবেড়িয়া তা ফের দেখিয়ে দিল।