নোটবন্দি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে

বড় অর্থমূল্যের নোট কি সত্যিই খুব জরুরি

আমাদের সমস্ত অর্থনৈতিক লেনদেনের খবরই যদি সরকার দরকার হলে জানতে পারে, তবে তা আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক।আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে: আমাদের সমস্ত অর্থনৈতিক লেনদেনের খবরই যদি সরকার দরকার হলে জানতে পারে, তবে তা আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক।বড় অর্থমূল্যের কাগজের নোটের সঙ্গে দুর্নীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ঘুষ দিতে গেলে তা কাগজের নোটেই দিতে হয়, চেকে বা ডিম্যান্ড ড্রাফটে নয়! লিখছেন কৌশিক ভট্টাচার্য

Advertisement

কৌশিক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০৮
Share:

আমাদের সমস্ত অর্থনৈতিক লেনদেনের খবরই যদি সরকার দরকার হলে জানতে পারে, তবে তা আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক।বড় অর্থমূল্যের কাগজের নোটের সঙ্গে দুর্নীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ঘুষ দিতে গেলে তা কাগজের নোটেই দিতে হয়, চেকে বা ডিম্যান্ড ড্রাফটে নয়! একই ভাবে রাজস্ব এড়ানোর জন্যও সেই কাঁচা টাকা। প্রোমোটার তাই বাড়ির দামের একটি অংশ আমাদের কাছে চায় বড় অর্থমূল্যের কাগজের নোটে। শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের সর্বত্রই কাগজের নোটের— বিশেষ করে বড় মূল্যের নোটের— ব্যবহার সবচেয়ে বেশি কালোবাজারিদের মধ্যে আর অপরাধ জগতে। একশো ডলার বা পাঁচশো ইউরোর মতো বিশাল অর্থমূল্যের নোটের সঙ্গে অপরাধজগতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে বিশ্বের একাধিক সংবাদপত্রে লেখালিখি হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থারাও বর্তমান পৃথিবীতে সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে এ ধরনের নোটের জনপ্রিয়তা নিয়ে বার বার সতর্ক করেছে।

Advertisement

অর্থনৈতিক লেনদেনে নোটের ব্যবহার কমিয়ে চেক, কার্ড বা ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ালে স্বভাবতই অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়। আইআইএম লখনউ-তে বিশ্বের চুয়ান্নটি নানা ধরনের দেশের প্রায় দশ বছরের তথ্য নিয়ে করা বর্তমান লেখক ও সানি সিংহের গবেষণাতেও যে প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েেছ, সেটা এই সাধারণ বুদ্ধির সঙ্গে প্রায় পুরোপুরি মিলে যায়। যে দেশে বড় অর্থমূল্যের নোটের ব্যবহার যত বেশি, সেই দেশে দুর্নীতির প্রবণতাও সাধারণ ভাবে তত বেশি।

তবে, একটি দেশে দুর্নীতির প্রবণতা ঠিক কতটা হবে বা ঠিক কী চেহারা নেবে তা শুধুমাত্র কাগজের টাকার উপর নয়, আরও অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। অন্য দিকে, এটাও ঠিক যে বড় টাকার সর্বগ্রাসী ব্যবহার কমাতে পারলে অর্থনীতি বা সমাজজীবনের স্বচ্ছতাকে অল্প হলেও বাড়ানো সম্ভব। বিশ্বের অনেক দেশেই এই সব কারণে কাগজের নোটের জোগান আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলা হচ্ছে।

Advertisement

ভারত সরকারের আরও একটি বড় সমস্যা জাল নোট নিয়ে। নোট জাল করা সাধারণ জালিয়াতের পক্ষে খুবই শক্ত কাজ, তবে পিছনে কোনও রাষ্ট্রশক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন থাকলে কাজটি সহজ হয়। শত্রু দেশে জাল টাকা সরবরাহ করাটা অনেক সময় অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। পাঁচশো আর এক হাজার টাকার নোট বাজার থেকে তুলে নেবার সিদ্ধান্তকে তাই এক কথায় হাস্যকর বা রাজনৈতিক চাল বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

কিন্তু কিছু প্রশ্ন আছে। প্রথমত, যদি অর্থনীতিকে কালো টাকা মুক্ত করাটাই উদ্দেশ্য হয়, তা হলে নতুন করে আবার পাঁচশো টাকা আর দু’হাজার টাকার নোট ছাপানোর প্রয়োজন হচ্ছে কেন? এই নোটগুলি কি আবার দুর্নীতির জন্ম দেবে না? এই নোটও যে নকল হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী?

দ্বিতীয় প্রশ্নটি এই সিদ্ধান্তের পদ্ধতিগত দিক নিয়ে। দেশের নোট সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক্তিয়ারভুক্ত। দেশের আইন অনুযায়ী সরকার এ সব ব্যাপারে মাথা গলাতেই পারে, তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাজে বেশি খবরদারি করা বা সরাসরি নাক গলানো কিন্তু খুব বিচক্ষণতার পরিচয় নয়। এই পুরো সিদ্ধান্তটি কতখানি রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে জানিয়ে বা তার পরামর্শ নিয়ে হয়েছে সে ব্যাপারে এখনও আমরা খুব বেশি কিছু জানি না। তবে এটুকু জানি যে দেশের সংসদে বিষয়টি নিয়ে কোনও বিতর্ক হয়নি। গণতন্ত্রে যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত সংসদে বিতর্কের পরে।

তৃতীয় প্রশ্নটি এই সিদ্ধান্তের আকস্মিকতা নিয়ে। এত বড় একটি সিদ্ধান্ত এমন হঠাৎ করে ঘোষণা করলে তাতে যে শুধু কালো টাকার কারবারিরাই নয়, সাধারণ মানুষ-ও যে প্রবল অসুবিধার সম্মুখীন হবেন, সেটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হতে হয় না। রাতারাতি তো আর দেশের সবাই চেক, কার্ড বা ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করতে পারবেন না। অনেক গরিব লোকের তো এখনও অবধি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-ই নেই! গরিবদের সামান্য সঞ্চয়ে যদি কিছু পাঁচশো টাকার নোট থাকে, তবে তাদের তা ভাঙানোর প্রয়োজন হলে, কে বলতে পারে, তারা এই অল্প সময়ের মধ্যেই শোষণের শিকার হবে না? চাহিদা-জোগানের অর্থনীতি কিন্তু বলে যে কালোবাজারিদের রুখতে গিয়ে আমরা হয়তো একটি নতুন নোট ভাঙানোর বাজারের জন্ম দেব। এই বাজারের রং সাদা, না কালো, না ধূসর, সেই বিতর্কে না গিয়েও এটুকু বলা যেতে পারে যে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে একশো বা আরও ছোট টাকার জোগান অনেকখানি বাড়িয়ে এবং আরও একটু সময় নিয়ে বড় অর্থমূল্যের নোটগুলি ধীরে ধীরে বাজার থেকে তুলে নিলে হয়তো সাধারণ মানুষকে এত অসুবিধেয় পড়তে হত না।

এ ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদীর সমর্থকেরা হয়তো বলবেন যে বেশি সময় দিলে কালোবাজারিরাও সময় পেয়ে যেত আর এই অতিরিক্ত সময়ের সম্পূর্ণ সুযোগ নিত। কিন্তু, কালোবাজারিরা যেহেতু সকলেই ধনী, তাদের লোকবল বা ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি। তাই অল্প সময়ের মধ্যেও তারা এর সুযোগ এমন ভাবে নিতে পারবে যা কোনও গরিব মানুষ বা মধ্যবিত্তর পক্ষে সম্ভব নয়। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা অনেক বড় অর্থমূল্যকেও ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোককে নিযুক্ত করে তাদের কাজ উদ্ধার করে নিতে পারবে। অবশ্যই, এই কাজ লোককে দিয়ে করাতে খরচ রয়েছে, উপরি ঝামেলা বা ঝুঁকি তো রয়েছেই। এই অতিরিক্ত খরচ বা ঝামেলা ও ঝুঁকির কারণে দুর্নীতি বা কালো টাকার প্রভাব একটু কমবে এমন আশা করা অন্যায় নয়, তবে খুব নাটকীয় ভাবে কমার আশা না করাই ভাল।

আরও একটা কথা মনে রাখা ভাল। আমাদের সমস্ত অর্থনৈতিক লেনদেনের হাঁড়ির খবরই যদি সরকার দরকার পড়লে জানতে পারে তবে তা আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। যারা ক্ষমতায় থাকবে, এই খবর জানতে পারবে তারাই। আজকে এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তাদের মাধ্যমে আমরা সন্ত্রাসবাদীদের জব্দ করতে পারি, কিন্তু এ কথা কি নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে আগামী কাল রাষ্ট্রশক্তি-ই সন্ত্রাসবাদী হয়ে উঠবে না? একনায়কদের কাছে তো এমন ক্ষমতা লোভনীয় ব্যাপার। বিরোধীদের যে কোনও রাজনৈতিক পরিকল্পনার পূর্বাভাস তারা পেয়ে যেতে পারে এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে।

তাই বড় নোটের ব্যবহার কমালেও, কাগজের নোটের ব্যবহার একেবারে দূর করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

আই আই এম লখনউ-এ অর্থনীতির শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement