মশা মারতে কারা নাকি কামান দাগে? এ রাজ্যে নেতা-আমলারা হাতে নিয়েছেন গুলতি। মশা নিয়ে নালিশ ছুড়লেই আসছে পাল্টা পাটকেল। মশার দাপট বাড়ছে? বাড়বেই, আপনি বাড়িতে জল জমিয়ে রাখছেন। গরম না-পড়তে বত্রিশ জনের ডেঙ্গি? হবেই তো, পুরসভার কর্মীকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছেন না।
কলকাতা পুরসভার ‘ভেক্টর কন্ট্রোল’ বিভাগের এক কর্তা সম্প্রতি একটি সভায় বক্তৃতা দিলেন। সঙ্গে গৃহস্থের ট্যাঙ্কে-চৌবাচ্চায় মশার লার্ভার ছবি। এক একটা করে দেখাচ্ছেন, আর বিদ্রুপ-চুপচুপে প্রশ্ন ছুড়ছেন, ‘‘হোয়াট ইজ কর্পোরেশন ডুয়িং?’’ নিখুঁত গুলতি-অপারেশন। যে বাড়িতে মশা চাষ করে, সে পুরসভাকে প্রশ্ন করে কোন আক্কেলে?
সত্যিই তো, যেমন ‘সচেতন’ হলে কারও বাড়িতে মশা জন্মাবে না, তেমন উচ্চতায় পৌঁছয়নি বস্তিবাসী, গ্রামবাসী, গেরস্ত, মধ্যবিত্ত। তাই ডেঙ্গি হয়ে মরছে। তা বলে প্রশ্নটা তো মরছে না। সরকার কী করছে? এ রাজ্যের মানুষ যতই মূর্খ, অলস হোন, তাঁদের ভোটেই চেয়ারে বসেছেন নেতা। তাঁদের টাকায় বেতন পাচ্ছেন অফিসার। তাই পশ্চিমবঙ্গ যদি ডেঙ্গি-রাজধানী হয়ে ওঠে (সরকারি হিসাবে গত বছর আক্রান্ত ছত্রিশ হাজার, যা দেশে সর্বাধিক), তা হলে প্রশ্ন করতেই হবে, কী করছে রাজ্য সরকার? পুরসভা? পঞ্চায়েত?
কেবল ‘অজানা জ্বর’ ফর্মুলা দিয়ে ম্যানেজ হবে না, বুঝেছে সরকার। এ বছর তৈরি হয়েছে খোপ-কাটা ‘ফর্ম’। বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরসভা-পঞ্চায়েতের ফিল্ড-কর্মীরা তথ্য নিচ্ছেন, কার টবে জল জমেছে, কার জ্বর। মশা মারার তেল ঢালছেন। পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে পাঠানো হচ্ছে স্বাস্থ্য ভবনে। জেলাগুলিতে পতঙ্গ-বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত হয়েছেন।
এই প্রথম এমন উদ্যোগ। মশা-মাছি-ইঁদুর-শুয়োর কার তাড়ানোর কথা, কোন কর্তা কাকে তথ্য জানাবেন, কী কী জানাবেন, এত দিনে তার একটা বিধিব্যবস্থা হল।
আক্ষেপ, ব্যবস্থাটা কলকাতা বিমানবন্দরের লাগেজ ট্রলির মতো। তার তিনটে চাকা যেতে চায় তিন দিকে। এমনিতেই যথেষ্ট কম লোকজন। ধরুন কেবল পতঙ্গবিদের সংখ্যা। কলকাতা পুরসভায় আছেন তিন জন, জেলায় এ বছর নেওয়া হল মোট বিয়াল্লিশ জন, চুক্তিতে। অনেকেরই এটা পতঙ্গবিদ হিসাবে প্রথম চাকরি। এক এক জন গড়ে চার-পাঁচটি পুরসভার কাজ দেখছেন, কোথাও তার উপর যোগ হয়েছে পঞ্চায়েত। তাঁদের দায়িত্ব ফিল্ড কর্মীদের প্রশিক্ষণ-নজরদারি, লার্ভার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা। এক জেলায় দু’জন অস্থায়ী পতঙ্গবিদ এত কাজের কতটুকু করতে পারবেন? জনস্বাস্থ্য তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই।
জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রশংসিত রাজ্য তামিলনাড়ু। জনসংখ্যা এ রাজ্যের চাইতে তিন কোটি কম, কিন্তু পতঙ্গবিদ? একশো বাষট্টি জন। তাঁদের ন’জন কেবল চেন্নাই পুরসভায়। প্রত্যেকে স্থায়ী কর্মী। সকলের আছে প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা।
কম পড়েছে ফিল্ড-কর্মীও। গত বারে ভয়ানক আক্রান্ত ছিল উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার ১৩টি পঞ্চায়েত। এ বছর সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরুই হয়নি। তথ্য সংগ্রহ হচ্ছে মাত্র দু’টি পঞ্চায়েতে। করছেন কারা? স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য, আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ তাঁদের বোঝার ওপর শাকের আঁটি। পুরসভায় ফিল্ড-কর্মীরা অধিকাংশই কাউন্সিলর বা তাঁর ঘনিষ্ঠদের নির্দিষ্ট ব্যক্তি। কোথাও এক দিন, কোথাও দু’দিন, কোথাও কয়েক খেপে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে কর্মীদের। দক্ষতায় ফারাক থাকছে। কাজের পদ্ধতিতেও। কোথাও ডেঙ্গি-মশার লার্ভা পেলে তবেই তেল ছড়ানো হচ্ছে। কোথাও যে কোনও লার্ভা দেখলে, আবার কোথাও জমা জল দেখলেই। মশা মারতে ঘরের বাইরে গ্যাস, ব্লিচিং ছড়ানো বন্ধ করাই এখন কেন্দ্রের নিয়ম। জেলাতে এই অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এখনও চলছে।
কলকাতায় গৃহস্থের বাড়ি ঢুকে সরজমিনে দেখে কর্মী নিজে ফর্ম ভরছেন (অন্তত তেমনই দাবি)। মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান পুরসভায় গৃহস্থকেই ফর্মটা দিয়ে আসছেন কর্মীরা। ‘জল জমে আছে?’ ‘মশা জন্মাচ্ছে?’ ‘জ্বর হয়েছে?’ গৃহস্বামীর টিক-দেওয়া তথ্য জমা পড়ছে। স্বতন্ত্র নজরদারি? সম্ভাবনাই থাকছে না। কেন্দ্রের পরিদর্শক দলকে এলাকায় কাজই করতে দেয়নি দক্ষিণ দমদম পুরসভা।
আর ঘরের বাইরেটা? বিধাননগর পুরসভা আলাদা ফর্ম তৈরি করেছে। কর্মীরা রাস্তা, নর্দমা, নিকাশির অবস্থা তাতে লিখে রিপোর্ট করছেন পুরসভাকে। কৃষ্ণনগরে কর্মীরা জানাচ্ছেন, আবর্জনার স্তূপ, বন্ধ নর্দমার কথা লিখিত ভাবে জানানোর সুযোগ নেই। কাউন্সিলরকে মুখে জানাচ্ছেন। এই মডেলের সমস্যা— কাউন্সিলরের ক্ষমতা-মর্জি অনুসারে কাজে হেরফের হচ্ছে। হিতে বিপরীতও হয়। পর পর তিন দিন তিন পাড়ায় খোঁজ নিয়ে অন্তত ১০ জন জ্বরের রোগীর খোঁজ পেয়েছিলেন শিলিগুড়ির একটি ওয়ার্ডের ফিল্ড ওয়ার্কার। তিন দিনই রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন। তার পর পরই সেই কর্মীর তলব পড়ে ওয়ার্ড অফিসে। ‘‘পুরোদস্তুর হুমকি দিল কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ এক জন। বলল, প্রতি দিন এত জ্বরজারি লেখার কী আছে? এক দিন লিখলেই তো হয়। বলল, না মানলে অন্য কাউকে কাজ দিয়ে দেবে। এখন জ্বর লেখার আগে কাউন্সিলর অফিস থেকে শুনে নিই।’’
তথ্য নিয়ে রাজনীতির দৃষ্টান্ত এ বছরও মিলেছে, কলকাতার কয়েকটি ওয়ার্ডে ডায়ারিয়ার ঘটনা থেকে। বেআইনি নির্মাণে জলের অবৈধ লাইন টানতে গিয়ে দূষণ মিশেছে পানীয় জলে, সরকারি আধিকারিকরা জানিয়েছেন সাংবাদিকদের। কিন্তু কোন ওয়ার্ডে কে দায়ী, পুরসভা তা প্রকাশ করেনি। স্বাস্থ্য দফতরও চুপ। ডেঙ্গি যেমন ‘অজানা জ্বর’, ডায়ারিয়ার তেমন ‘অজানা উৎস’। তথ্য পাওয়ার দাবিতে সরকার যত সরব, তথ্য গোপনে ততই মরিয়া।
রোগের তথ্য পেতে হলে তথ্য জানানো চাই। কলকাতা পুরসভায় নাকি প্রতিটি ওয়ার্ডের মশক-প্রবণ এলাকার ম্যাপ তৈরি হয়েছে। কই সে ম্যাপ? প্রতিটি পুরসভা ও পঞ্চায়েতের বাসিন্দারা কেন জানবেন না, কোথায় মশার দাপট? কোন পাড়ায় দেখা দিয়েছে ডেঙ্গি? বিধাননগরের কয়েকটি ব্লক কমিটির সদস্যদের দাবি, মশার তেল ছড়াতে কর্মীরা এলে তাঁদের ডাকা চাই। তাঁরা সঙ্গে থাকবেন। কারণ পুরকর্মীরা কতটা কী করছেন, ঠিক করছেন কি না, কেউ বুঝছে না।
কেন ডেঙ্গি নিরসনে গৃহস্থকে ‘নিশানা’ করা হচ্ছে, ‘সঙ্গী’ নয়? হয়তো তা হলে স্বীকার করতে হয়, গেরস্ত-বাড়ির বাইরেও মশা জন্মাচ্ছে পচা ডোবায়, বন্ধ নালায়, রেলের জমিতে, যা সাফ করার হিম্মত সরকারের নেই। তার না আছে অর্থ, না আছে কর্মী, না আছে নানা দফতরের বোঝাপড়া। নিকাশি বেহাল বলে জল দাঁড়াচ্ছে আকছার। বিধাননগরে পাম্প চালিয়ে জল বার হচ্ছে, ধুলিয়ানের লিচুবাগানে জমে থাকছে।
কিন্তু দু’টি ক্ষেত্রেই যা প্রধান প্রয়োজন, নিকাশির সংস্কার, তার টাকা নেই। এমন বহু প্রশ্ন শুনতে হবে জেনেই হয়তো কাউন্সিলরেরা বাড়ি বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ এড়াচ্ছেন।
তবে প্রশ্নটা কেবল ব্যবস্থাপনার নয়, প্রশ্ন নীতিরও। নদিয়ার এক স্যানিটরি ইনস্পেক্টরের সাফ কথা, ‘‘প্লাস্টিক, থার্মোকল নিষিদ্ধ না করলে মশা কমবে না।’’ তেমন সিদ্ধান্ত নেবে কে?
জোড়াতালি দিয়ে জনস্বাস্থ্য হয় না। কেবল ডেঙ্গিই বাড়ছে না, ফিরছে কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া। ওত পেতে এনসেফেলাইটিস, ম্যালেরিয়া, জিকা। কাজ যদি করতেই হয়, সুশিক্ষিত, স্বতন্ত্র কর্মী-আধিকারিক নিয়ে যথাযথ বিন্যাসে, যথেষ্ট বরাদ্দ দিয়ে জনস্বাস্থ্য-ব্যবস্থা তৈরি হোক। যেখানে পানীয় জল-পূর্ত-সেচ-নিকাশির মতো দফতরের সঙ্গে রাজ্য ও পুরসভা-পঞ্চায়েতের সমন্বয়ের স্পষ্ট রূপরেখা থাকবে। কেবল জেলাশাসক আর মুখ্যমন্ত্রীই যদি সমন্বয়ের কর্তা হন, তা হলে জনস্বাস্থ্য অবহেলিত হবেই। কাজের অভিনয় শেষ হোক, শুরু হোক কাজ। সরকার নিজের মুখ বাঁচালেই হবে না, মানুষের প্রাণ বাঁচানো চাই।