যৌথ পরিবারের অলীক স্বর্গ

এতক্ষণ অবধি ভাবনাটা ভালই ছিল। গোল বাধল সেই কচি মনের হঠাৎ ইচ্ছেকে নিয়ে। ইচ্ছে হল কাকা-পিসি-দাদু-দিদা নয়, আমার সারা দিনের হাবিজাবি মা-কে বলতে চাই।

Advertisement

মৌমিতা করগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share:

এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে নাকি খুব মনখারাপেরা বাসা বাঁধে। সেখানে নাকি কারও সময় নেই কারও জন্য। বাবা মা সন্তান সবাই একা। সেখানে নাকি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পরে মনের মধ্যে যে হাজার প্রজাপতি রং পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকে তা ভাগ করে নিতে মন উসখুস করলেও শোনার মতো কাউকে পাওয়া যায় না বাড়িতে। মনখারাপের পাল্লা ভারী হতে হতে, তার মধ্যে ঘুণপোকার মতো মাথা গলায় একাকিত্ব, অবসাদ, ব্লু হোয়েলের মতো ‘আত্মহত্যার কারবারি’রা। এই ভাল্লাগেনা রোগের একমাত্র দাওয়াই নাকি যৌথ পরিবার। সেখানে দাদু-ঠাকুমা-কাকা-পিসি-দাদা-দিদি কারও না কারও কাছে কচি মন ঠিক আশ্রয় পেয়ে যায়। উজাড় করে মেলে ধরতে পারে নিজের চড়াই উতরাই।

Advertisement

এতক্ষণ অবধি ভাবনাটা ভালই ছিল। গোল বাধল সেই কচি মনের হঠাৎ ইচ্ছেকে নিয়ে। ইচ্ছে হল কাকা-পিসি-দাদু-দিদা নয়, আমার সারা দিনের হাবিজাবি মা-কে বলতে চাই। আমার রাত বারোটায় আইসক্রিম খেতে খেতে ভিক্টোরিয়া দেখার ইচ্ছেটা শুধুমাত্র বাবার সঙ্গেই ভাগ করে নিতে চাই। যৌথ পরিবার সেই ‘স্বাধীন’ ইচ্ছেটাকে মর্যাদা দিতে পারে তো? সেখানে তো আবার ইচ্ছে মানেই সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। তবেই তা ‘ভাল ইচ্ছে’। একার ইচ্ছে মানে তো স্বার্থপরতা। খারাপ।

ছোটবেলায় এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে বড়দের কথা হাঁ করে গিলে বুঝেছিলাম, অমুক বাড়ির তমুক বউটি বিশেষ সুবিধের নয়। কারণ সে মেয়ের জন্য আলাদা করে বিস্কুট আনিয়ে নিজের ঘরে রেখে দেয়। পরে বুঝেছি পাঁচ জনের সংসারে বরাদ্দের দুটো বিস্কুটে বাড়ন্ত বয়সের মেয়েটির খিদে মিটত না। মেয়ের জন্য রোজই বরাদ্দের বাইরে বেশি বিস্কুট নিলে জায়েদের ‘খোঁটা’ শুনতে হত। পৃথক কৌটোর অপরাধের ভারটা বোধহয় মায়ের কাছে ক্ষুধার্ত সন্তানের তুলনায় সহনীয় ছিল। এমন হাজারো ‘ভাল’ পাশাপাশি গা ঘেঁষে থাকত যৌথ পারিবারিক সংস্কৃতিতে।

Advertisement

মনে পড়ে, একটি বছর পনেরোর মেয়ে সারা দিন ধরে অপেক্ষা করেছিল সদ্য লেখা কাঁচা পদ্য মায়ের সঙ্গে ভাগ করে নেবে বলে। অপেক্ষা করতে করতে বিকেল পেরিয়ে সন্ধে, তারও পরে রাত নেমেছিল। যত বার ভাবে, এই বুঝি মা এসে পাশে বসল, মায়ের হাতের কাজ আর ফুরোয় না। মধ্য তিরিশের মা-ও যে অসহায়। বড় সংসারের সব কাজ শেষ করে সবাইকে খাইয়ে খেয়ে তবে তাঁর অবসর। তীব্র অভিমানে কবিতার তাই ছুটি হয়ে গিয়েছিল সে দিন।

একান্নবর্তী পরিবারে বড় হওয়ার সুবাদে শুনেছি, বাবা যত না বন্ধু তার থেকে বেশি গুরুজন। সঙ্গে সঙ্গে মন ছকে নিয়েছে কোনও কোনও কাজ করেও বাড়িতে বলব না। লুকিয়ে যাব, চেপে যাব। অথচ আজকাল বহু নিউক্লিয়ার পরিবারে দেখি ছেলেমেয়েরা প্রথম প্রেম বা ভাল-লাগা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করে বাবা-মায়ের সঙ্গে। বাবাকে আবদার করে বলে, নাইট শো-এ প্রিয় নায়কের সিনেমা দেখতে নিয়ে যেতে। বাবা-মায়ের মাঝে বসে ঝাড়া দু’ঘণ্টার নাইট শো দেখে ক্লান্তিতে বাবার কাঁধে মাথা এলিয়ে অ্যাপ ক্যাবে বাড়ি ফেরা— কৈশোর-তারুণ্যের সুতোয় ঝুলতে থাকা মনটাকে তো বাবা মায়ের এই সান্নিধ্য একটা নিশ্চিন্তিপুরের সন্ধানই দেয়।

যৌথ পরিবারের আঁটোসাঁটো ঘেরাটোপ মানেই শৈশবের স্বপ্নভঙ্গ আর নিউক্লিয়ার পরিবারের স্বাধীনতাই শুধুমাত্র পারে সৃষ্টিশীলতাকে পথ দেখাতে— এ কথা বিশ্বাস করতে হলে তো ফের সেই সাদা-কালোর চক্করেই ঘুরপাক খেতে হবে। তার চেয়ে ভাল বরং মুঠো খুলে দিই। বিশ্বাসের গোঁড়ামি থেকে সরে আসি। বোঝার চেষ্টা করি, শিশুর বড় হওয়ার জন্য আদর্শ পরিস্থিতি বলে আদৌ কিছুই হয় না। সে যে সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থানে, যে পরিস্থিতিতে বড় হচ্ছে সেই পরিবেশটাকেই গড়েপিটে ‘আদর্শ’ করে নিতে হয়।

সমাজ চলার গোটা ব্যবস্থাটাই আমূল পাল্টে গিয়েছে। একান্নবর্তী পরিবারের সেই যুগে এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করা হত যে, মায়েরা, চাকরি নয়, সন্তান পালনকেই প্রাথমিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করবেন। অধিকাংশ বাড়িতে বাবাদের চাকরিও সীমাবদ্ধ থাকত দশটা-পাঁচটার মধ্যে। সময়ের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রেরও এবং কাজের ধরনেরও বিবর্তন ঘটেছে। এখন বেশির ভাগ মা-বাবা ধরাবাঁধা সময়ের চাকরি করেন না। কাজের প্রয়োজনে অনেক মা নাইট ডিউটি সেরে বাড়ি ফেরেন ভোরের আলোর সঙ্গে। কিছু প্রফেশন ছাড়া বাবাদেরও চাকরিতেও দশটা-পাঁচটার ধারণা প্রায় বাতিল হওয়ার পথেই। যৌথ পরিবারে এমন চাকরি করা মা যে বিশেষ সমাদৃত ছিলেন না তা বোধহয় আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

একান্নবর্তী হোক বা অণু-পরিবার, শিশুর মন সে সময়েও আনকোরা ছিল, আজও তা সাদা ক্যানভাসই। নিশ্চিত করতে হবে সেখানে যাতে বিষণ্ণতা বাসা বাঁধতে না পারে। কোনও ভাবে একলা না হয়ে যায় সে। শৈশবের দিনগুলোয় যাতে হাত বাড়ালেই একটা বন্ধুত্বের, ভরসার হাত পায় তারা। আর সে জন্য প্রয়োজন তাকে সময় দেওয়া। তার মনকে তার মতো করে বোঝার চেষ্টা করা। মা-বাবা যেটুকু সময় পাবেন ততটুকু ‘কোয়ালিটি টাইম’ শুধুমাত্র শিশুর জন্যই বরাদ্দ থাক। অনেক মা-বাবাকে আবার দিনের বেশিটা সময় কাজের প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। বাড়ির বয়স্ক অভিভাবক বা পরিচারিকার সাহচর্যে বাচ্চাটিকে তাঁরা রেখে যান চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে। তাঁরা হয়তো শিশুটির খাওয়া-ঘুমের প্রয়োজনগুলোকে যত্ন নিয়েই মেটান। কিন্তু মনের খোরাক? তার চেয়ে বরং ছেলেমেয়েকে দিনের কয়েক ঘণ্টা ক্রেশে বা প্লে স্কুলেই যেতে দিন না! সেখানে তো তারই বয়সি আরও কতকগুলো মন ভুল করতে করতে শিখছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement