ছাত্রীর যৌন হেনস্থায় দিনভর উত্তাল ঢাকুরিয়া। নিজস্ব চিত্র।
আমাদের সম্ভবত একটা পশ্চাদপসরণ ঘটছে। সভ্য সমাজের গতিটা যে দিশায় থাকে, সেই দিশায় আমরা আদৌ এগোচ্ছি কি না, তা নিয়ে সংশয় ক্রমশ প্রগাঢ় হচ্ছে। এই পশ্চাদপসরণের কারণ বহুবিধ হতে পারে। কিন্তু সরণটা যে স্বাভাবিকতার উল্টো দিকেই, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কমে আসছে।
দক্ষিণ কলকাতার একটা স্কুলে একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার অভিযোগ উঠেছে। পাঁচ বছর বয়সি এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ। আর নির্যাতনের অভিযোগ এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
এমনই এক অভিযোগ যে, ভাবলেই বিবমিষা জাগে। এই প্রথম এমন অভিযোগ উঠল, তা নয়। এ শহরে বা এ রাজ্যে বা ভিনরাজ্যে বা ভিনদেশে— একাধিক স্থানে একাধিক বার এই রকম অভিযোগ উঠেছে আগেও। তাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে একে দেখা সম্ভব নয়। একটা প্রবণতার আভাস মেলে। আর তখনই বিবমিষা আরও বেড়ে ওঠে। সভ্য হিসেবে পরিচিত যে সমাজ, সেখানে এই রকম জঘন্য প্রবণতাও থাকতে পারে! বিস্ময় জাগে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
সুতরাং বিনোদিনী স্কুলের পড়ুয়াদের অভিভাবকরা যে ক্ষোভে ফুটতে শুরু করলেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ক্ষোভ অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু তার পরে আবার বিস্মিত হওয়ার পালা। আবার সভ্যতার বোধ বা শিক্ষা নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার উপক্রম।
অভিযুক্ত শিক্ষকের শাস্তির দাবি তোলার নামে স্কুল চত্বরে সমবেত হয়ে যা ঘটালেন অভিভাবকরা এবং না-অভিভাবকরা, তাকেই বা সমর্থন করা যাবে কী ভাবে? আবার বলছি, যে রকম গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, তাতে রোষ স্বাভাবিক। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অবিলম্বে পদক্ষেপের দাবি করে জমায়েতে সামিল হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু স্কুল তছনছ করে দেওয়ার চেষ্টা করা, সব শিক্ষক-শিক্ষিকাকে হেনস্থার চেষ্টা করা, পুলিশের উপরে উন্মত্ত ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া, রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা শিক্ষিকাকেও চরম হেনস্থা ও নিগ্রহ করা— এ সব কোন সভ্যতার পরিচয়! প্রতিবাদের নামে এ তো নৈরাজ্যের সাধনা! অপরাধের বিচারের দাবি কি অপরাধের মাধ্যমেই তুলতে হয়?
আরও পড়ুন: ‘‘বাবা কেন দিদিমণিদের মারল’’, বুঝতেই পারছে না বিনোদিনীর ছাত্রী
সমাজ জুড়ে যেন এক সামগ্রিক অসহিষ্ণুতার ছবি আজ। সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক বুনটটার প্রতি গভীর অনাস্থা তৈরি না হলে এমনটা হওয়া সম্ভব নয়। আস্থার অভাবটা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। পারস্পরিক বিশ্বাসে ফাঁক তৈরি হচ্ছে। চেতনে হোক বা অবচেতনে, মানুষ সম্ভবত অসহায় বোধ করছে। কেউ সুবিচার দেবে না, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কোনও বিহিত হবে না, যা করার নিজেকেই করে ফেলতে হবে— এমন একটা ধারণা সাধারণ্যে চারিয়ে যাচ্ছে সম্ভবত। সেই কারণেই অসহায়তার বোধ। অতএব যে কোনও প্রতিকূল বা অপ্রীতিকর ঘটনার ক্ষেত্রেই বিচারের ভার নিজেদের হাতে তুলে নিতে চাইছে উন্মত্ত জনতা। আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে চুরমার হচ্ছে বার বার।
এই বিশৃঙ্খলা বা এই নৈরাজ্যের দায় কিন্তু কোনও একপক্ষের নয়। দায় অনেককেই নিতে হবে আজ।
প্রথমত, অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে উন্মত্ত জনতাকেই। প্রতিবাদ জানানোর বা দাবি আদায়ের পন্থাটা হয় তাঁরা জানেন না অথবা রাগে-ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা সে দিন। কিন্তু তাতেও অপরাধ লঘু হয় না কোনওভাবেই।
দ্বিতীয়ত, পুলিশের ভূমিকা সন্তোষজনক নয় রাজ্যের অধিকাংশ এলাকাতেই। সন্তোষজনক নয় বলেই জনতা উন্মত্ত হলেই সর্বাগ্রে রোষ গিয়ে পড়ে পুলিশের উপরে। এ রাজ্যে এ ছবি প্রায় দস্তুর হয়ে উঠেছে। পুলিশের এই জঘন্য ভাবমূর্তি জনসাধারণের মনে অসহায়তার বোধ আরও বাড়িয়েছে।
তৃতীয়ত, দায় নিতে হবে এ দেশের রাজনীতিকদেরও। পুলিশকে এইভাবে ঠুঁটো করে রাখার দায় রাজনীতিরই। পুলিশ-প্রশাসনকে দাসানুদাস বানাতে গিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের ভাবমূর্তি রসাতলে পাঠিয়ে দিয়েছেন রাজনীতিকরা।
অর্থাৎ ঘি, বেলপাতা, সমিধ— সবই প্রস্তুত। অতএব, যজ্ঞাগ্নিত লেলিহান হয়ে উঠবেই। বিনোদিনী স্কুল তারই সাক্ষী হল।