প্রচ্ছন্নে: বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া সংক্ষিপ্ত হাসপাতাল সফরের পর কারাগারে ফেরার পথে, ঢাকা, ৮ নভেম্বর। এএফপি
বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাঁসর-ঘণ্টা বেজে গিয়েছে, দিন ক্ষণও ঠিক হয়ে গিয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর, দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দল ও তাদের নেত্রীদের মধ্যে (যাঁরা 'battling Begums' নামে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে প্রসিদ্ধ), শেষ অবধি বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা কে বাঁধতে পারে। বর্তমান বাংলাদেশের ধর্মীয়-সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে আন্দাজ করা সত্যিই শক্ত যে, শেষ হাসিটা কে হাসবে। এ বার ভোটের অঙ্কটা আসলে প্রথম থেকেই গোলমেলে। কারণ, প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলকে খুঁটি করে তৈরি হয়েছে দু’টি জোটবদ্ধ দল। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মোট ৮টি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে তৈরি ‘মহাজোট’ (যার মধ্যে এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টিও আছে) এবং বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি ও তার সহযোগী দল জামাত-এ-উলেমা-এ-ইসলাম এর সঙ্গে জোট বেঁধে তৈরি ২০ দলীয় ‘জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট’। কিন্তু বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বন্দিদশা এবং একমাত্র প্যারোলের মাধ্যমে না হলে অচিরে জেল থেকে তাঁর মুক্তি পাবার সম্ভাবনা প্রায় না থাকার কারণে, এই জোটকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও বাংলাদেশ সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা ড. কামাল হোসেনকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে শুরু করে খোদ বাংলাদেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরাও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন আদৌ এ বারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট গ্রহণ সম্ভব হবে কি না, সেই প্রসঙ্গে। এর মধ্যে স্বভাবতই তথাকথিত ৮টি বামপন্থী গণতান্ত্রিক দলের মুখপাত্ররাও আছেন।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনভিত্তিক এক গবেষণা সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, মোট ৬৬ শতাংশ নাগরিকের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমর্থন রয়েছে এবং ৬৪ শতাংশ নাগরিক চান আওয়ামী লীগ সরকারই ফিরে আসুক। তাঁদের মতামত অনুযায়ী এর মূল কারণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিতে সাধারণ মানুষের সন্তোষ প্রকাশ। কিন্তু এই প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে, মাত্র ৫১ শতাংশ নাগরিক মনে করেন দেশে গণতন্ত্রের আবহ অটুট আছে। বাংলাদেশ নির্বাচন পরিস্থিতি সবার সমান সুযোগ সৃষ্টি বা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর ধারে কাছেও নেই বলে মন্তব্য করেছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্স। ওই দেশের এমপিদের জন্য তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিচ্ছে। অন্য দিকে বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে এই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকার কারণেই পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে কমনওয়েলথ এখনও কোনও বিবৃতি দেয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একাধিপত্য এবং এই কয়েক বছরে সাফল্যের ধারা বজায় রাখার পরও এমন অভিযোগ বা আশঙ্কার কারণ কী?
২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পথকে মসৃণ করেছিল বেশ অনেকগুলো ফ্যাক্টর, যার মধ্যে অন্যতম কারণ ছিল ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া। ২০১৩ সালে এই ‘রাজাকার’দের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে প্রায় ৭৪ শতাংশ মানুষ লীগ সরকারকে সমর্থন জানান। তরুণদের নেতৃত্বে শাহবাগ আন্দোলন এক ধরনের ‘কালচারাল ফ্রন্ট’-এ পরিণত হয়। নির্বাচন কমিশন জামাত-এর মতো রাজনৈতিক দলের বৈধ অস্তিত্বকেও অস্বীকার করে। এই সব ঘটনার বিরোধিতা করে বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখে কাজ করার সুযোগ হারায়। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই জঙ্গিবাদকে দমন করে আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজিয়ে প্রথম বিশ্বের কিছু দেশ, অান্তর্জাতিক সংস্থা ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর আস্থা অর্জনে সফল হয়। ২০০৯ সালের পিলখানার ঘটনায় সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১৫-য় লীগ সরকার বিশেষ প্রক্রিয়া শুরু করে। এই একই বছরে ইসলামীয় মৌলবাদী কয়েকটি সংগঠনের আক্রমণে উদারনীতিক চিন্তাধারার ব্লগার, প্রকাশক এমনকী বিদেশিকে হত্যা করে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজ়েন রেস্তরাঁর ঘটনায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংস্থা আইএস দায় স্বীকার করলে, বিশেষত ঢাকার উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বাংলাদেশের জামাতের মতো ইসলামি দলগুলোর অস্তিত্বে শঙ্কাপ্রকাশ করে ও দেশে পাকিস্তানবিরোধিতা তুঙ্গে ওঠে। এ দিকে ২০১৭ সালে ৭০ লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা মায়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে, লীগ সরকার আন্তর্জাতিক মহলের প্রশংসা অর্জন করে।
কিন্তু গোল বাধে সাম্প্রতিক কিছু পরস্পরবিরোধী ঘটনায়। প্রথম সমস্যা অবশ্যই হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বার বার আক্রমণ ও তাদের দেশত্যাগ। যার প্রভাব বর্ডারের পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর ওপর পড়েছে। গত ১১টি আদমশুমারির তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমেছে প্রায় ২৪ শতাংশ। অধ্যাপক আবুল বারাকাত বাংলাদেশের ২৭টি আদিবাসী গোষ্ঠীর জনসংখ্যা হ্রাসের তথ্য দিতে গিয়ে দেখিয়েছেন, শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে আগে যেখানে আদিবাসীদের অনুপাত ছিল ৭৫ শতাংশ, এখন তা কমে হয়েছে ৪৭ শতাংশ। তিনি এ ক্ষেত্রে জমি দখলের নানা কৌশলের কথাও উল্লেখ করেছেন। রংপুরের গাইবান্ধায় সাঁওতাল পরিবারগুলোকে জমি, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এই আক্রমণগুলি একেবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন সরকারি আমলা-কর্মচারীরা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। যদিও হাসিনার সরকার দলিত ও সমতলের আদিবাসীদের কর্মসংস্থানের জন্য দু’শো কোটি টাকার প্রজেক্ট পাশ করার কথা ঘোষণা করেছে মাত্র ক’দিন আগেই, তবু ‘মাইনরিটি ফোরাম বাংলাদেশ’ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তাদের ওপর আক্রমণের। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও হিন্দু মহাজোট-এর একটি দল ঘোষণা করেছে, তারা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ভোট দেবে!
অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নতি, উদারনৈতিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের কথা বার বার উল্লেখ করেছে বর্তমান সরকার। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে বছরে কয়েক কোটি লক্ষ টাকা যে সব সরকারের আমলেই বিদেশে পাচার হয়, সেই তথ্য সবার জানা। বেকারত্ব বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শহরমুখী অভিপ্রয়াণ। বিচার-বহির্ভূত হত্যা, ধর্ষণও সমান তালে বাড়ছে। কোটা-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে যে শিবির ও ছাত্রদল ছিল, তাদের পেছনে যে বিএনপি-জামাত এর হাত ছিল, সে নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। ক’দিন আগে স্কুলছাত্র-কিশোরদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনে সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’। তাদের স্লোগান, সমস্যা সমাধানের পথ দেখানো ও ছাত্রলীগকে কাজে লাগিয়ে এই আন্দোলন ভন্ডুলের ক্ষত এখনও বাংলাদেশের মানুষদের মনে অক্ষত। শুধু তা-ই না, শহিদুল আলম-এর মতো বিশ্ববরেণ্য ফটোগ্রাফার শুধু আল-জাজ়িরা মিডিয়ায় সরকারবিরোধী নিজের মতটুকু প্রকাশ করেছিলেন, সেই অপরাধে তাঁকে ১০৭ দিন কারাগারের ভিতরে পুলিশি নির্যাতনকে মেনে নিতে হল।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিমুখ খোঁজা এখন বেশ সমস্যার। এক দশক পর বাংলাদেশের প্রধান দুই জনপ্রিয় প্রতীক, নৌকা ও ধানের শিষের সরাসরি লড়াই হতে যাচ্ছে। কিন্তু অনৈতিক ভাবে রাজনৈতিক সুবিধে পাওয়া এখন দুই বাংলার নেতাদের অস্থি-মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে বলে ক্ষমতায় আসাটা এখন কেবল সুযোগ-সুবিধে হাতিয়ে নেওয়ার অস্ত্রে পরিণত। এর মধ্যে একটাই আশার কথা। এ বারে বাংলাদেশের প্রায় ২২ শতাংশ ভোটারের বয়স ১৮ থেকে ২৮-এর মধ্যে। ভোটের ফল নির্ধারণে এই তরুণদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
আসলে পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদী, উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ‘ন্যারেটিভ’ দিয়ে বাংলাদেশের (বা গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার) রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা বেশ শক্ত। বাংলাদেশের মতো প্রান্তীয় পুঁজিবাদী দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর সমস্যা কখনওই শুধু ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম মৌলবাদের বিরোধের মডেলের মধ্যে রেখে ব্যাখ্যা করা যায় না। রাষ্ট্রব্যবস্থার নীতি-নির্ধারণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতাকে বোঝা ও ব্যাখ্যা করার জন্য হয়তো অন্য কোনও ধরনের বিশ্লেষণাত্মক পরিকাঠামো তৈরি করে অনুসন্ধান দরকার।
ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে
ইতিহাসের শিক্ষক