গর্জন বিস্তর। কিন্তু বর্ষণ একেবারেই আশানুরূপ নয়। রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচনের ফলাফল দেখার পরে বিরোধী শিবির সম্পর্কে এ কথাই বলতে হচ্ছে।
গণতন্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল বিরোধিতার পরিসর। নরেন্দ্র মোদীরা যে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাতে বিরোধী কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল অনেকটাই। অন্তত সংসদের অন্দরে। পরবর্তী বছরগুলোয় দেশের সিংহ ভাগ রাজ্যের লাগামও বিজেপির হাতে গিয়েছে। বিরোধী দলগুলি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে।
যা হয়েছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হয়েছে। কেন বিজেপি এত জিতল? কেন বিরোধী দলগুলি এত হারল? এমন প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু আইনসভার অন্দরে দুর্বল হয়ে পড়া বিরোধী দলগুলি যে ভাবে পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আইনসভার বাইরে পড়ে থাকা সুবিশাল গণতান্ত্রিক পরিসরটায় শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল এবং পরবর্তী নির্বাচনে আইনসভার আসন বিন্যাসে সেই শক্তি সঞ্চয়ের ছাপ ফেলতে চাইছিল, তা বেশ আশাব্যাঞ্জক ছিল অনেকের কাছেই।
নরেন্দ্র মোদীরা বলেছেন কংগ্রেস-মুক্ত ভারত চাই। কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়ে বা অন্যতর কোনও জোটে সামিল হয়ে বিরোধী দলগুলি বলেছে, মোদী-মুক্ত সরকার চাই। এই প্রতিস্পর্ধা যে কোনও গণতন্ত্রের পক্ষেই স্বাস্থ্যকর। এই প্রতিস্পর্ধা জরুরিও। সেই জরুরি সমীকরণটা তৈরি হতে হতেও যেন হল না। হঠাৎ যেন ভেঙেচুরে গেল বিরোধী রাজনীতির রসায়নাগার।
রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ প্রার্থীর জয় হয়েছে। রাজ্যসভায় এনডিএ-র সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তাই এনডিএ প্রার্থীর জয় বেশ কঠিন ছিল। একটা সময়ে মনে হয়েছিল, এনডিএ প্রার্থীর জয় অসম্ভব।
কংগ্রেস, তৃণমূল, এনসিপি, টিডিপি,টিআরএস, ওয়াইএসআরসিপি, ডিএমকে, বিজেডি, জেডি(এস), আরজেডি, এসপি, বিএসপি, আরএলডি, এনসি, আপ, বাম দলগুলি— সবাই মিলে নানা ইস্যুতে যে ভাবে তীব্র স্বরে আক্রমণ শুরু করেছিল বিজেপি-কে, তাতে একটা দেশজোড়া প্রতিরোধের ছবি ধরা দিতে শুরু করেছিল। শাসকের অশ্বমেধের ঘোড়াকে প্রতিটা পদক্ষেপে বাধা দেওয়ার জন্য সুবিশাল রাজনৈতিক শৃঙ্খল তৈরি হয়ে গিয়েছে আসমুদ্রহিমাচল— এমন একটা ধারণা তৈরি হচ্ছিল। এমনকী বিজেপির বেশ কয়েকটি জোটসঙ্গীও বেসুরে বাজতে শুরু করেছিল।
প্রথমত, রাজ্যসভায় বিজেপির গরিষ্ঠতা নেই দ্বিতীয়ত, শরিকররাও সকলে সঙ্গে নেই। তৃতীয়ত, গোটা বিরোধী পক্ষ একজোট। এমন পরিস্থিতিতে রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে বিজেপির বা এনডিএর প্রার্থী জিতবেন, এমনটা ভাবাই অস্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু ঘটল ঠিক উল্টো। অত্যন্ত সঙ্গোপনে ঘুঁটি সাজিয়ে নিয়ে শাসক আচমকা ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করল। চটপট প্রার্থীও ঘোষণা করে দিল। বিরোধী শিবির আচমকা যেন অথৈ জলে। প্রার্থী ঠিক করতেই লেগে গেল অনেকটা সময়। প্রার্থী যদি বা স্থির হল, ঘরটা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারলেন না বিরোধী নেতারা। রাজ্যসভায় বিজেপি তথা এনডিএর গরিষ্ঠতা নেই জেনেও ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে বিরোধী প্রার্থীকে জেতানোর অঙ্কটা মেলাতে পারলেন না কেউ। অঙ্ক মেলানোর ইচ্ছা তাঁদের কতখানি ছিল, তা নিয়েও সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হল।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
এর পরে ভোটাভুটি হল। তাতে দেখা গেল যে, নিজের ঘর মোটের উপরে অটুট রেখেছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ। দেখা গেল, বিজেডি, ওয়াইএসআরসিপির মতো বিরোধী দল ভোট দিয়েছে এনডিএ প্রার্থীকে। দেখা গেল, কংগ্রেসের ৩ সাংসদ, তৃণমূলের ২ সাংসদ অনুপস্থিত আর গোটা আপ দলটাই ভোটদানে বিরত। সপার ৩, ডিএমকের ২, পিডিপির ২ সাংসদও ভোটদানে গরহাজির। ফলাফল? এনডিএর জয়, বিরোধীদের হার।
আরও পড়ুন: জোটে নেই, বেশি আসন চেয়ে চাপ দিচ্ছেন কেজরীবাল
বিজেপির পক্ষে এই জয় কিন্তু অত্যন্ত স্বস্তির বিষয়। উত্তরপ্রদেশে রাজ্যসভা নির্বাচনেও বিরোধী শিবির ভেঙে দিয়ে এ ভাবেই বাজিমাত করেছিল বিজেপি। এ বার রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচনেও বিজেপি ফাটল ধরিয়ে দিল বিরোধী ঐক্যে। মোদী-শাহ জুটির বিরুদ্ধে গোটা দেশে জোরদার লড়াই চালাচ্ছে সম্মিলিত বিরোধী শিবির। কিন্তু সে লড়াই অত্যন্ত ফলপ্রসূ হতে চলেছে, এমন কোনও বার্তা দেশে চারিয়ে যেতে দিল না বিজেপি।
যে নির্বাচনে এনডিএ প্রার্থী জয়ী হলেন, তা সংসদের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে দেশের জনমতের বর্তমান ছবির বিন্দুমাত্র প্রতিফলনও হয়তো না থাকতে পারে। কিন্তু রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচন দেখিয়ে দিল যে, বিরোধী শিবির এখনও কী সাংঘাতিক ছন্নছাড়া!
সঙ্ঘ পরিবার, সংগঠিত দলীয় কাঠামো, কেন্দ্রীয় সরকার, বিভিন্ন রাজ্যের সরকার এবং জোট শরিকদের সঙ্গে নিয়ে বিজেপি এই মুহূর্তে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং সক্ষম একটা দল। এই বিজেপির মোকাবিলা যাঁরা করতে চান, তাঁদেরকেও সমপরিমাণ সংগঠিত এবং বলশালী হতে হবে। কিন্তু তার বদলে বিরোধী দলগুলির কোনওটি ভোটদানে বিরত থাকল, কোনওটি আংশিক ভাবে ভোটাভুটিতে অংশ নিল, কোনওটি বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়ল। কোনওটি আবার ঘোষণা করে দিল যে, পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে বিরোধী জোটে থাকবে না তারা, একা লড়বে।
রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচনের ফলাফল কী হল, তার উপরে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যক্ষ ভাবে নির্ভর করবে না। কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে মনোবল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে এনডিএ প্রার্থীর জয় সেই মনোবলের হিসেবটাকে অসম করে দিল বেশ খানিকটা। প্রবল পরাক্রমী শাসকের এবং তার অনুগামীদের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়ল। আর বিরোধী শিবিরের মনোবলে ফের বড়সড় ধাক্কা লাগল। যাঁরা পরবর্তী নির্বাচনে বিজেপি-কে ভোট দিতে চান না, তাঁরা কিন্তু উপযুক্ত বিকল্প খুঁজছেন। দেশজুড়ে বিভিন্ন বিরোধী দলের সমস্বর শুনে অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন যে, সম্মিলিত বিরোধী শক্তিতে ভরসা রাখা যেতে পারে। কিন্তু দেশের সুবিস্তৃত ময়দান জুড়ে খেলতে নামার বেশ খানিকটা আগে আইনসভার অন্দরে যে খেলা হল, তাতে বিরোধীদের ছন্নছাড়া দশাটা বেশ কুৎসিত ভাবেই প্রকট হল। বিরোধী শিবিরে পারস্পরিক বোঝাপড়ার হালটা যদি এখনও এমন হয়, প্রতিটা পদক্ষেপে শাসককে আটকে দেওয়ার জেদ যদি না থাকে, তা হলে ২০১৯ সালটা বিরোধীদের পক্ষে খুব একটা সুখকর না-ও হতে পারে।