মানুষই চাহিতে জানে, দয়াময়

তেমনই অবুঝ উত্তর-পূর্বের অধিবাসীরা। বহিঃশত্রুর আক্রমণ রুখতে মণিপুর, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড জুড়ে সেনা তো রাখতেই হবে। সেনা থাকলে একটু-আধটু বাড়াবাড়ি তারা করবেই।

Advertisement

কুমার রাণা

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৪৩
Share:

রাষ্ট্রের নিশানায় বিদ্ধ হচ্ছে ভারতবর্ষের মধ্যে নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ‘দেশ’। যেমন, ভারতের তথাকথিত মূলভূখণ্ডের আদিবাসীরা। বামপন্থী উগ্রবাদ দমনের নামে যখন খুশি পুলিশি অভিযান, যাকে ইচ্ছা তুলে নিয়ে যাওয়া। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে দেখা গেছে, কীভাবে ‘নকশাল’ নাম দিয়ে সত্তরোর্ধ্ব সাঁওতাল বৃদ্ধসহ দলে দলে মানুষকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল পুলিশ, বিনা বিচারে আটক থাকতে হল তাঁদের কয়েক বছর। অর্ধশতাব্দী আগে ‘নকশাল’ গ্রামগুলোতে আদিবাসী মেয়েরা যে ভাবে অত্যাচারিত, লুণ্ঠিত হয়েছেন, নতুন সহস্রাব্দে তারই ধারাবাহিকতা বেলপাহাড়ি, বাঁশপাহাড়ি, লালগড়, জামবনির গ্রামে গ্রামে। পূর্ণগর্ভা আদিবাসী রমণী পর্যন্ত নিষ্কৃতি পাননি, থানাগারদে সন্তানের জন্ম দিতে হয়েছে। দশকের পর দশক ধরে ভারতরাষ্ট্র তাঁদের প্রকৃতার্থে নাগরিক হিসেবে স্বীকার করেনি। তাঁদের বেঁচে থাকতে হয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বহুযুগবাহিত উত্তরাধিকারের জোরে। ভারতরাষ্ট্র যখন তাঁদের রাষ্ট্রীয় সীমানায় বন্দি করল, তখন তাঁদের যুদ্ধটা হয়ে উঠল অসম। প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াইতে ইতিহাস তাঁদের পক্ষে, কিন্তু রাষ্ট্র যখন রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের নামে দখল করল তাঁদের দেশ— বনভূমি, নদী ও পাহাড়— সেই আগ্রাসন রোখার জন্য প্রয়োজনীয় আয়ুধ এবং অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না। অথচ, লড়াই না করেও তাঁদের উপায় নেই। অতএব, সিধু মুর্মু ও তাঁর ভাই ও বোনেদের নেতৃত্বে ১৮৫৫-র সাঁওতাল ‘হুল’, বিরসা মুন্ডা ও তাঁর সহযোগীদের সংগঠিত ১৯০০-র ‘উলগুলান’-এর ধারা এ সহস্রাব্দেও বহমান থাকে। এবং ধাবমান থাকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের রথ। ছত্তীসগঢ়ে, ওডিশায়, ঝাড়খণ্ডে, চলতে থাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেশের লড়াই। রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতিগুলো যেখানে অধরা, ক্ষুধা, নিরক্ষরতা, অস্বাস্থ্য, উপার্জনহীনতা যেখানে সহজাত, প্রবঞ্চিত হওয়া যেখানে ভাগ্যের প্রতিরূপ, সেখানে রাষ্ট্রকে নিজের ভাবতে পারাটা লোকেদের কল্পনায় ধরে না। তাতে কী? রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন তো হয়ে চলেছে, বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় ভারতের শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করার স্বপ্নটা তো মোহন, তার জন্য কাউকে না কাউকে তো কিছু না কিছু মূল্য দিতেই হবে। কিন্তু ওরা মূর্খ, বড় কল্পনা আসে না, ওরা চায় নিজের দেশ, সেই দেশে নিজের মতো বেঁচে থাকতে পারার স্বাচ্ছন্দ্য। ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়।

Advertisement

তেমনই অবুঝ উত্তর-পূর্বের অধিবাসীরা। বহিঃশত্রুর আক্রমণ রুখতে মণিপুর, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড জুড়ে সেনা তো রাখতেই হবে। সেনা থাকলে একটু-আধটু বাড়াবাড়ি তারা করবেই। তার বিরুদ্ধে যদি লোকেরা কথা বলে তা হলে তাকে দমন করার অধিকার তো সেনাকে দিতেই হবে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বলে কথা, সুতরাং ভারতরাষ্ট্রের প্রহরীদের জন্য যা-খুশি-করার অধিকার সংবলিত একটা আইন না হলে চলে না। সেই অধিকারের বলে রাজধানী শহরগুলো পর্যন্ত বিকেলের পর নিঝুম। লোকেদের এখান থেকে ওখানে যেতে গেলে হাজার প্রশ্ন, পারমিট, অনুমোদনের কঠিন দস্তুর। বিনা প্রমাণে গ্রেপ্তার, কারানিক্ষেপ, সেনার হাতে সাধারণ লোকের হত্যা দৈনন্দিনতায় পর্যবসিত। লোকগুলো বেয়াড়া, এত বড় ভারতরাষ্ট্রের স্বার্থে সামান্য, ক্ষুদ্র স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে চায় না। শুধু নিজেদের দেশ চায়, ভয়মুক্ত জীবন চায়। ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়।

নিজেদের দেশ চায় কাশ্মীর উপত্যকার লোক। ইতিহাসসমৃদ্ধ এ জনপদের ইতিহাস জুড়ে বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস: ১৫৮৫-তে কাশ্মীরের স্বাধীন শাসক ইউসুফ শাহ চকের সঙ্গে ভারতসম্রাট আকবরের বিশ্বাসভঙ্গের পুনরাবৃত্তি ১৯৫২ সালের স্বাধীন ভারতে। কাশ্মীরের মানুষের স্বাধীনতা লুণ্ঠিত হতে হতে আজ তা এক সেনা-রাষ্ট্রে পরিণত। কাশ্মীরের বাসিন্দা মানেই ভারতরাষ্ট্রের কাছে সরাসরি শত্রু, কাশ্মীরি যুবক মানেই জঙ্গি, আর জঙ্গিদের দমন করা রাষ্ট্রধর্ম। সুতরাং তাদের গ্রেপ্তার করে, বেপাত্তা করে, খুন করে শবদেহ গায়েব করে, এবং মানুষের কণ্ঠরোধ করে রাষ্ট্র তার ক্ষমতার প্রমাণ রাখে। রাষ্ট্রের মুখ হয়ে ওঠে সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, সংবাদমাধ্যম। খবরের কাগজে শিরোনাম হয়, এত জন জঙ্গি খতম, এত জন সৈন্য শহিদ। ভারতীয়ত্বের গর্বে গর্বিত বিবেক প্রশ্নটুকুও তোলে না, কেন দুটো মৃত্যুকে আলাদা আলাদা নামে চিহ্নিত করা হবে? প্রশ্ন ওঠে না আক্রমণকারী আসলে কে? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া, নিরন্তর বিশ্বাসহননের শিকার, সেই মানুষ, যে তার দেশে সুখে শান্তিতে থাকতে চেয়েছিল, না কি ভারতরাষ্ট্র, যে বেইমানি ও বেয়নেটের জোরে মানুষের দেশ দখল করে রেখেছে। এ তো কাশ্মীরিদেরই প্রবঞ্চনা নয়, ভারতবাসীকেও মিথ্যাটাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করানোর খেলা: কাশ্মীর ভারতের অবিভাজ্য অঙ্গ বলে সমগ্র ভারতবাসীকেই আগ্রাসীর তালিকাভুক্ত করে দেওয়া। অথচ, কাণ্ডজ্ঞানই জানিয়ে দেয়, কাশ্মীরিরা কারও দেশ দখল করতে চায় না, তারা তাদের দেশটুকু চায়, যে অদৃশ্য কারাগারের ভিতর তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে মুক্ত হতে চায়। কিন্তু ভারতরাষ্ট্রের কল্পনায়, ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়।

Advertisement

কোচবিহার থেকে কুপওয়ারা, মালকানগিরি থেকে মেহসানা পর্যন্ত যে ভারত, তার মধ্যে নানা দেশ, তারা আকারে ছোট, সংজ্ঞায় বিরাট, অবিভাজ্য দেশ ও মানুষ। তারা নিজেদের হক চায়, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাবার চায়, সমানাধিকারের, স্বাধিকারের স্বীকৃতি চায়। ভারতমাতার ছদ্মবেশ পরানো রাষ্ট্র নয়, তারা তাদের দেশ চায়। সেই চাওয়াটা ক্ষমতার কাছে রাষ্ট্রদ্রোহ, কিন্তু যে ভিন্ন ভিন্ন দেশ মিলে এক বহু দেশীয় ভারত, তার কাছে এটাই দেশপ্রেম। এই প্রেমে দ্রোহ অপেক্ষা পবিত্র কিছু নেই। মানুষই চাহিতে জানে, দয়াময়।

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement