সম্পাদকীয় ১

নামিতে পারিবেন?

রাজনীতি যদি হিংসার পথে হাঁটেও, রাজ্যের প্রশাসন কেন প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণের পথই বাছিল? পুলিশ হইতে সর্ব স্তরের প্রশাসনিক যন্ত্র, এমনকী নির্বাচন কমিশনও কেন সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার কথা ভুলিয়া গেল?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০৩
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঘের পিঠে সওয়ার হইয়াছেন বলিলে বেচারা শার্দুলটির অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠিতে পারে। বরং, বলা যাউক, তিনি একটি টির‌্যানোসরাস রেক্স-এ চাপিয়াছেন। গণতন্ত্রকে পা ফেলিবার জন্য তিলমাত্র জায়গা তিনি ছাড়েন নাই। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া তৃণমূল কংগ্রেস যে সর্বাত্মক হিংসার খেলায় মাতিয়াছে, তাহা মুখ্যমন্ত্রীর এই বিপজ্জনক সওয়ারিরই ফল। অনুমান করা চলে, দলের অভ্যন্তরে বিপুল ভয়, বিরোধীদের খানিক জমি ছাড়িলেই ভোটে উলটপালট হইয়া যাইতে পারে। এখনই তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া বিজেপি গোটা রাজ্যে পঞ্চায়েত দখল করিয়া লইবে, এমন খোয়াব মুরলীধর লেনের নেতারাও দেখেন না। কিন্তু, যেখানে যে কয়টি পঞ্চায়েত হাতছাড়া হইবে, সেখানেই ক্ষয়, এবং ২০১৯ সালে সেই ভাঙন দলকে দুর্বল করিবে— এমন একটি আশঙ্কা কালীঘাটের হাওয়ায় ভাসিতেছে বলিয়া অনুমান করা চলে। ফলে, নেতৃত্ব ঝুঁকি লইতে নারাজ। নির্বাচনের পূর্বেই ফলাফল নিশ্চিত করিতে অনুব্রতরা ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন। এবং, ভয় কাটাইবার অস্ত্রও ভয়। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন বহু দিন যাবৎ হিংসাত্মক। কিন্তু, সেই নিরিখেও, বর্তমান সন্ত্রাস অভূতপূর্ব। অবশ্য, এই পরিণতিই ‘স্বাভাবিক’। গণতান্ত্রিক পরিসরের তোয়াক্কামাত্র না করিয়া পেশির জোরে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের যে বামপন্থী ঐতিহ্যটিকে তৃণমূল কংগ্রেস প্রাণপণে আপন করিয়া লইয়াছিল, তাহাকে ছাড়িবার উপায় নাই। টি রেক্স-এর পিঠ হইতে নামিবার বিপদ মুখ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ জানেন। অতএব, হিংসাই ভরসা।

Advertisement

রাজনীতি যদি হিংসার পথে হাঁটেও, রাজ্যের প্রশাসন কেন প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণের পথই বাছিল? পুলিশ হইতে সর্ব স্তরের প্রশাসনিক যন্ত্র, এমনকী নির্বাচন কমিশনও কেন সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার কথা ভুলিয়া গেল? সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় নিশ্চয় অমরেন্দ্রকুমার সিংহকে দেখিয়া মুচকি হাসিতেছেন। শ্রীসিংহ যে ভঙ্গিতে মনোনয়ন পেশের সময়সীমা বাড়াইয়াও রাতারাতি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করিয়া লইতে বাধ্য হইলেন, তাহাতে কমিশনের সম্মান বাড়ে নাই। কিন্তু, অন্য কিছু হওয়ার ছিল কি? দলীয় খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধিয়া রাখিলে যে শাসকের অঙ্গুলিনির্দেশেই আমলা ও পুলিশকর্তাদের চলিতে হয়, এই কথাটি রাজ্যবাসী বিলক্ষণ জানেন। অন্য দিকে, প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, পুলিশ-প্রশাসনকে স্বাধীন ভাবে কাজ করিতে দেওয়া দানবের পিঠ হইতে নামিয়া আসারই নামান্তর। নবান্নের শীর্ষতল হইতে কী নির্দেশ গিয়াছে, অনুমান করা চলে। ফলে, বিরোধীদের রক্তাক্ত হইতে দেখিয়াও পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকিয়াছে। নির্বাচন কমিশনার রাতারাতি নির্দেশ প্রত্যাহার করিয়া লইয়াছেন।

দলীয় নেতা হইতে রাজ্যের প্রধান প্রশাসক হইয়া উঠিবার জন্য যে দূরত্বটি অতিক্রম করিতে হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি সেই পথ হাঁটিতে সম্মত? ২০১৫ সালের পুরভোট, ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের পর এই পঞ্চায়েত নির্বাচন, কোথাও তিনি সদিচ্ছার কোনও নিদর্শন পেশ করিতে পারেন নাই। তাহার প্রধানতম কারণ, তাঁহার রাজনীতি এখনও অনুব্রত-আরাবুলদের উপর নির্ভর করিয়াই চলে। তিনি রাজ্যের সর্বাগ্রগণ্য জননেত্রী, কিন্তু কী আশ্চর্য, জনতার মতকে সম্মান করিবার শিক্ষাটি তিনি গ্রহণ করিলেন না। সব নিয়ন্ত্রণ করিবার, যে কোনও ভাবে সব দখল করিবার বাম ঐতিহ্যই তাঁহার রাজনৈতিক মতবাদ হইয়া থাকিল। পরিবর্তন কি আসিবে না? তিনি নিজেও কি বিশ্বাস করেন না যে তাঁহার দল ক্ষমতায় থাকাকালীন এমন কিছু কাজও করিয়াছে যাহার জন্য মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া তাঁহাদের ভোট দিবেন? বিশ্বাসটি থাকিলে, তাঁহার বিপজ্জনক বাহনটিকে থামান। আশা করা যায়, টি রেক্স-এর পরিণতি তিনি জানেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement