এভাবেই পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলেন অধ্যাপক। এএনআই-এর টুইটারের ভিডিয়ো থেকে নেওয়া ছবি
চমকে উঠতে হল দৃশ্যটা দেখে। শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে অধ্যাপক ছুটছেন ছাত্রদের পিছু পিছু, শিক্ষার্থীদের পা ধরতে চাইছেন তিনি।
শিক্ষক চাইছেন ছাত্রের পা ছুঁতে! চমকে ওঠাই স্বাভাবিক। তাই এ বার ভাবা দরকার, এ রকম বিস্ময়কর দৃশ্য কেন তৈরি হল? শিক্ষাঙ্গনের চেহারাটা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে?
ঘটনাটা ঘটেছে মধ্যপ্রদেশের একটি কলেজে। অধ্যাপক পড়াচ্ছিলেন। শ্রেণিকক্ষের বাইরে একটি ছাত্র সংগঠনের বিক্ষোভ-স্লোগান চলছিল। অধ্যাপক হইচই থামাতে বলেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা সে কথায় কর্ণপাত করেননি। উল্টে ওই অধ্যাপককে ‘দেশবিরোধী’ তকমা দিয়ে দেন। তার পরেই অভিনব পন্থা নেন অধ্যাপক। পড়ুয়াদের পিছু ধাওয়া করে, তাঁদের পা ছোঁয়ায় চেষ্টা করতে থাকেন এবং জানান যে, তিনি ক্ষমাপ্রার্থী।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
ছাত্রদের বিশৃঙ্খলা সামলাতে এক জন শিক্ষককে যে পন্থা নিতে হল, তা আমাদের বেশ কয়েকটি প্রশ্নের সম্মুখীন করছে।
প্রথম প্রশ্ন হল, ছাত্র সমাজ কি শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা সাংঘাতিক ভাবে হারিয়ে ফেলছে? যদি তা না হয়, তা হলে এক জন অধ্যাপক তাঁর ছাত্রদের কোনও একটি আচরণে বিরক্তি প্রকাশ করলে ছাত্ররা অধ্যাপককে সরাসরি অপমানের রাস্তায় হাঁটবেন কেন? ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, ছাত্র সমাজের মূল্যবোধ কেমন হওয়া উচিত, অনেক পড়ুয়ার মধ্যেই কি সে বোধ আজকাল লোপ পাচ্ছে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির নামে যা চলছে, তা কি আদৌ রাজনীতি? নাকি শুধু তাণ্ডব আর নৈরাজ্যবাদ?
আরও পড়ুন: ‘দেশদ্রোহী’ তকমা! এবিভিপি-র ছাত্রদের পায়ে ধরে ‘শিক্ষা’ দিলেন অধ্যাপক
কলেজ হোক বা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রখ্যাত হোক বা অখ্যাত, দেশের নানা প্রান্ত থেকে (পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম নয় মোটেই) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের সৃষ্টি করা বিশৃঙ্খলার খবর ইদানীং প্রায়শই শিরোনামে আসছে। ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনা বাড়়ছে, হিংসাত্মক হানাহানি চলছে, পড়ুয়ারা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শিক্ষক-অধ্যাপকরাও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এটা কোন ধরণের ছাত্র রাজনীতি? এই রাজনীতিতে ছাত্রদের কোন কল্যাণ হবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বা কোন উন্নতির শিখরে পৌঁছবে? দেশের শিক্ষাঙ্গনের এই পরিস্থিতি বহু চর্চিত একটি প্রশ্নকে আবার খুব বড় করে তুলে ধরছে— ছাত্র রাজনীতির কি আদৌ কোনও প্রয়োজন রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে? ছাত্রদের কি রাজনীতি করার অধিকার আদৌ থাকা উচিত? এই প্রশ্ন যেমন বহু বার তোলা হয়েছে, তেমনই বহু বার এর উত্তরও দেওয়া হয়েছে। গোটা বিশ্ব সাক্ষী, পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়া নানা আলোড়ন ছাত্রদের হাত ধরেই শুরু হয়েছে নানা সময়ে। অতএব, ছাত্রদের রাজনীতি করার প্রবণতায় অপকর্ষ খোঁজা উচিত নয়। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির সাম্প্রতিক ছবিটা এ দেশে ক্রমশ যেখানে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, সে ছবিতে অপকর্ষ খোঁজার প্রয়োজন নেই, ছবিটাই ধীরে ধীরে অপকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির নামে যা চলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আসলে তাণ্ডব, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতার নামান্তর।
ছাত্র রাজনীতির এতখানি গুণগত অধঃপতন এ দেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। অভূতপূর্ব নিম্নগামিতার সাধনা শুরু হয়েছে যেন। অধ্যাপককে তাই প্রতিবাদের জন্য এক অভূতপূর্ব পথ বেছে নিতে হল। মধ্যপ্রদেশের কলেজটিতে তৈরি হওয়া ওই বিস্ময়কর দৃশ্যও যদি সম্বিৎ না ফেরায়, তা হলে আরও অনেক অভূতপূর্ব ছবি বোধহয় অপেক্ষায় থাকবে।