কাশ্মীরে এ বার উপনির্বাচনে যে কাণ্ড হইল, তাহা হইতে দিল্লির একটি শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কাশ্মীরে যে কোনও সংকটের মধ্যেই পাকিস্তানের হাত কিংবা সন্ত্রাসবাদীদের চক্রান্ত খুঁজিয়া দিল্লির রাজনীতিকরা সতত নাজেহাল থাকেন, এ বারে কিন্তু তাহার অবকাশ কম। উপত্যকায় সাত শতাংশ ভোটারও এ বার ভোট দেন নাই। বার্তাটি পরিষ্কার: বিদেশি হাত বা সন্ত্রাসী হাতিয়ারের বাহিরেও কাশ্মীর উপত্যকার আর একটি সত্য আছে: সাধারণ মানুষের মন। সেই মন ও মনোভাব যে ভারতের প্রতি একেবারেই তিক্ত ও বিদ্বিষ্ট, কোনও রকম আদানপ্রদানের সম্ভাবনাতেও আর রাজি নয়, কোনও প্রত্যাশা প্রতিশ্রুতির কথা শুনিতে রাজি নয়, এই বারের ভোট-অভিজ্ঞতা তাহা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছে। শ্রীনগর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে এত কম মানুষকে ভোট দিতে দেখিয়া শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে অনন্তনাগ উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে পশ্চাদপসরণ করিতে হইয়াছে। বাস্তবিক, মানুষ ভোট না দিলেও এত হিংসাত্মক কাজকর্মে লিপ্ত হইবেন, এমনটা কমিশন বা কেন্দ্রীয় সরকার কেহই ভাবে নাই। ফলত ক্ষিপ্ত কাশ্মীরি জনতার ছোড়া পাথর আর মারধরের সামনে অধিকাংশ জায়গাতেই ভারতীয় জওয়ানদের বেশ অসহায় দেখাইয়াছে। শেষ পর্যন্ত আট জন নিহত, প্রায় দুই শত জন আহত, এবং একাধিক ভোটবুথ আক্রান্ত, বহু নিরাপত্তাকর্মী প্রহৃত। ভাঙা ভোটযন্ত্র নদীর জলে নিরুদ্দেশের দিকে ভাসিতেছে: অলংকার হিসাবে কাশ্মীরের পরিস্থিতি বর্ণনার পক্ষে ইহাই যথেষ্ট।
উনিশশো নব্বই-এর দশক হইতে শুরু করিয়া উপত্যকায় এত স্বল্প ভোট আর কখনও পড়ে নাই। ২০০৪, ২০০৯ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে পঁয়ত্রিশ, চল্লিশ ও পঞ্চাশ শতাংশ ভোটের রেখাচিত্র যেটুকু আশা সঞ্চার করিয়াছিল, ২০১৭ সাল কাশ্মীরকে ভারতের স্বাভাবিক অঙ্গরাজ্য হিসাবে পরিচিতি দিবার আশায় অনেকখানি জল ঢালিয়া দিল। হুরিয়ত এ বারও ভোট বয়কটের ডাক দিয়াছিল, প্রতি বারের মতোই। ২০০৯ বা ২০১৪ সালে সেই ডাক সত্ত্বেও ভোট পড়িয়াছিল। এ বার বরং নূতন হইল সামাজিক চাপ। ভোটের লাইনে ছবি উঠিয়া গেলে প্রতিবেশী পরিজনরা পরিত্যাগ করিবেন, এই ‘ট্যাবু’ কেহই আঙুলে কালি লাগাইবার দাম হিসাবে স্বীকার করিতে রাজি হন নাই।
লক্ষণীয়, মারমুখী কাশ্মীরি ‘জনতা’র মধ্যে সদ্যতরুণদের সংখ্যাধিক্য। মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির আক্ষেপ, ছেলেগুলি কাশ্মীরের পরিস্থিতির জটিলতা বুঝিবার মতো বড়ও হয় নাই, অথচ তাহার আগেই সংঘর্ষে তাহাদের প্রাণ যাইতেছে, পেলেটে পঙ্গু হইতেছে। এ আক্ষেপও তিনি করিতে পারিতেন যে, ‘বড়’ হইবার আগেই তাহারা রাষ্ট্রবিদ্বেষে অভ্যস্ত হইয়া যাইতেছে। বয়ঃপ্রাপ্ত না হইতেই যাহারা রাষ্ট্রবিরোধী ও সরকারবিরোধী, তাহাদের নিকট বিকল্প রাজনৈতিক বিবেচনা বা রাজনৈতিক কার্যক্রম পৌঁছনো অত্যন্ত দুরূহ। এই প্রবল নেতি-মানসিকতার ক্ষত অনেক দিনের নির্মাণ, উপত্যকার প্রায় প্রতি সংসারের মধ্যে সেই ক্ষতের বীজ প্রোথিত, চোখের সামনে আপনজন কিংবা সুহৃদ নেতাদের নিহত ও অপহৃত হইতে দেখিয়া তাহারা জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের আগেই রাষ্ট্রবিরোধিতার অঙ্গীকারে আবদ্ধ। ২০১৬ সালে তরুণ নেতা বুরহান ওয়ানির নিধনকে এই প্রেক্ষিতেই বুঝিতে হইবে। আজিকার আকস্মিক উত্তালতা এই দীর্ঘমেয়াদি ইতিহাস ও সাম্প্রতিক রাষ্ট্রীয় হিংসারই একত্র ফল। পিডিপি-বিজেপি সরকারের ব্যর্থতা ইত্যাদি দর্শাইয়া বিরোধী নেতা ওমর আবদুল্লা রাজনীতির গোল দিবার চেষ্টা করিতেই পারেন, কিন্তু উপত্যকার মন উঠিয়া যাইবার কারণটি শরিক-সরকার-আঁতাঁতের কার্যকারিতা জাতীয় মডেল দিয়া বোঝা অসম্ভব। গল্পটি আরও বৃহৎ, দীর্ঘবিস্তারী।